Image description

ডেঙ্গু এখন মৌসুমি রোগের সীমানা ছাড়িয়ে দীর্ঘস্থায়ী এক জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে। সরকারি হিসেবে আক্রান্ত ৫৮ হাজারের বেশি মানুষ, মৃত প্রায় আড়াইশ। অথচ সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই সংখ্যা বাস্তবে আরও অনেক বেশি। প্রতি বছরই ডেঙ্গুতে আমাদের নাস্তানাবুদ হতে হচ্ছে। বিষয়টিকে আমাদের ‘জাতীয় ব্যর্থতা’ হিসেবে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তার মতে, ‘আমাদের ব্যর্থতা শুধু স্বাস্থ্য খাতে নয়, এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও অর্থনীতির দুর্বলতারও প্রতিফলন।’

সম্প্রতি ঢাকা পোস্টকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, কেন ডেঙ্গু আমাদের জাতীয় ব্যর্থতার প্রতিচ্ছবি। এটি কীভাবে একটি কর্মক্ষম জনগোষ্ঠীর উৎপাদনশীলতা হ্রাস করছে এবং কেন সিটি কর্পোরেশনের ‘আইওয়াশ’ কার্যক্রম ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কোনো প্রভাব ফেলছে না।

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ডেঙ্গু ডাইনামিক ড্যাশবোর্ডে এখন পর্যন্ত ৫৮ হাজার ২৮০ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে এবং ২৪৩ জন মারা গেছেন। কিন্তু এটি চূড়ান্ত বা সঠিক সংখ্যা নয়। কারণ, সরকারি হিসাবে সব হাসপাতালের তথ্য আসে না, আবার সরকারি তালিকাভুক্ত হাসপাতালের বাইরেও অসংখ্য কেস রয়েছে। তাই ধারণা করা যায়, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা সরকারি হিসাবের চেয়ে অনেক বেশি। এই অবস্থায় বলা যায়, চলতি বছরের ডেঙ্গু সংকট নিঃসন্দেহে গভীর।

 

ঢাকা পোস্ট : কারা বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন। ডেঙ্গুতে মৃত্যু সমাজ ও অর্থনীতিতে কোন ধরনের প্রভাব ফেলছে?

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : ডেটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, আক্রান্তদের ৮০ থেকে ৯০ শতাংশের বয়স ৫০ বছরের নিচে। অর্থাৎ তারা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী। এর মধ্যে শিশু আক্রান্ত ও মৃত্যুর হার তুলনামূলক বেশি। একটি শিশু মারা গেলে সেটি শুধু পরিবার নয়, পুরো সমাজের জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী মানসিক আঘাত।

dhakapost
ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা হয় না, কাজ করে সিন্ডিকেট; লার্ভা ধ্বংস না করলে নিয়ন্ত্রণ অসম্ভব— ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ / ছবি- ঢাকা পোস্ট

আবার তরুণ ও কর্মক্ষম বয়সের মানুষ মারা গেলে সেটি সরাসরি অর্থনীতিতে আঘাত করে। একজন তরুণ হয়তো সদ্য পড়াশোনা শেষ করেছে বা কর্মজীবন শুরু করেছে— তার মৃত্যু মানে পুরো উৎপাদনশীল জীবনের ক্ষতি। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র— সব স্তরে এটি এক বিশাল অর্থনৈতিক ক্ষতি।

ঢাকা পোস্ট : প্রতি বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে, অথচ নিয়ন্ত্রণে অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। এর মূল কারণ কোথায়?

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : আমি বলব, এটি আমাদের সম্মিলিত অনাচারের ফল। ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র— সবাই দায়ী। ব্যক্তি পর্যায়ে সচেতনতার অভাব বড় কারণ। ঘরে বা বারান্দায় জমে থাকা পানিতে মশা জন্মায়, কিন্তু তা অনেকেই খেয়াল করেন না। কমিউনিটির ভূমিকাও গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু সেখানে সক্রিয়তা নেই।

সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাষ্ট্রের। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওপর। কিন্তু তারা সারা বছর কাজ না করে মৌসুমে কিছু ‘দেখানো কার্যক্রম’ করে। কিছু ফগার মেশিন চালায়, কিছু ওষুধ ছিটায়, যেন দায় এড়ানো যায়। এই ‘আইওয়াশ’ সংস্কৃতিই ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ ব্যর্থতার মূল কারণ।

ওষুধের কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হয় না, মশা রেজিস্ট্যান্ট (প্রতিরোধী) হয়ে গেছে কি না, তাও যাচাই হয় না। এর পেছনে একটি ওষুধ আমদানির সিন্ডিকেট কাজ করে, ফলে সময়মতো কার্যকর ওষুধ আনা সম্ভব হয় না।

dhakapost
করোনার মতো অগ্রাধিকার না দিলে ডেঙ্গু মোকাবিলা অসম্ভব। কেন কলকাতার মতো আমরা সফল নই— প্রশ্ন ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদের / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্ট : আপনি বললেন, এটি কেবল স্বাস্থ্য সংকট নয়। অর্থনৈতিক দিক থেকে এর প্রভাব কতটা?

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : ব্যাপক। ডেঙ্গু আসলে জাতীয় অর্থনীতির ওপর সরাসরি বোঝা তৈরি করছে। যারা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের বড় অংশই তরুণ ও উৎপাদনশীল বয়সী। অর্থাৎ তারা কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, যাদের রাষ্ট্রীয় উৎপাদনে অবদান রাখার কথা। তাদের মৃত্যু মানে উৎপাদনশীলতার ক্ষতি, যা অর্থনীতিতে এক বিশাল শূন্যতা তৈরি করে।

এছাড়া, চিকিৎসা ব্যয়ও বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালে খরচ পাঁচ থেকে ১২ হাজার টাকার মধ্যে হলেও বেসরকারি হাসপাতালে ২০ থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্ত গড় খরচ হয়। উচ্চমানের হাসপাতালে খরচ লাখ টাকারও বেশি। এগুলো চার–পাঁচ বছর আগের হিসাব। বর্তমান বাস্তবতায় ব্যয় আরও বেড়েছে। এর বাইরে আছে অ্যাম্বুলেন্স সিন্ডিকেট। সবমিলিয়ে একটি পরিবারের জন্য এটি বড় আর্থিক ধাক্কা।

 

ঢাকা পোস্ট : এডিস মশা কি এখন কীটনাশকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে?

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : অনেকটা তা-ই মনে হচ্ছে। আমরা জানি না ওষুধগুলো আসলেই কার্যকর কি না। কারণ, তা পরীক্ষার কোনো নিয়মিত ব্যবস্থা নেই। কার্যকর ওষুধ আনা বা কম কার্যকর ওষুধ বাদ দেওয়ার প্রক্রিয়া দীর্ঘসূত্রতার শিকার হয়।

সমাধান হলো— লার্ভা অবস্থায় মশা ধ্বংস করা। এজন্য লার্ভিসাইড ও অ্যাডাল্টিসাইড— দুই স্তরে কাজ করতে হবে। উপযুক্ত সময় ও পদ্ধতিতে লার্ভা ধ্বংস করা গেলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। বিশেষজ্ঞরা সরকারকে এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন, নীতিমালাও আছে; কিন্তু বাস্তবায়ন হয় না।

dhakapost
ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিটি কর্পোরেশনের 'আইওয়াশ সংস্কৃতি': অধ্যাপক হামিদের মতে, এটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোর দুর্বলতা / ছবি- ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্ট : প্রতি বছর ডেঙ্গু বাড়ছে কেন?

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : দুটি প্রধান কারণ— জলবায়ু পরিবর্তন ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটি। বৃষ্টিপাত বেড়েছে এবং থেমে থেমে হচ্ছে, এতে শহরে স্থায়ী পানি জমে থাকে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও নালা-নর্দমার অব্যবস্থাপনা মশার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করছে।

দ্বিতীয়ত, সচেতনতার অভাব। আমরা যেখানে-সেখানে আবর্জনা ফেলি, পলিথিন জমাই, প্লাস্টিকের বোতলে পানি জমে থাকে। পাশের বাসায় কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলেও নিজেদের বিপদ মনে করি না। এটাই আমাদের বড় মানসিক দূরত্ব।

কমিউনিটি উদ্যোগও দুর্বল। অনেক বিল্ডিংয়ের নিচে পানি জমে থাকে, কিন্তু কেউ খোঁজ নেয় না। যেন বিপদ না আসা পর্যন্ত আমরা নড়ি না।

dhakapost
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গু এখন আর মৌসুমি আতঙ্কে সীমাবদ্ধ নয়, বরং প্রতি বছর ঘুরে আসা এক ভয়াবহ স্বাস্থ্য-সংকটে রূপ নিয়েছে / ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্ট : সরকারের ভূমিকা আপনি কীভাবে দেখছেন?

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত সরকারেরই। রাষ্ট্র যদি করোনা মহামারির মতো ডেঙ্গুকেও ‘এক নম্বর অগ্রাধিকার’ হিসেবে নেয়, তাহলে নিয়ন্ত্রণ সম্ভব। কিন্তু আমরা দেখি, সরকারের কেউ ডেঙ্গু নিয়ে জোরালোভাবে কথা বলছেন না।

হাসপাতালগুলো উপচে পড়ছে। রোগীদের আলাদা মশারি দেওয়ার বাজেট নেই। এ অবস্থায় সরকারের করণীয় ছিল দুটি পদক্ষেপ- এক. জরুরি তহবিল, যাতে হাসপাতালগুলো দ্রুত প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কিনতে পারে। দুই. নমনীয় ব্যয় কাঠামো, নির্দিষ্ট বাজেট আইটেমের টাকা প্রয়োজনে অন্য খাতে ব্যয় করার অনুমতি থাকা উচিত। নিয়ম-কানুনের জটিলতা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

 
dhakapost
চলতি বছরে এক দিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু দেখল ২১ সেপ্টেম্বর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এদিন ডেঙ্গু আক্রান্ত ১২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সর্বোচ্চ ৫ জনের মৃত্যু হয়েছে বরিশাল বিভাগে / ঢাকা পোস্ট

ঢাকা পোস্ট : আপনার দৃষ্টিতে এখন করণীয় কী?

ড. সৈয়দ আব্দুল হামিদ : ব্যক্তি, পরিবার, কমিউনিটি, স্থানীয় সরকার ও রাষ্ট্র— সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। স্কুল-কলেজে প্রচারণা বাড়াতে হবে। বাচ্চারা বাড়ি গিয়ে বাবা-মাকে বলবে, ‘পানির পাত্র ঢেকে রাখ’। তখন বাস্তব পরিবর্তন আসবে।

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সরকার যদি এটিকে জাতীয় অগ্রাধিকারের পর্যায়ে নেয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো নড়েচড়ে বসবে। পাশের কলকাতাকে দেখুন, আমাদের মতো আবহাওয়া ও সংস্কৃতি থাকা সত্ত্বেও তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সফল। কারণ, তারা সারা বছর ধরে পরিকল্পিতভাবে কাজ করে। শুধু মৌসুমে নয়। আর আমরা? মৌসুম এলেই কিছু ফগার চালিয়ে দায় সারি। এভাবে ডেঙ্গু মোকাবিলা অসম্ভব।

ডেঙ্গু আজ বাংলাদেশের জন্য শুধু স্বাস্থ্য সমস্যা নয়, বরং রাষ্ট্রের দীর্ঘস্থায়ী অদক্ষতার প্রতীক। যেহেতু আক্রান্ত ও মৃতদের বড় অংশ তরুণ ও কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী, তাই এটি ভবিষ্যৎ উৎপাদনশীলতার ওপর সরাসরি আঘাত। ডেঙ্গু এখন কেবল এক মৌসুমি রোগ নয়, এটি আমাদের অর্থনীতি, সমাজ ও নীতিনির্ধারণের ব্যর্থতার আয়না।