
বৈশ্বিক অঙ্গনে দিনদিন তলানিতে নামছে বাংলাদেশের পাসপোর্টের মান। চলতি বছরের পাসপোর্ট সূচকে ১০৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম। যেখানে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে বাংলাদেশ। এদিকে ভিসা ছাড়া ভ্রমণের সুযোগও কমে আসছে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের। গত এক বছরে এই সুবিধা বন্ধ করেছে চার দেশ। এ ছাড়াও বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীদের ভিসা দিতে নানা শর্ত ও জটিলতা বাড়াচ্ছে বিভিন্ন দেশ। এতে বাড়ছে ভিসা প্রত্যাখ্যানের হার। বিশ্লেষকরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে চাকরি, উচ্চশিক্ষা কিংবা উন্নত চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রা কঠিন হয়ে পড়বে।
এ বিষয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের পাসপোর্টের মান যে পর্যায়ে নেমেছে, সেটি লজ্জার। কেন এ লজ্জাজনক পরিস্থিতিতে আমরা পড়লাম তা দৃশ্যমান। পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা কোনো দেশের আকার কিংবা অর্থনীতির বিচারে হয় না। এটি নির্ধারিত হয় সে দেশের মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা ও আস্থার ভিত্তিতে। বাংলাদেশিরা বিদেশ যাওয়ার জন্য নানা জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। বিদেশযাত্রার ক্ষেত্রে মিথ্যাচার হলে সে দেশের মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হেনলি অ্যান্ড পার্টনার্স বৈশ্বিক পাসপোর্ট সূচক-২০২৫ অনুযায়ী, তালিকায় থাকা ১০৬ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১০০তম। বাংলাদেশের সঙ্গে একই অবস্থানে রয়েছে নানা নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত উত্তর কোরিয়া। ২০২৪ সালের শুরুতে এ সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৯৭তম। বর্তমানে বাংলাদেশি পাসপোর্টধারীরা ভিসা ছাড়া ৩৮টি দেশে ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন। অথচ এক বছর আগেও এই সংখ্যা ছিল ৪২। অন্যদিকে হেনলি সূচকে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ অবস্থান ছিল ৬৮তম।
২০০৬ সালে এই অবস্থানে ছিল বাংলাদেশের পাসপোর্ট। এদিকে পাসপোর্ট সূচকে প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় অনেক পিছিয়ে আছে বাংলাদেশ। কয়েক বছর ধরে গৃহযুদ্ধে জর্জরিত মিয়ানমারের অবস্থান ৯৬তম। দক্ষিণ এশিয়ার ক্ষুদ্র দেশ ভুটানের অবস্থান ৯২তম, ভারত ৮৫তম, শ্রীলঙ্কা ৯৮তম ও মালদ্বীপ ৯৮তম। পাশাপাশি এশিয়ার সমজাতীয় ও প্রতিযোগী অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায়ও পিছিয়ে বাংলাদেশ। পাসপোর্ট সূচকে মালয়েশিয়া ১২তম, থাইল্যান্ড ৬৬তম, ইন্দোনেশিয়া ৭০তম, ফিলিপাইন ৭৯তম, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়া ৯২তম অবস্থানে রয়েছে। কয়েক বছর আগেও ভিয়েতনাম কিংবা ইন্দোনেশিয়ায় যেতে বাংলাদেশিদের কোনো ভিসার প্রয়োজন হতো না। তবে চলতি বছরের জানুয়ারিতে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ইস্যু বন্ধ করে দেয় ভিয়েতনাম। এর কারণ হিসেবে জানা গেছে, পর্যটক হিসেবে ঘুরতে গিয়ে আর দেশে ফিরে না আসা, কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে অবৈধ পথে ভিন্ন গন্তব্যে পাড়ি জমানো এবং ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ছোটখাটো কাজে যুক্ত হয়ে অবৈধভাবে অবস্থান করা। একই কারণে বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা অনুমোদনে নানা শর্ত ও জটিলতা বাড়িয়েছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়া। সম্প্রতি এই তিন দেশে অনেক ভিসা আবেদন প্রত্যাখ্যাত হচ্ছে। দেড় বছর আগে বাংলাদেশিদের জন্য উজবেকিস্তানের ই ভিসা সহজলভ্য ছিল। বর্তমানে সেটি পুরোপুরি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
বর্তমানে উজবেকিস্তানের ভিসা পোর্টালে বাংলাদেশিদের আবেদন করারই সুযোগ নেই। বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশ যাওয়ার জন্য অনেকেই প্রতারণা ও জালিয়াতির আশ্রয় নিচ্ছেন। পাশাপাশি বিদেশে গিয়ে নানা অনিয়ম ও অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন বাংলাদেশিরা। এর ফলে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের বিশ্বাসযোগ্যতা কমে আসছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের ভাবমূর্তি ও পাসপোর্টের গ্রহণযোগ্যতা আরও খারাপ হবে। এর ফলে কঠিন হয়ে পড়বে চাকরি কিংবা উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তরুণদের বিদেশযাত্রা। উন্নত চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশিদের বিদেশযাত্রাও বন্ধ হয়ে যাবে।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আমাদের সামাজিক ও নাগরিক মূল্যবোধ বাড়াতে হবে।