Image description

রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের একটি বাসা থেকে স্বর্ণময়ী বিশ্বাস (২৮) নামে এক তরুণীর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। তিনি অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘ঢাকা স্ট্রিম’-এর গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জানা গেছে, স্বর্ণময়ী সম্প্রতি সহকর্মী কবি ও সাংবাদিক আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে যৌন হয়রানির লিখিত অভিযোগ করেছিলেন। সহকর্মীদের অনেকে ধারণা করছেন, অভিযোগের বিচার না পেয়ে মানসিক আঘাত ও ক্ষোভ থেকেই স্বর্ণময়ী আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন। এ ঘটনায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।

স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়। তিনি গার্হস্থ্য অর্থনীতি কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করেছেন। এক বছর আগে ঢাকা স্ট্রিমে যোগদান করেন তিনি। স্বর্ণময়ী তার বাবা সত্যজিৎ বিশ্বাস, মা রোমা রানি বিশ্বাস ও ভাইয়ের সঙ্গে ঢাকায় থাকতেন।

স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের বড় ভাই সৌরভ বিশ্বাস দ্য ডেইলি ক্যম্পাসকে বলেন, তার বোন ঘড়ের ভেতর থেকে লক করে অবস্থান করছিল। দীর্ঘ সময় দরজা বন্ধ থাকায় তাকে খুলতে বললেও কোন সাড়া পাওয়া যায়নি। বাসায় থাকা চাবি দিয়ে দরজা খুলে দেখতে পাই, সে ফ্যানের সঙ্গে ঝুলে আছে। আমি, আমার বাবা ও ভাবি মিলে তাকে উদ্ধার করে পপুলার হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।

ঘটনার তদন্ত কর্মকর্তা শেরেবাংলা নগর থানার এসআই সাইফুল ইসলাম দ্য ডেইলি ক্যম্পাসকে বলেন, পরিবারের পক্ষ থেকে এখনও মামলা দায়ের করা হয়নি। আমরা সংবাদ পেয়ে পপুলার হাসপাতাল থেকে মৃতদেহের সুরতহাল করে ময়নাতদন্তের জন্য সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল মর্গে পাঠিয়েছি। ময়নাতদন্ত শেষে মামলা দায়ের করা হবে। 

এ ঘটনার সুরতহাল প্রতিবেদক এসআই অমিত চাকমা দ্য ডেইলি ক্যম্পাসকে বলেণ, ‘মৃতের বিভিন্ন নমুনা পরীক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছে। শরীরের দুই হাতে ছুরি বা ব্লেড দিয়ে কাটা একাধিক দাগ রয়েছে। তার গলায়ও কালো দাগ আছে।’

সহকর্মীদের কাছ থেকে জানা গেছে, সম্প্রতি কর্মক্ষেত্রে সহকর্মী আলতাফ শাহনেওয়াজের দ্বারা যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে অনলাইনটির সম্পাদতক ইফতেখার মাহমুদের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন তিনি। আলতাফ শাহনেওয়াজ শুধু স্বর্ণময়ী বিশ্বাস নন, একই প্রতিষ্ঠানের আরও একাধিক নারীকে হয়রানি করেছিলেন। লিখিত আবেদনপত্রে প্রমাণ হিসেবে স্বাক্ষর করেছিলেন তার আরও ২১ জন সহকর্মী।

জানা গেছে, স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে তদন্ত কমিটি গঠন করেছিল ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষ। তবে অভিযুক্তকে শাস্তি না দিয়ে পুনর্বহাল করেন গণমাধ্যমটির প্রধান সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ। বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি স্বর্ণময়ী। পরে গলায় ফাঁস দেন তিনি।

অভিযোগপত্র বলা হয়েছে, ‘সশ্রদ্ধ সম্মান ও বিনীতভাবে জানাচ্ছি যে, আমরা আপনার প্রতিষ্ঠানের নারী সহকর্মীরা কর্মস্থলে এক ব্যক্তির অনুপযুক্ত আচরণের বিষয়ে অভিযোগ জানাতে চাই। আলতাফ শাহনেওয়াজ নামের ওই ব্যক্তির বিরুদ্ধে আমাদের অভিযোগগুলো নিচে দেওয়া হলো।’

অভিযোগপত্রে আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ওই অভিযোগপত্রে ৯ ধরনের অভিযোগ আনা হয়। সেসব হলো: ১. নারী সহকর্মীদের প্রতি অনুপযুক্ত দেহভঙ্গি প্রদর্শন; ২. নারী সহকর্মীদের উদ্দেশে অশোভন ভাষা ব্যবহার; ৩. ফ্লার্ট বা অনুচিত রোমান্টিক আচরণ; ৪. সহকর্মীদের হেনস্তা বা চাকরিচ্যুতির ভয় দেখানো; ৫. নারী সহকর্মীদের ব্যক্তিগত জীবন (যৌন ইতিহাস) সম্পর্কে প্রশ্ন করা; ৬. অযৌক্তিক কারণে গভীর রাতে ফোন করা ও ফেসবুকে-মোবাইলে মেসেজ পাঠানো; ৭. সহকর্মীদের নিয়ে অরুচিকর মন্তব্য করা; ৮. নির্দিষ্ট কারণ ছাড়াই নিউজরুমে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা; ৯. প্রোফাইলিং বা পক্ষপাতমূলক আচরণ করা।

অভিযোগপত্রে আরও লেখা হয়েছে, ‘আমরা আশা করি, আপনার প্রতিষ্ঠান এই অভিযোগগুলোকে যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নেবে এবং কর্মক্ষেত্রে আমাদের মানসিক নিরাপত্তা ও মর্যাদা নিশ্চিত করবে।’

আলতাফ শাহনেওয়াজ গণমাধ্যমটির বাংলা বিভাগের প্রধান। এর আগে তিনি দৈনিক প্রথম আলোর সাহিত্য সম্পাদক ছিলেন। কবি ও সাংবাদিক হিসেবে তার বেশ পরিচয়-খ্যাতি আছে। এ বিষয়ে জানতে আলতাফ শাহনেওয়াজকে একাধিকবার ফোন করা হয়। পরে ফোন করেন তার স্ত্রী ফাতেমা আবেদীন নাজলা। তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে এখন সে (আলতাফ শাহনেওয়াজ) কোনো কথা বলবে না।’

স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের সহকর্মীরা অভিযোগ করেন, গণমাধ্যমটির প্রধান সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ তদন্ত কমিটি গঠন করেছিলেন। তবে তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে তিনি কোনো ব্যবস্থাও নেননি। এ বিষয়টি মেনে নিতে পারেননি স্বর্ণময়ী। পরে গলায় ফাঁস দেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে অনলাইনটির  প্রধান সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদকে ফোন করা হয়। তিনি ফোন রিসিভ করে এ বিষয়ে কিছু বলতে অস্বীকার করেন। তবে তিনি তার প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে একটি লিখিত বিবৃতি পাঠান।

স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যার ঘটনায় প্ররোচণার অভিযোগে আলতাফ শাহনেওয়াজকে বিচারের আওতায় আনার দাবি উঠেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে বিষয়টিকে ঘিরে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে অসংখ্য মানুষ, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করেছেন। 

নাম প্রকাশ না করার শর্তে অনলাইন নিউজপোর্টাল ঢাকা স্ট্রিমের একজন সাংবাদিক বলেন, ‘আলতাফ শাহনেওয়াজ ও স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের বাড়ি একই জেলায়, ঝিনাইদহে। তাদের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। তবে শেষ দিকে সম্পর্ক খুব খারাপ হয়ে যায়।’

ঢাকা স্ট্রিমের সাংবাদিক এহ্সান ইসলাম ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, ‘ঢাকা স্ট্রিম আরও বহু দিন সংবাদ জগতে সৌন্দর্য ছড়াবে হয়তো। তবে সেখানে আজকের কতজন থাকতে পারবেন, সুষ্ঠু পরিবেশে কাজ করতে পারবেন, কে জানে। তবু স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের নাম প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে যেভাবে জড়িয়ে গেল, তা আর আলাদা হওয়ার সুযোগ থাকল না। প্রতিষ্ঠান কর্মী বদলাবে, কর্মীরা প্রতিষ্ঠান। পাশের সহকর্মী বদলাবে, সম্পর্কের উত্থান-পতন হবে। কিন্তু স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের এমন অকাল প্রয়াণ মেনে নেওয়া যায় না।’

এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার চেয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাসে অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের লিখেছেন,  ‘স্বর্ণময়ী বিশ্বাস ঢাকা স্ট্রিমের বাংলা বিভাগ প্রধান আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে লিখিতভাবে যৌননিপীড়নের অভিযোগ করেছিলেন। স্বর্ণময়ীর সহকর্মীদের অভিযোগ, অভিযুক্ত যৌননিপীড়ককে শাস্তি দেওয়ার পরিবর্তে সংবাদমাধ্যমটির প্রধান সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ তাকে পুনর্বহাল করেছেন, যা মেনে নিতে পারেননি স্বর্ণময়ী। উল্লেখ্য, আলতাফ শাহনেওয়াজ ও ইফতেখার মাহমুদ দুজনেই সম্প্রতি দৈনিক প্রথম আলো থেকে বেরিয়ে ঢাকা স্ট্রিমের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।’

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লেখক ও গবেষক শারফিন শাহ লিখেছেন, ‘স্বর্ণময়ী বিশ্বাস আত্মহত্যার কিছুদিন আগে ঢাকাস্ট্রিমের বাংলা বিভাগের প্রধান আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে করা অভিযোগপত্রে ২১জন স্বাক্ষরকারীদের একজন ছিলেন তিনি। ওই অভিযোগপত্রে আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে ‘অপেশাদার আচরণ’-এর প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে। সহজ কথায় ‘যৌন নিপীড়ন’-এর অভিযোগ। কিন্তু তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে উল্টো দুজনের চাকরি খেয়েছেন ঢাকাস্ট্রিমের প্রধান সম্পাদক ইফতেখার মাহমুদ। স্বর্ণময়ীর আত্মহত্যা নিয়ে কেউ কথা বলবে না, অভিযোগেরও তদন্ত হবে না, কারণ যার বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, তিনি প্রভাবশালী। কিন্তু আজ আপনার বোন, বা প্রেমিকা যদি এরকম পরিস্থিতিতে পড়ে আপনি কি করবেন?’ 

স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃত্যুতে ঢাকা স্ট্রিমের বিবৃতি
 
স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের মৃত্যুর পর আজ রবিবার (১৯ অক্টোবর) ঢাকা স্ট্রিম গণমাধ্যমে একটি বিবৃতি পাঠিয়েছে। সেখানে লিখেছে, ‘গতকাল শনিবার (১৮ অক্টোবর) সন্ধ্যায় আমাদের সহকর্মী স্বর্ণময়ী বিশ্বাসের অকাল মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ঢাকা স্ট্রিম পরিবার গভীরভাবে শোকাহত। পুলিশ ইতোমধ্যে মরদেহের ময়নাতদন্তের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আমরা সামগ্রিক ঘটনার পূর্ণাঙ্গ তদন্ত দাবি করছি। ঢাকা স্ট্রিম এক্ষেত্রে পূর্ণ সহযোগিতা করবে।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘স্বর্ণময়ী বিশ্বাস ঢাকা স্ট্রিমের গ্রাফিক ডিজাইনার ছিলেন। কর্মপরিবেশে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আন্তরিক; সহকর্মী হিসেবে ছিলেন বন্ধুভাবাপন্ন। দক্ষতার সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন। এমন একজন সহকর্মী হারিয়ে আমরা যখন শোকে মুহ্যমান, তখন স্বর্ণময়ীর মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একধরনের প্রচারণা আমাদের চোখে পড়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জানানো যাচ্ছে, ঢাকা স্ট্রিমের বাংলা কনটেন্ট এডিটর আলতাফ শাহনেওয়াজের বিরুদ্ধে গত ১৩ জুলাই মানবসম্পদ বিভাগে ‘লজিং কমপ্লেইন্ট এগেইন্সট ইনঅ্যাপ্রোপ্রিয়েট বিহেভিয়ার ইন দ্য ওয়ার্কপ্লেস' শিরোনামে একটি অভিযোগপত্র জমা পড়ে।’

বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ‘অভিযোগ পাওয়ার পর তাৎক্ষণিকভাবে নিম্নোক্ত পদক্ষেপ নেওয়া হয়,  আলতাফ শাহনেওয়াজকে তাৎক্ষণিকভাবে বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহার করা হয়; এবং  অভিযোগ তদন্তে দুই সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত প্রতিবেদনে সহকর্মীদের সঙ্গে আলতাফ শাহনেওয়াজের কিছু ক্ষেত্রে অসৌজন্যমূলক আচরণের প্রমাণ পাওয়া যায়।’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘আলতাফ শাহনেওয়াজকে বার্তাকক্ষ থেকে প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হয়। ঢাকা স্ট্রিম কর্তৃপক্ষ কর্মীদের জন্য প্রতিষ্ঠানের একটি আচরণবিধি চূড়ান্ত করে। কর্তৃপক্ষের এসব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে অভিযোগকারীরা সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন। ঢাকা স্ট্রিমের পক্ষ থেকে গৃহীত ব্যবস্থাগুলো সম্পর্কে সব সহকর্মীকে অবহিত করা হয় এবং ভবিষ্যতে এই ধরনের আচরণ সম্পর্কে সহকর্মীদের আরও সতর্ক থাকার আহ্বান জানানো হয়।’