আদালতে কারাদণ্ড বা জরিমানার পরোয়ানা, আদেশনামা, সমনসহ নানা ফরম ও প্রয়োজনীয় সব কাগজ দেওয়ার কথা মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের। তবে সারা দেশের আদালতেই ফরম ও অর্ডারশিটের তীব্র সংকট। চাহিদার তুলনায় মামলার অতিগুরুত্বপূর্ণ এসব ফরম-অর্ডারশিট দিতে পারছে না অধিদপ্তরটি। সংকট মেটাতে ভিন্ন পথে হাঁটছেন আদালতে নিয়োজিত পেশকার, নাজির ও জিআরও শাখার কর্মকর্তারা। বিচারপ্রার্থী বা আইনজীবীদের নথি দেওয়ার বিনিময়ে নেওয়া হয় ‘বকশিশ’। আর বকশিশের নামে নেওয়া অবৈধ টাকায় কেনা হয় কাগজ। সেই কাগজে তৈরি অর্ডারশিটেই দেওয়া হচ্ছে বিচারকের আদেশ থেকে শুরু করে মামলার রায়। তবে আদালতে অর্ডারশিট বা ফরমের সংকট থাকার কথা অস্বীকার করেছেন মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
টাকা ছাড়া বিচারপ্রার্থীদের নথি নড়ে না, এ যেন নিয়মে পরিণত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, আবু সুফিয়ান নামে এক অসহায় দরিদ্র ব্যক্তির কথা। গত ৬ জানুয়ারি রাতে মোহাম্মদপুরের রায়ের বাজার থেকে চোর সন্দেহে আটক করা হয় তাকে। তেমন কোনো বড় অপরাধের আলামত না থাকায় ‘পাঁচ আনি’ (সন্দেহভাজন হিসেবে আটক) মামলায় তাকে আদালতে তোলা হয়। এই আইনে আসামিকে জরিমানা করে ছেড়ে দেওয়ার কথা। কিন্তু সুফিয়ানের ক্ষেত্রে তেমনটা হয়নি। পরে স্বামীকে ছাড়াতে তিন বছরের কন্যাশিশুকে কোলে করে আদালতে আসেন স্ত্রী নাছিমা। নাছিমার শ্বশুরও ছিলেন সঙ্গে। প্রথমে তারা নন-জিআরও শাখায়, পরে আদালতে গেলে তাদের আইনজীবী সঙ্গে নিয়ে আসতে বলা হয়। ‘পাঁচ আনি’ মামলায় শুধু জরিমানা দিয়ে ছাড়পত্র নিলে হাজতখানা থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু জরিমানা বাদেও ছাড়পত্র নেওয়ার সময় পেশকারকে এবং মুক্তির সময় হাজতখানার পুলিশকে বকশিশ দিতে হয়েছে তাদের।
এ ঘটনার সূত্র ধরে জিআরও শাখায় গেলে দেখা মেলে আইনজীবী পরিচয়দানকারী মৃদুল কান্তি ঘোষের। তিনি টাকার বিনিময়ে ‘পাঁচ আনি’ মামলার আসামিদের জরিমানা দিয়ে সহজে বের করার কাজ করেন বলে জানান। কালবেলাকে তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক পাঁচ আনি মামলার আসামির জন্য পেশকারকে দিতে হয় ৫০ টাকা এবং পুলিশকে দিতে হয় ৭০ থেকে ১০০ টাকা।’ পেশকারকে কেন টাকা দিতে হয়, এমন প্রশ্নে তিনি হেসে দিয়ে বলেন, ‘না হলে পেশকার ছাড়পত্র প্রিন্ট করেন না। ছাড়পত্রের ফরমেট তাদের কাছে থাকে। তারা ওটা (ফরম) কপি করে নিজেরাই প্রিন্ট করে দেন।’
এমন চিত্র শুধু ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতেই নয়। একইভাবে ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত, ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে প্রতিদিনকার ঘটনা। সরকারিভাবে যেসব ফরম বিনামূল্যে দেওয়ার কথা, সেগুলো নিতে বিচারপ্রার্থী বা তার আইনজীবীকে দিতে হয় বকশিশের নামে টাকা। বকশিশ না দিলে নড়ে না নথি।
অন্যদিকে সরকারিভাবে বিনামূল্যে পাওয়ার কথা থাকলেও ফরম বা অর্ডারশিটের চাহিদা মেটাতে পারছে না মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তর। আদালতের নেজারত শাখাসহ পেশকাররা বলছেন, তাই বাধ্য হয়ে বকশিশের টাকায় দোকান থেকে কেনা হয় কাগজ। সেই কাগজ দিয়ে তৈরি অর্ডারশিট রায় লেখার জন্য পাঠানো হয়।
মামলা পরিচালনার জন্য আদালতে ফরমসহ নানা জিনিসের প্রয়োজন হয়। যেমন—আদেশনামা, কারাদণ্ড বা জরিমানার পরোয়ানা, গ্রেপ্তারি ওয়ারেন্ট, কজলিস্ট, সাদা কাগজ, নীল কাগজ, কোর্ট সার্টিফিকেট ফরম, সাক্ষীর জবানবন্দি ফরম, সাক্ষীর প্রতি সমন, আসামির প্রতি সমন ফরম, সাজা পরোয়ানা ফরম, সাক্ষীর প্রতি এন/বি/ডব্লিউ/ডব্লিউ ফরম, গ্রেপ্তারি পরোয়ানাসহ নানা স্টেশনারি জিনিস। আদালতগুলোয় সবচেয়ে বেশি লাগে সাদা কাগজ। এরপর নীল কাগজ। ঢাকার অধস্তন আদালতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, আদালতে প্রতিটি থানার সাধারণ নিবন্ধন শাখা তাদের প্রয়োজনীয় ফরম, কাগজ ও অর্ডারশিট পেতে চাহিদা দেন নেজারত শাখায়। এরপর নেজারত শাখা থেকে চাহিদা দিয়ে পাঠানো হয় মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরে। কিন্তু সব নেজারত শাখার কর্মকর্তারা বলছেন, চাহিদার তুলনায় ফরম ও অর্ডারশিট মেলে খুবই কম। সাক্ষীর জবানবন্দিসহ গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত আদালতে বিশেষ সাদা কাগজের সংকট সবচেয়ে তীব্র। এ জন্য বাধ্য হয়ে দোকান থেকে সাধারণ সাদা কাগজ কেনা হয়। এ ছাড়া রায় লেখাসহ নানা কাজে ব্যবহার হয় বিশেষ নীল কাগজের অর্ডারশিট। এই নীল কাগজের অর্ডারশিটেরও সংকট রয়েছে। এ কারণে দোকান থেকে ঘুষ কিংবা বকশিশের টাকায় কেনা সাধারণ কাগজের অর্ডারশিটে লেখা হচ্ছে রায়। এ ছাড়া আদালতে প্রতিটি থানার সাধারণ নিবন্ধন শাখা থেকে আইনজীবী বা বিচারপ্রার্থী সাধারণ মানুষ প্রয়োজনীয় নথি নিতে গেলে কর্মচারীদের দিতে হয় টাকা। টাকা না দিলে নথিও সময়মতো মেলে না।
জজকোর্টের আইনজীবী আমিনুল ইসলাম মল্লিক বলেন, আদালতের প্রতিটি মামলার প্রতিটি পদক্ষেপে সংশ্লিষ্ট আইনজীবীকে বা বিচারপ্রার্থীকে তদবির করতে হয়। তদবির না করলে কোনো ফাইল (যেমন আসামির সমন, সাক্ষীদের সমন, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, আদেশনামা) ঠিক সময় যায় না। এগুলো কোর্টের মাধ্যমে যাওয়ার কথা। কিন্তু বকশিশ না দিলে এগুলো পড়ে থাকে। মামলা ও নথির ধরন বুঝে তারা বকশিশের নামে ২০০ টাকা থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত দাবি করে থাকেন। এতে করে বিচারপ্রার্থী ও আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টরা চরম ভোগান্তিতে পড়েন।
আদালতের একজন পেশকার বলেন, ‘শুধু যে আমরা বকশিশ নিই, এমন নয়। প্রতিটি আদালতে আগে থেকেই এটি প্রচলিত হয়ে আসছে। ফরম, আদেশনামা ও কাগজের চাহিদাপত্র দিলেও নেজারত শাখা থেকে তেমন পাই না। তাই বাইরে দোকান থেকে সাধারণ কাগজ কিনে অনেক সময় ফটোকপি করে ফরম-আদেশনামা তৈরি করে নিই।’
ঢাকা মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের জিআরও শাখার কয়েকজন স্টাফ জানান, জিআরও শাখার জন্য আদেশনামা, গ্রেপ্তারি পরোয়ানা, কাস্টডি পেপার বেশি লাগে। নেজারত শাখা থেকে বিনামূল্যে এসব দেওয়ার কথা। কিন্তু ৫০০ থেকে ৬০০ পিসের এক বান্ডিল আদেশনামার জন্য নেজারত শাখায় ৩০০ টাকা দিতে হয়। একইভাবে পরোয়ানা, কাস্টডি পেপারসহ সব ধরনের ফরমের জন্য ২০০ থেকে ৩০০ টাকা করে দিয়ে দিতে হয়। টাকা না দিলে ফরম দেয় না।
ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের নেজারত শাখার প্রশাসনিক কর্মকর্তা আবু হাসান কালবেলাকে বলেন, ‘মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে ফরম, অর্ডারশিট ও কাগজ নেওয়ার জন্য যে বাজেট, তাতে আমাদের কুলায় না। চাহিদার তুলনায় আমরা ১০০ ভাগের মাত্র ১ ভাগ পাই। আদেশনামা, নানা ফরম, কলম সব তাদের দেওয়ার কথা। কিন্তু আমরা খুবই কম পাই। সাক্ষীর জবানবন্দির কাগজ পর্যাপ্ত পাই না। এগুলোর একেবারেই সংকট।’ এ সময় তিনি একটি ফরম দেখিয়ে বলেন, ‘এই যে দেখুন, নথি তলবের ফরম। আমরা দোকান থেকে সাধারণ কাগজ কিনে এই ফরম বানিয়ে নিয়েছি।’
ঢাকার সিএমএম আদালতের নাজির মো. রেজোয়ান খন্দকার বলেন, ‘মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে আমাদের যে কাগজ, ফরম ও অর্ডারশিট দেয়, তা খুবই অপ্রতুল। আমরা দোকান থেকে কাগজ কিনে এসবের চাহিদা মেটাই। বিশেষ করে আদালতে ব্যবহৃত বিশেষ সাদা কাগজ চেয়েও তেমন পাই না। এগুলো কিনতে হয়।’
ঢাকার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নেজারত শাখার সহকারী রেকর্ড কিপার মো. জাহাঙ্গীর বলেন, ‘আদেশনামা, ফরম, সমনের কপিসহ নানা কাগজের জন্য প্রতি বছর আমাদের বাজেট ২ লাখ টাকা। কিন্তু গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে আমরা ১ লাখ ৪৭ হাজার টাকার জিনিসপত্র নিতে পেরেছি। চাহিদা দিলে সবটা পাই না।’
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) ওমর ফারুক ফারুকী বলেন, ‘ফরম, আদেশনামা তো বেশি টাকার জিনিস নয়। এগুলোর জন্য বিচারপ্রার্থী বা আইনজীবীদের থেকে কেন অবৈধ টাকা নিতে হবে। পেশকার, স্টাফ সবাই তো বেতন পান। যদিও এমন কোনো অভিযোগ আমার জানা নেই। যদি কোনো আইনজীবী অভিযোগ করেন, তখন দেখা যাবে। তবে সরকার পতনের পর আদালতে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। সামনে আরও সংস্কার হবে বলে আমি মনে করি।’
শুধু ঢাকার আদালতগুলোতেই নয়, সারা দেশের আদালগুলোয় মামলার নানা ফরম, অর্ডারশিট বা সাক্ষীর বিশেষ কাগজ সংকট রয়েছে। এ বিষয়ে রাজশাহী জেলা ও দায়রা জজ আদালতের নাজির জাহিদুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘প্রতি বছর ফরম ও অর্ডারশিটের জন্য আমাদের বাজেট ৫৭ হাজার টাকা। এ বাজেটে আমাদের তেমন কিছুই হয় না। কাগজ সংকট মোকাবিলা করতে ফটোকপি করে ফরমসহ প্রয়োজনীয় নথি তৈরি করা হয়।’ কাগজ কেনার টাকা কীভাবে ব্যবস্থাপনা করা হয়, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘স্থানীয়ভাবে ম্যানেজ করা হয়। পেশকার বা আদালতের স্টাফরা এটা ম্যানেজ করেন।’
চট্টগ্রাম সিএমএম আদালতের প্রশাসনিক কর্মকর্তা ইউসুফ আলী বলেন, ‘প্রতি বছর আমাদের মামলার যে ফরম, অর্ডারশিট ও কাগজ দেওয়া হয়, তা পর্যাপ্ত নয়। সংকট থাকায় পরবর্তী সময়ে আমরা দোকান থেকে কাগজ কিনি। এরপর ফটোকপি করে বিভিন্ন ফরম তৈরি করি। এরপর প্রতিটি আদালতে চাহিদা অনুযায়ী দিয়ে দিই।’
বাংলাদেশ জুডিশিয়াল সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক মহাসচিব ও সাবেক জেলা ও দায়রা জজ শাহজাহান সাজু কালবেলাকে বলেন, ‘সব কোর্টে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তর থেকে কাগজ, ফরম ও অর্ডারশিট দেওয়ার কথা। আমি জেলা জজ থাকা অবস্থায় দেখেছি, নেজারত শাখা থেকে আমরা যে পরিমাণ কাগজ, অর্ডারশিট ও ফরমের চাহিদা দিতাম, তা পেতাম না। ফরম ও অর্ডারশিট আনার জন্য ঘুষের কথা বলা হতো। এ টাকা অধিদপ্তর নেয়, নাকি কোর্টের স্টাফরা নেন, তা আসলে বলতে পারব না। তবে টাকা লাগে। তবুও কাগজ, অর্ডারশিট ও ফরম সংকট থাকত।’
সংকট মেটাতেন কীভাবে, প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সংকট মেটাতে বাইরে থেকে সাধারণ কাগজ কিনতে হতো। আদালত থেকে এর জন্য কোনো টাকা দেওয়া হয় না। পেশকার, স্টাফরা বিভিন্ন সময় যে কিছু টাকা-পয়সা নেন, সেটা দিয়ে তারা নিজেরাই কিনে কাজ চালান।’
এদিকে মুদ্রণ ও প্রকাশনা অধিদপ্তরের উপপরিচালক (বাংলাদেশ ফরম ও প্রকাশনা অফিস) মো. নজরুল ইসলাম কালবেলাকে বলেন, ‘আমাদের ফরম ও প্রকাশনা অফিস থেকে আদালতের যাবতীয় ফরম-আদেশনামাগুলো দিই। আদালত থেকে যেসব চাহিদা দেওয়া হয়, আমরা তা পূরণ করি। আমার জানামতে, আদালতে ফরমের বা অর্ডারশিটের কোনো সংকট নেই। ঢাকার বাইরে জেলার আদালতের জন্য আমাদের আঞ্চলিক অফিস আছে। চাহিদা অনুসারে আমরা বিজি প্রেস, গভর্নমেন্ট প্রিন্টিং প্রেসসহ তিনটি প্রেস থেকে ছাপিয়ে দিই। আর কাগজ ও কলমসহ মনিহারি জিনিস বাংলাদেশ স্টেশনারি অফিস থেকে দেওয়া হয়।’
ফরম বা অর্ডারশিট দেওয়ার সময় টাকা নেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘এসব অভিযোগ সঠিক নয়। আমাদের অফিসে কেউ ঢুকতে পারে না। টাকা দেবে কী করে। বাইরে থেকে ডেসপার শাখা থেকে ফরম দেওয়া হয়।’