
ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ‘কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্সে’ আগুনের খবর দ্রুতই পেয়েছিল বিমানবন্দরের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ দল। তবে অগোছালোভাবে রাখা পণ্যের স্তূপের কারণে তারা উৎসের কাছে গিয়ে আগুন নেভানোর সুযোগ পায়নি। দূর থেকে পানি ছিটিয়ে লাভ হয়নি।
বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের একাধিক কর্মীর সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন (পণ্য রাখার স্থান) লাগে গত শনিবার। এ ঘটনায় কোনো প্রাণহানি হয়নি। তবে প্রাথমিক হিসাবে প্রায় ৩০০ কোটি টাকার পণ্য ও কাঁচামাল পুড়ে গেছে বলে দাবি করছেন ব্যবসায়ীরা। ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি হতে পারে বলেও উল্লেখ করছেন তাঁরা।
কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে বেলা সোয়া দুইটার দিকে। বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের একাধিক কর্মী জানান, আগুন লাগার পর বিমানবন্দরের এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোলারের (এটিসি) মাধ্যমে বার্তা যায় বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের নিজস্ব ফায়ার স্টেশনে। নির্দেশনা পেয়ে দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে যায় দুটি ইউনিট।
তবে অগোছালোভাবে রাখা পণ্যের স্তূপের কারণে তারা উৎসের কাছে গিয়ে আগুন নেভানোর সুযোগ পায়নি। দূর থেকে পানি ছিটিয়ে লাভ হয়নি।
বেবিচকের নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের দুজন কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, কর্মীরা পৌঁছে অনেকক্ষণ কোনো কাজ করতে পারেননি। পরে অনেক দূর থেকে পানি ঢেলে আগুন নেভানোর চেষ্টা করেন। তবে প্রচুর বাতাস থাকায় আগুন দ্রুত পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে।

ফায়ার স্টেশনের কর্মীদের অভিযোগ, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে তাঁরা আগুন নেভাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। দ্রুত পণ্যগুলো সরিয়ে দেওয়া হলে আগুনের কাছাকাছি গিয়ে পানি ছিটানো যেত। তাহলে আগুন এত ছড়িয়ে পড়ত না। এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।
বিষয়টি নিয়ে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ব্যবস্থাপনা বিভাগের পরিচালক শাকিল মিরাজের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা একটি তদন্ত কমিটি করেছেন। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে।
ফায়ার স্টেশনের কর্মীদের অভিযোগ, বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষের অব্যবস্থাপনার কারণে তাঁরা আগুন নেভাতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারেননি। দ্রুত পণ্যগুলো সরিয়ে দেওয়া হলে আগুনের কাছাকাছি গিয়ে পানি ছিটানো যেত। তাহলে আগুন এত ছড়িয়ে পড়ত না। এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।

বেবিচক-সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী বিমানবন্দরের ভেতরে তাদের নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা রয়েছে। আগুন নেভানোর জন্য চারটি ফায়ার ইউনিট রয়েছে। এর মধ্যে অগ্নিনির্বাপণ কাজে ব্যবহৃত তিনটি গাড়ি সচল। একটি মেরামতের জন্য পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি ইউনিট পরিচালনার জন্য ৬ থেকে ৭ জনও রয়েছে তাঁদের।
সূত্র জানায়, নিজস্ব ফায়ার স্টেশনের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে যাওয়ার ১০ মিনিট পরে যায় বিমানবাহিনীর ফায়ার ইউনিট। এরপর সেনাবাহিনী ও ফায়ার সার্ভিসের ইউনিটগুলো আগুন নেভানোর কাজে যোগ দেয়। আগুন নেভাতে ১৩টি ফায়ার স্টেশনের ৩৭টি ইউনিট এবং সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী, পুলিশ ও বিজিবি কাজ করে। প্রায় সাত ঘণ্টা পর আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। রাত ৯টার দিকে বিমানবন্দর চালু হয়। আগুন পুরোপুরি নেভানো সম্ভব হয় ২৬ ঘণ্টা পর।
গাড়ি কেন মেরামত হলো না, সে বিষয়ে বেবিচকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা হয়েছে। তবে সম্ভব হয়নি। ফোন করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।
১৯টি গাড়ির সব কটিরই মেরামত দরকার
বেবিচকের সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট, ইঞ্জিনিয়ারিং ও স্টোর ইউনিটের এক চিঠির সূত্র বলছে, দেশের আটটি বিমানবন্দরে নিজস্ব অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার জন্য ১৯টি গাড়ি রয়েছে। এগুলোকে ‘এয়ারক্র্যাফট রেসকিউ ফায়ার ফাইটিং ভেহিকেল’ বলা হয়।
১৯টি গাড়ির মধ্যে ঢাকার হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৪টি, চট্টগ্রামের শাহ আমানতে ৩টি, সিলেটের ওসমানীতে ৪টি, কক্সবাজারে ২টি, সৈয়দপুরে ২টি, যশোরে ১টি, শাহ মখদুমে ১টি, বরিশালে ২টি গাড়ি রয়েছে।
গাড়ি মেরামতের জন্য ২০২৪ সালের ১ এপ্রিল থেকে গত জুলাই পর্যন্ত বেবিচকের সংশ্লিষ্ট ইউনিট থেকে সদর দপ্তরে ১৯ বার চিঠি পাঠানো হয়েছিল। সর্বশেষ চিঠিটি পাঠানো হয় গত ৩১ জুলাই। চিঠিতে বলা হয়, এসব গাড়িতে ক্ষুদ্র ত্রুটি মেরামত না করার কারণে ভবিষ্যতে বড় ত্রুটি দেখা দিতে পারে। তখন কার্যক্রম বন্ধ রেখে মেরামত করতে যথেষ্ট সময়ের প্রয়োজন হবে। এতে আন্তর্জাতিক সিভিল এভিয়েশন অর্গানাইজেশনের নিরীক্ষা আপত্তিতে পড়তে হতে পারে।
আমি ফায়ারের মহাপরিচালক থাকা অবস্থাও ঢাকার বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। তখন কিছু সুপারিশ করেছিলাম। সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হলে আগুনে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান
গাড়ি কেন মেরামত হলো না, সে বিষয়ে বেবিচকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা হয়েছে। তবে সম্ভব হয়নি। ফোন করে এবং খুদে বার্তা পাঠিয়ে সাড়া পাওয়া যায়নি।
সার্বিক বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান প্রথম আলোকে বলেন, একটি আন্তর্জাতিক মানের বিমানবন্দরে সব ধরনের আগুন নির্বাপণের কার্যকর ব্যবস্থা থাকা দরকার। কিন্তু ঢাকার বিমানবন্দরে সেটা নেই। বিমানবন্দর পরিচালনার দায়িত্বে যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের মধ্যেও চরম অব্যবস্থাপনা ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে।
আলী আহাম্মেদ খান আরও বলেন, ‘আমি ফায়ারের মহাপরিচালক থাকা অবস্থাও ঢাকার বিমানবন্দরে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছিল। তখন কিছু সুপারিশ করেছিলাম। সেগুলো বাস্তবায়ন করা হয়নি। সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করা হলে আগুনে এত ক্ষয়ক্ষতি হতো না।’
তদন্ত কমিটি
এদিকে কার্গো ভিলেজ কমপ্লেক্স ভবনে আগুনের ঘটনা তদন্তে গতকাল সোমবার পাঁচ সদস্যের একটি কমিটি করেছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর। পাঁচ সদস্যের এই তদন্ত কমিটির সভাপতি করা হয়েছে ফায়ার সার্ভিসের অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স শাখার পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরীকে।
ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টাফ অফিসার মো. শাহজাহান শিকদার প্রথম আলোকে বলেন, কমিটির সদস্যদের ১৫ কর্মদিবসের মধ্যে তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
এর আগে গত রোববার বেসরকারি বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে।