Image description

জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নে গণঅভ্যুত্থানের ক্ষমতাবলে আদেশ জারির সুপারিশ করতে ঐকমত্য কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছে বিশেষজ্ঞ প্যানেল। সনদ নয়, গণভোট হবে আদেশের ওপর। নাগরিকরা ‘হ্যাঁ-না’ ভোটের মাধ্যমে জানাবেন তারা এই আদেশ অনুমোদন করেন কিনা? গণভোটে আদেশ অনুমোদিত হলে জুলাই সনদ এবং অন্তর্বর্তী সরকারের গঠনও আইনি বৈধতা পাবে। 

গতকাল রোববার জাতীয় সংসদে অনুষ্ঠিত বৈঠকে ঐকমত্য কমিশনের বিশেষজ্ঞরা এ পরামর্শ দিয়েছেন। বৈঠক সূত্র জানিয়েছে, আদেশের প্রাক-খসড়া করা হয়েছে। আগামী দুই-তিন দিনের মধ্যে খসড়াটি চূড়ান্ত করা হবে। প্রাক-খসড়ায় বলা হয়েছে, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের সার্বভৌম কর্তৃত্বের প্রয়োগ ঘটেছে। এই কর্তৃত্ববলে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে। জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায় অনুযায়ী এ সরকার জুলাই সনদ বাস্তবায়নে আদেশ জারি করবে। আদেশের নাম এখনও চূড়ান্ত হয়নি। প্রাক-খসড়ায় একে ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন আদেশ-২০২৫’ বলা হয়েছে। 

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, ১৭ অক্টোবর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদের উল্লেখ থাকবে আদেশে। অর্থাৎ, আদেশ সনদের অংশ হবে না। সনদ হবে আদেশের অংশ। আদেশে থাকবে গণভোট আয়োজনের বিধান। এ বিধান অনুযায়ী গণভোট আয়োজন করা হবে। গণভোটে আদেশ অনুমোদিত হলে সনদ অনুমোদিত বলে গণ্য হবে। সনদে থাকা সংস্কার অনুযায়ী সংবিধান সংশোধন করা বাধ্যতামূলক হবে আগামী সংসদের জন্য। 

কমিশনে সমন্বয়কের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সমকালকে বলেন, বিশেষজ্ঞদের আগের পরামর্শগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আদেশে কী কী থাকতে পারে, এসব নিয়েও কথা হয়েছে। তবে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি। কমিশন সোম বা মঙ্গলবার আবার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে বৈঠক করবে। এরপর বলা যাবে কবে নাগাদ সরকারকে সুপারিশ করা সম্ভব হবে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর স্বাক্ষরিত জুলাই সনদে সংস্কারের ৮৪টি সিদ্ধান্ত রয়েছে। পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯টি মৌলিক সংস্কারে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট (ভিন্নমত) রয়েছে। দলটি জানিয়েছে, যেসব সংস্কারে ভিন্নমত রয়েছে, ক্ষমতায় গেলে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে না। বিএনপির দাবিতে সনদে যুক্ত করা হয়েছে, কোনো দলের যেসব সংস্কারে ভিন্নমত রয়েছে, তা নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করতে পারবে। নির্বাচনে জয়ী হলে তা অনুযায়ী সংস্কার করতে পারবে। জামায়াত, এনসিপিসহ কয়েকটি দলের দাবি গণভোটে পুরো সনদ দিতে হবে। নোট অব ডিসেন্ট গণ্য করা যাবে না। গণভোটে অনুমোদন পেলে, সনদ অনুযায়ী সংবিধান সংস্কার করতে হবে। 

রোববারের বৈঠকে নোট অব ডিসেন্ট নিয়েও আলোচনা হয়েছে। বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন সদস্য সমকালকে বলেছেন, তাই আগে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল, গণভোটে দুটি প্রশ্ন রাখা হবে। একটি হবে যেসব সংস্কারে সব দলের ঐকমত্য রয়েছে, সেগুলো  জনগণ অনুমোদন করে কিনা? আরেকটি প্রশ্ন হবে, যেসব সংস্কারের নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে, সেগুলোতে অনুমোদন করে কিনা? তবে বর্তমান বাস্তবতায় মনে হচ্ছে, নোট অব ডিসেন্টসহ গণভোট সম্ভব নয়। নোট অব ডিসেন্ট রেখে কার্যত বড় ধরনের সংস্কার সম্ভব নয়। এই জটিলতা এড়াতে সনদের পরিবর্তে আদেশের বিষয়ে গণভোট হবে। জনগণ যদি এই আদেশকে অনুমোদন করে, তবে আদেশে উল্লেখিত সনদ এবং অন্যান্য সব বিধান অনুমোদিত বলে গণ্য হবে। আগামী সংসদ সেভাবেই সংবিধান সংস্কার করবে।   

জুলাই সনদ স্বাক্ষরিত হলেও এর বাস্তবায়ন পদ্ধতি এখনও চূড়ান্ত নয়। ঐকমত্য কমিশন জানিয়েছে, আগামী ৩১ অক্টোবর কমিশনের মেয়াদপূর্তির অন্তত সপ্তাহখানেক সরকারকে এ-সংক্রান্ত সুপারিশ করা হবে। সুপারিশে থাকবে, আদেশ জারির পদ্ধতি কী হতে পারে, গণভোট কবে হবে। সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।  

গণভোটের মাধ্যমে সনদ বাস্তবায়নে রাজনৈতিক দলগুলো একমত। তবে গণভোট কবে হবে– এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। বিএনপি ও সমমনা দলগুলো চায়, নির্বাচনের দিনে গণভোট হবে। জামায়াতে ইসলামী, এনসিপি, ইসলামী আন্দোলসহ কয়েকটি দল নির্বাচনের আগে গণভোট চায়। বিএনপি আদেশ জারির বিরুদ্ধে। দলটির অবস্থান, বিদ্যমান আইনে হবে গণভোট। জামায়াত, এনসিপি আদেশের মাধ্যমে সনদের আইনি ভিত্তি চাচ্ছে। 

কমিশন সূত্র জানিয়েছে, এনসিপির নতুন দাবি– আওয়ামী লীগ মনোনীত রাষ্ট্রপতি নয়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান আদেশ জারি করবেন। গতকাল বিশেষজ্ঞদের বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে সরকার আদেশ জারি করতে পারে– এমন নজির পাওয়া যায়নি। তবে অভ্যুত্থানে জনগণের কর্তৃত্ববলে গঠিত সরকার আদেশ জারি করতে পারে– এমন মত দিয়েছেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞ।  

কমিশন কার্যালয়ের সভাকক্ষে বৈঠকে অংশ নেন বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন অনুষদের ডিন মোহাম্মদ ইকরামুল হক, সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ড. শরিফ ভূঁইয়া, ব্যারিস্টার ইমরান সিদ্দিক ও ব্যারিস্টার তানিম হোসেইন শাওন। ভার্চুয়ালি অংশ নেন আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন ও অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি মঈনুল ইসলাম চৌধুরী।

কমিশনের পক্ষে অংশ নেন সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, সদস্য ড. বদিউল আলম মজুমদার, বিচারপতি মো. এমদাদুল হক, ড. ইফতেখারুজ্জামান ও ড. মো. আইয়ুব মিয়া।