
গত কয়েক দিনে একের পর এক অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটেছে। কেপিআইভুক্তসহ জনবসতিপূর্ণ এলাকায় পাঁচ দিনে ঘটে এমন তিনটি ঘটনা। সর্বশেষ শনিবার ঢাকায় হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লাগে। এর আগে ঢাকার মিরপুর ও চট্টগ্রাম ইপিজেডের এক কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এসব কি নিছক কোনো দুর্ঘটনা না পরিকল্পিত নাশকতা? এ নিয়ে জনমনে শঙ্কা তৈরি হয়েছে। দুর্ঘটনা না নাশকতা, এর প্রকৃত কারণ খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা বলেন, বাংলাদেশে নাশকতামূলক আগুনের ঘটনা চিহ্নিত করার মতো ব্যবস্থাপনা নেই। এটা বড় ধরনের দুর্বলতা। এজন্য বড়-ছোট আগুনের সব ঘটনাকে দুর্ঘটনা হিসাবে চালিয়ে দেওয়া হয়। অবশ্যই নাশকতা চিহ্নিতের ব্যবস্থা থাকা জরুরি। তারা বলেন, খবরটি দ্রুত বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে, যা দেশের জন্য বড় নেতিবাচক বার্তা দেবে। এ কাজের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বাহিনীসহ সংশ্লিষ্টদের দ্রুততম সময়ে সব ব্যবস্থা মেরামত করে বিমানবন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক করার আহ্বান জানান তারা।
ঢাকার বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজসহ অন্যান্য অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নাশকতা বা অগ্নিসংযোগের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ পাওয়া গেলে সরকার তাৎক্ষণিক ও দৃঢ় পদক্ষেপ নেবে বলে জানিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের বিবৃতিতে একথা বলা হয়। এদিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। একই সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে বারবার আগুন লাগার ঘটনা জননিরাপত্তাব্যবস্থার দুর্বলতা ও শৃঙ্খলা জোরদারের প্রয়োজনীয়তার কথা স্পষ্ট করে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করেন তিনি। শনিবার সন্ধ্যায় ফেসবুকে ইংরেজিতে লেখা পোস্টে তিনি এ মন্তব্য করেন। বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিবৃতিতে বলেন, এসব অগ্নিকাণ্ড পূর্বপরিকল্পিত বলে জনগণ বিশ্বাস করে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, বাংলাদেশের অগ্নিনিরাপত্তায় দুর্বলতা আছে, এ কথা সত্য। এরপরও সাম্প্রতিক সময়ের আগুনের ঘটনাগুলো সন্দেহ তৈরি করছে। দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, রাজনৈতিক দলগুলোর অবস্থা, সংসদ নির্বাচন বানচালে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এসব করা হচ্ছে কি না, তাও খতিয়ে দেখতে হবে।
প্রসঙ্গত, ১৪ অক্টোবর রাজধানীর মিরপুরের রূপনগরে জনবসতিপূর্ণ এলাকার একটি পোশাক কারখানা ও রাসায়নিকের গুদামে ভয়াবহ আগুনের ঘটনা ঘটে। সেখানে মারা যান ১৬ জন। ঠিক দুদিন পর ১৬ অক্টোবর চট্টগ্রামের ইপিজেডের মতো নিরাপত্তা বেষ্টনীতে ৯তলা একটি কারখানার ভবন আগুনে পুড়ে যায়। এর দুদিন পর শনিবার হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুন লেগেছে। সেখানে বিদেশ থেকে আমদানি করা শত শত কোটি টাকার মালামাল পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পাঁচ দিনের মধ্যে তিনটি বড় আগুনের ঘটনা এবং এগুলোয় প্রাণহানিসহ সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় জনমনে সন্দেহ ঘুরপাক খাচ্ছে-এগুলো নাশকতা না দুর্ঘটনা। কিন্তু সুনির্দিষ্ট জবাব মিলছে না। ফলে গল্প-গুজব ডালপালা মেলছে চারদিকে।
এ প্রসঙ্গে অগ্নিনিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ এবং খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. মাকসুদ হেলালী যুগান্তরকে বলেন, নাশকতামূলক অগ্নিদুর্ঘটনা অসম্ভব কিছু না। তবে এটা বাংলাদেশে চিহ্নিত করার মতো ব্যবস্থাপনা নেই। এজন্য বড়-ছোট আগুনের সব ঘটনাকে দুর্ঘটনা হিসাবে চালিয়ে দেওয়া হয়। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে অগ্নিদুর্ঘটনার ৭৭ শতাংশই পরিকল্পিত। এর মধ্যে শিশুরা (১৬ বছর বয়স পর্যন্ত) ঘটায় ১৯ শতাংশ এবং অবশিষ্ট ৫৮ শতাংশ বড়রা পরিকল্পিতভাবে ঘটান। আর যুক্তরাজ্যে বছরে ৫৬ শতাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটানো হয়।
তিনি আরও জানান, পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোয় পরিকল্পিত অগ্নিদুর্ঘটনার চিত্র সাধারণ দুর্ঘটনার চেয়ে বেশি। কিন্তু বাংলাদেশে একেবারেই যে পরিকল্পিত দুর্ঘটনা ঘটছে না, তা বলার কোনো সুযোগ নেই। তবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে চিত্র কম। দেশে বছরে ২০ থেকে ২৫ হাজার অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যে অগ্নিদুর্ঘটনার চিত্র বাংলাদেশের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান যুগান্তরকে বলেন, বিমানবন্দর একটি কেপিআই এলাকা। এমন নিরাপত্তাবেষ্টনী এলাকায় এত বড় দুর্ঘটনা দুর্ভাগ্যজনক। এ ঘটনার খবর পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে। এ ঘটনাটি দেশের জন্য বড় নেতিবাচক বার্তা দেবে। এ কাজের সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন বাহিনীসহ অন্যদের দায়িত্ব হবে দ্রুততম সময়ে সব ব্যবস্থা ঠিক করে বিমানবন্দরের কার্যক্রম স্বাভাবিক করা।
তিনি জানান, শাহজালাল বিমানবন্দরের আগুনের ঘটনা এটি প্রথম নয়, এর আগেও দুবার এমন ঘটনা ঘটেছে। সে সময় ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে সুপারিশ দেওয়া হয়েছিল। সেসবের যথাযথ বাস্তবায়ন হলে এমন পরিস্থিতির হওয়ার কথা নয়। আর আগুনের ঘটনার পরপরই তা নিয়ন্ত্রণে নেওয়া দরকার ছিল, এটা না পারা বড় ধরনের ব্যর্থতা।
তিনি আরও জানান, বারবার অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটলেও প্রকৃত কারণ সরকার বুঝতে পারলেও তা প্রকাশ করে না। এটা প্রকাশ করে দিলে জনগণ বুঝতে পারবে এবং নাগরিক সমাজের চাপের মুখে পরিস্থিতির উন্নতি করতে সরকার চেষ্টা করবে। এসব ঘটনায় পরিকল্পিত নাশকতার সন্দেহের বিষয়টি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, বিশ্বের বড় বড় শহরেও অগ্নিদুর্ঘটনা ঘটে। তারা যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করে, বাংলাদেশ সেভাবে পারছে না, যা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার বড় দুর্বলতার কারণ। তবে অগ্নিদুর্ঘটনার সঙ্গে নাশকতার বিষয়গুলোও বারবার উঠে এসেছে। নিমতলী, চুড়িহাট্টা, বনানীর এফআর টাওয়ারের অগ্নিদুর্ঘটনা দুর্বলতার ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠেছে। পাশাপাশি প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বাংলাদেশ সচিবালয়, গুলশানের ডিএনসিসি কাঁচাবাজার, ফুলবাড়িয়া মার্কেটের আগুনের ঘটনা অগ্নিনির্বাপণের দুর্বলতার চেয়ে নাশকতার কথা বেশি আলোচনা হয়েছে। ফুলবাড়িয়া মার্কেটের আগুনের ঘটনায় সংক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীদের একটি অংশ সন্দেহভাজন কিছু মানুষের বিরুদ্ধে মামলাও দায়ের করেছেন। অন্য বড় ঘটনাগুলোর মতো শনিবার বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজে আগুনের পর নাশকতার বিষয়টি সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের বক্তব্য : এ বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা শাহজাহান সিকদার যুগান্তরকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ের অগ্নিদুর্ঘটনাগুলো পর্যালোচনায় পরিকল্পিত নাকশকতার কোনো প্রমাণ মেলেনি। শুষ্ক মৌসুম শুরু হওয়ায় অগ্নিদুর্ঘটনা বেড়েছে। এ সময় দাহ্য পদার্থের জ্বলে ওঠার প্রবণতা বাড়ে বলে এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। তিনি বলেন, বর্তমানে বিমানবন্দরের অগ্নিনিরাপত্তার দায়িত্ব ফায়ার সার্ভিসের নয়। ফলে তারা এখানে রুটিন পরিদর্শন বা মনিটরিংয়ের কাজ করেন না। তিনি বলেন, বিমানবন্দরের অগ্নিনিরাপত্তার দায়িত্ব সিভিল অ্যাভিয়েশন কর্তৃপক্ষের।