
‘আপনারও একই সমস্যা? অনলাইনে পাওয়া যায় না?’ গত বুধবার রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অঞ্চল-২ আঞ্চলিক কার্যালয়ে কথাগুলো বলছিলেন কয়েকজন। সন্তানের জন্মনিবন্ধনের জন্য আবেদনপত্র জমা দিতে কাউন্টারের সামনে লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তাঁরা।
ওই ব্যক্তিদের একজন রুহুল বারী ইউনুছ। ১০ বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন তিনি। শান্তিবাগের এই বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, এই কার্যালয় থেকে মেয়ের জন্মনিবন্ধন করিয়েছিলেন ২০২৩ সালে। এখন টাইফয়েডের টিকার জন্য নিবন্ধন করতে গিয়ে দেখেন, সেই জন্মনিবন্ধন অনলাইনে নেই। তাঁকে নতুন করে আবেদন করতে বলা হয়েছে। তাই মেয়েকে নিয়ে নতুন আবেদনপত্র জমা দিতে এসেছেন।
এ সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। তাই অকার্যকর এসব সনদকে বলা হচ্ছে, ‘মেয়র তাপসের সার্ভারের নিবন্ধন’।
এমন আরও অনেককে দেখা গেল, জন্মনিবন্ধন সনদ অনলাইনে দেখা যায় না বলেই তাঁরা নতুন আবেদন করতে এসেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেল, ২০২৩ সালের ৪ অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত দক্ষিণ সিটিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন করা ব্যক্তিদের কারও সনদ অনলাইনে দেখা যায় না। সেসব এখন অকার্যকর। আর এই সময়ে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন হয়েছিল ৭৯ হাজার, যার বেশির ভাগই হচ্ছে জন্মনিবন্ধন। এ সময়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র ছিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস। তাই অকার্যকর এসব সনদকে বলা হচ্ছে, ‘মেয়র তাপসের সার্ভারের নিবন্ধন’।
একবার নিবন্ধনের পরও আবার নতুন করে নিবন্ধনের ঝক্কিঝামেলা পোহাতে হচ্ছে বলে ক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীরা। ফলে ‘তাপস কি মাগনা জন্মনিবন্ধন করে দিয়েছেন?’ ভুক্তভোগীদের মধ্যে এমন মন্তব্য করেও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে।
আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, দক্ষিণ সিটিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্য ৫ আগস্টের পর কেন্দ্রীয় সিস্টেমে একীভূত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কারিগরি ত্রুটির কারণে সব তথ্য একীভূত করা যায়নি। তাই নতুন করে আবেদন করতে বলা হয়েছে। ভুক্তভোগীদের ক্ষোভ প্রকাশ করা স্বাভাবিক মন্তব্য করে তিনি আরও বলেন, কারণ এতে তাঁদের নতুন করে খরচ ও ভোগান্তি দুই–ই পোহাতে হচ্ছে।
ফলে ‘তাপস কি মাগনা জন্মনিবন্ধন করে দিয়েছেন?’ ভুক্তভোগীদের মধ্যে এমন মন্তব্য করেও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা যাচ্ছে।
যেভাবে ‘মেয়র তাপসের সার্ভার’
নিবন্ধনের ফির অর্থ নিজস্ব তহবিলে জমা হওয়ার দাবিতে তৎকালীন মেয়র তাপসের নির্দেশে ২০২৩ সালের জুন–জুলাই মাসে নিবন্ধন বন্ধ রাখে ডিএসসিসি। ওই বছর ৪ অক্টোবর নিজস্ব সিস্টেম (সার্ভার হিসেবে অধিক পরিচিত) দিয়ে নিবন্ধনের কাজ শুরু হয়। বিষয়টিকে আইনবহির্ভূত জানিয়ে কয়েক দফা চিঠি দেন তৎকালীন রেজিস্ট্রার জেনারেলরা। তবে এরপরও বিষয়টি আমলে না নিয়ে নিবন্ধন সনদ দিতে থাকে দক্ষিণ সিটি।
জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের আগেই দেশ ছাড়েন তাপস। ওই বছরের ১৪ আগস্ট স্থানীয় সরকার বিভাগ দক্ষিণ সিটির ওই পৃথক সিস্টেম বাতিল করে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্য কেন্দ্রীয়ভাবে যুক্ত করার নির্দেশ দেয়।
খিলগাঁও আঞ্চলিক কার্যালয়ের রেজিস্ট্রেশন সহকারী (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন) মো. সাজহার উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এর মধ্যে ছয় হাজার নিবন্ধন হয় খিলগাঁও কার্যালয়ে। গত এক বছরের বেশি সময়ে প্রায় চার হাজার তথ্য নতুন আবেদনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় সিস্টেমে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
দক্ষিণ সিটিতে জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধনের তথ্য ৫ আগস্টের পর কেন্দ্রীয় সিস্টেমে একীভূত করার চেষ্টা করা হয়েছিল। কারিগরি ত্রুটির কারণে সব তথ্য একীভূত করা যায়নি।আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম
গচ্চা প্রায় ৪০ লাখ টাকা
সন্তানকে টাইফয়েডের টিকা দেওয়ার জন্য জন্মসনদ নিতে গেলে আবার আবেদন করতে বলা হয় ইকরাম হোসেনকে। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘প্রতিবছর জন্মনিবন্ধন করা একজন নাগরিকের পক্ষে সম্ভব? এ কোন দেশে বাস করি? এমন হয়রানির শেষ কোথায়?’
ব্যাংক কর্মকর্তা ইকরাম হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, তাঁর স্ত্রী নোয়াখালী শহরে একটি হাইস্কুলের শিক্ষক। তাঁদের ৯ ও ৭ বছর বয়সী দুই মেয়ে সেখানে পড়ে। তাদের জন্ম ঢাকায়। এ বছর স্ত্রীর বদলি হয়ে ঢাকায় আসার কথা। নতুন বছর থেকে মেয়েদের ঢাকার স্কুলে ভর্তি করার জন্য ফরম তুলবেন। মেয়েদের টিকার জন্য জন্মনিবন্ধন তুলতে পারেননি। এখন স্কুলে ভর্তির আগেও নতুন নিবন্ধন হবে কি না, সে বিষয়েও চিন্তিত তিনি।
এখন পর্যন্ত দক্ষিণ সিটির ৪০ হাজার নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সমস্যা দূর হয়েছে। সেগুলো অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। বাকিগুলোর সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে।রেজিস্ট্রার জেনারেল (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন) মো. যাহিদ হোসেন
ভুক্তভোগীদের মতে, প্রতিটি নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ৫০ টাকা আবেদন ফি দিতে হয়। সেই হিসাবে ৭৯ হাজার আবেদনের জন্য আবেদনকারীরা দক্ষিণ সিটিকে দিয়েছিলেন ৩৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা। এটাকে নাগরিকের অর্থের বিপুল অপচয়ের পাশাপাশি ভোগান্তি বলে মনে করছেন তাঁরা।
নতুন আবেদনের ক্ষেত্রে আবার ফি নেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে রেজাউল করিম বলেন, ফির বিষয়টি সিস্টেমে যুক্ত। ফলে ফি না দিলে আবেদন করা যাচ্ছে না।
অকার্যকর নিবন্ধন নিয়ে ৫ অক্টোবর রেজিস্ট্রার জেনারেল (জন্ম ও মৃত্যুনিবন্ধন) মো. যাহিদ হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এখন পর্যন্ত দক্ষিণ সিটির ৪০ হাজার নিবন্ধনের ক্ষেত্রে সমস্যা দূর হয়েছে। সেগুলো অনলাইনে পাওয়া যাচ্ছে। বাকিগুলোর সমস্যা সমাধানে কাজ চলছে।