Image description
চট্টগ্রাম ইপিজেডের সেই কারখানার আগুন নিভলো ১৭ ঘণ্টা পর : ছিল না অগ্নিনিরাপত্তা সনদ : জীবন বাঁচলেও জীবিকা পুড়েছে সহস্রাধিক শ্রমিকের

চট্টগ্রাম রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চলে (সিইপিজেড) এলাকায় ভয়াবহ অগ্নিকা-ে পুড়ে যাওয়া কারখানা ভবনটির অগ্নিনিরাপত্তা সনদই ছিল না। আটতলা ওই কারখানা ভবনেই ছিল একাধিক গুদাম। রফতানিযোগ্য তৈরিপণ্য এবং রাসায়নিকসহ কাঁচামাল রাখার ক্ষেত্রেও মানা হয়নি নিরাপত্তা নির্দেশিকা। ভবনটির গা ঘেঁষে আরো দুুটি ভবন থাকায় আগুন নেভানোর কাজ সহজে করা যায়নি। মূলত এইসব কারণেই ভবনের আগুন নেভাতে দীর্ঘ সময় লেগেছে। তাছাড়া ভবনটি অরক্ষিত অবস্থায় বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুনের তীব্রতা বেড়েছে।

এই কারখানার মতো চট্টগ্রাম ইপিজেডসহ বন্দর নগরীর বেশিরভাগ ভবন এমনই ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন ফায়ার সার্ভিসসহ সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, বহুতল আবাসিক ভবন থেকে শুরু করে ছোট বড় কারখানা ভবন- কোথাও নেই অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা। ফলে নগরীর বেশিরভাগ ভবন এখন চরম অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা বলেন, যেখানে ইপিজেডের মতো একটি কেপিআইতে বিদেশি কারখানার অগ্নিঝুঁকি মোকাবেলায় এই বেহাল দশা সেখানে বাইরের কলকারখানা এবং আবাসিক ভবনের নিরাপত্তার কথা তো কল্পনাই করা যায় না।


এদিকে টানা ১৭ ঘণ্টার বেশি সময় পর গতকাল শুক্রবার সকালে চট্টগ্রাম ইপিজেডের ওই কারখানা ভবনের আগুন নিভেছে। আগুনে পুড়ে ভবনটির কয়েকটি তলার ছাদসহ বিরাট অংশ ধসে পড়ায় এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে। ভবনটিতে থাকা রফতানির জন্য তৈরি ১০ কনটেইনার সার্জিক্যাল গাউন ও গাউন তৈরির ২০ কনটেইনার কাঁচামাল ফেব্রিকস পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। পুড়ে গেছে শত শত কোটি টাকার মেশিনপত্র। কারখানায় কর্মরত এক হাজারের বেশি শ্রমিক কর্মচারী ও কর্মকর্তার জীবন বাঁচানো গেলেও পুড়ে গেছে তাদের জীবিকা। কর্মস্থল ধ্বংসস্তপে পরিনত হওয়ায় অসহায় শ্রমিক কর্মচারীদের আহাজারি চলছে। ঘটনা তদন্তে ফায়ার সার্ভিস ও বেপজা কর্তৃপক্ষের তরফে দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার বেলা দুইটার দিকে সিইপিজেডের ওই আটতলা ভবনে আগুন লাগে। ভবনের সাততলা থেকেই আগুনের সূত্রপাত। সেখানে অ্যাডামস ক্যাপস অ্যান্ড টেক্সটাইল লিমিটেড এবং জিহং মেডিকেল প্রোডাক্টস (বিডি) কোম্পানি লিমিটেড নামে দুটি কারখানার গুদাম ছিল। অ্যাডামস তোয়ালে, ক্যাপ এবং জিহং মেডিকেল সার্জিক্যাল গাউন তৈরির কারখানা। সাততলার গুদানে লাগা আগুন পরে পুরো ভবনে ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় সাড়ে ১৭ ঘণ্টা পর গতকাল সকাল ৭টা ২৫ মিনিটে আগুন নিয়ন্ত্রণে আসে। আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ার সার্ভিসের প্রায় ২৫টি ইউনিট এবং বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ৪টি ইউনিট কাজ করেছে। তাতে অংশ নেয় সেনাবাহিনী ও বিমানবাহিনীর সদস্যরা।

সকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, কারখানার পক্ষ থেকে ফায়ার সেফটি প্ল্যানের (অগ্নিনিরাপত্তা পরিকল্পনা) আবেদন করা হয়েছে কেবল। তবে নিয়ম অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে এখনো পরিদর্শন হয়নি। তার আগেই দুর্ঘটনা ঘটে গেছে। ভবনটিতে আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়েছে জানিয়ে লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় ভবনের দুই পাশ দিয়ে আগুন নেভানোর সুযোগ ছিল না। কারণ ভবনের পাশেই আরো দুটি ভবন আছে। অন্য দুই পাশ থেকে চেষ্টা করে আগুন নিয়ন্ত্রণ আনা হয়েছে।

নিয়ম অনুযায়ী, ভবনের আশপাশে যে নূন্যতম জায়গা রাখতে হয়, সেটি দুই দিকে ছিল না। ভবনের ভেতরে কারখানা এবং কাঁচামাল ও তৈরি পণ্যের গুদাম ছিল। সেই ক্ষেত্রেও যথাযথ নিয়ম মানা হয়নি। ভবনটিতে দাহ্য পদার্থ থাকায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা কঠিন হয়ে পড়ে জানিয়ে তিনি বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় আগুন নেভানো গেছে।

ভয়াবহ এই আগুনে কোন প্রাণ হানির ঘটনা নেই। ইপিজেড কর্তৃপক্ষের দ্রুত হস্তক্ষেপে এবং সেখানে কর্মরত সেনা সদস্যদের তড়িৎ ব্যবস্থার কারণে এক হাজারের বেশি শ্রমিক, কর্মকর্তা, কর্মচারীকে নিরাপদে সরিয়ে আনা গেছে। ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়া গেলেই আগুন লাগার প্রকৃত কারণ জানা যাবে। ইপিজেড কর্তৃপক্ষও একটি তদন্ত কমিটি করেছে বলে জানান, চট্টগ্রাম ইপিজেডের নির্বাহী পরিচালক আবদুস সোবহান। 

ধসে পড়েছে ছাদ দেওয়াল : টানা প্রায় ১৮ ঘণ্টার আগুনে ভবনটি এখন রীতিমতো ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়েছে। আগুন লাগার পর শুরুতে ভবনের দক্ষিণ পাশে আগুনের তীব্রতা ছিল বেশি। সন্ধ্যা সাতটার দিকে পশ্চিম ও উত্তর পাশেও ছড়িয়ে পড়ে আগুনের তীব্রতা। সাড়ে সাতটার দিকে ভবনের নিচের দিকে ছড়াতে থাকে আগুন। এরপর মুহূর্তেই পুরো ভবনে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। এতে ধসে পড়ে ভবনের কিছু দেয়াল ও ছাদ। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, আগুনের তীব্রতায় ভবনের পিলার দুর্বল হয়ে বেকে যায়। তাতে ভবনের ছাদ ধসে স্যান্ডউচের মতো পড়ে যায়।

রাত সাড়ে নয়টা নাগাদ পুড়ে অঙ্গার হয়ে যায় ভবনের একপাশ। এরপরও আগুনের তীব্রত কমেনি। এ সময় ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা পানি উৎস খুঁজতে মরিয়া হয়ে ওঠেন। আশপাশের বিভিন্ন কারখানায় অনুরোধ করা হয় রিজার্ভার থেকে পানি দেওয়ার জন্য।

একপর্যায়ে রাতে ভবনটির পাশে থাকা একই প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন আরেকটি তিনতলা ভবনের ছাদেও আগুন ছড়িয়ে পড়ে। উপায় না দেখে আশপাশের ভবনগুলোতে আগে থেকে পানি ছিটাতে থাকে ফায়ার সার্ভিস। রাত সাড়ে নয়টার দিকে বৃষ্টি শুরু হলে আগুনের নিয়ন্ত্রণের আশা দেখা দেয়। তবে বৃষ্টি কিছুটা কমলে আবারও তীব্রতা বাড়ে আগুনের। মুষলধারে বৃষ্টির পরও ভবনের থাকা রাসায়নিক ও দাহ্য পদার্থের কারণেআগুনের তীব্রতা ছিল বেশি। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানান, ভবনের আগুন যাতে অন্য ভবনের ছড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে সতর্ক ছিলেন তারা। বৃহস্পতিবার রাতে ইপিজেডের বেশির ভাগ কারখানা বন্ধ ঘোষণা করা হয়। 

দাহ্য পদার্থের কারণে আগুনের তীব্রতা : কী কারণে আগুন লেগেছে, সেটি নিশ্চিত নয় ফায়ার সার্ভিস। তবে ফায়ার সার্ভিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারখানার ভেতরে দাহ্য পদার্থ ছিল। এ ছাড়া সেখানে বিভিন্ন রাসায়নিকের গন্ধও পাওয়া গেছে। আর এই কারণেই আগুন নেভাতে বেশি সময় লেগেছে। আগুন লাগার পর ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের ভবনে দাহ্য পদার্থ থাকার বিষয়টি জানানো হয়নি। তাতে আরো বেশি সমস্যা হয়েছে। আগুনের তীব্রতায় ফায়ার কর্মীদের হাফিয়ে উঠতে হয়। তাদের অনেকে অসুস্থ্য হয়ে পড়েন। কারখানার শ্রমিকেরা জানান, মূলত কাপড় ধোয়ার ক্ষেত্রে কিছু রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। গুদামে ওই রাসায়নিক ছিল। পাশাপাশি সার্জিক্যাল গাউন ও মেডিকেলের এসব সামগ্রী তৈরি করা হয় সিনথেটিক ফেব্রিকস থেকে। এর সব কটিই দাহ্য। ভেতরে থাকা দাহ্য কাঁচামালের কথা স্বীকার করেন জিহং মেডিকেল প্রোডাক্টস (বিডি) কোম্পানি লিমিটেডের জ্যেষ্ঠ নির্বাহী বোরহান উদ্দিন তামিম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, ভেতরে রফতানির জন্য ১০ কনটেইনার তৈরি সার্জিক্যাল গাউন ছিল। এ ছাড়া গাউন তৈরির কাঁচামাল (ফব্রিকস) ছিল ২০ কনটেইনার। এগুলো কিছুটা দাহ্য। তাই আগুন ছড়িয়ে গেছে। ফায়াস সার্ভিসের একজন কর্মকর্তা জানান, রাসায়নিকের কারণে আগুন নেভাতে বেশি সময় লেগেছে। মূলত ভবনের সবকিছু পুড়ে শেষ হওয়ার পর আগুন নিভেছে। সীতাকু-ের বিএম কনটেইনার ডিপোতেও আগুন নেভাতে তিন থেকে চারদিন সময় লাগে। সেখানেও বিপুল রাসায়নিক ছিল।

শ্রমিকদের আহাজারি : ওই ভবনের দুটি কারখানায় হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করতেন। আগুন লাগার পর তাদের নিরাপদে সরিয়ে নেয়া হয়। তাতে তাদের জীবন রক্ষা পায়। এ জন্য তারা কারখানা কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ জানান। তবে কারখানার সাথে তাদের জীবিকাও পুড়ে গেছে। কারখানাটি ধ্বংস হয়ে গেছে। ভবনটিও এখন পরিত্যক্ত। শ্রমিকরা বলছেন, কবে কারখানা চালু হবে, তারা কবে কাজ পাবেন সেটি অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। তারা এখন চোখে অন্ধকার দেখছেন। জসিম উদ্দিন নামে একজন শ্রমিক জানান, কারখানার ইন্স্যুরেন্স আছে। মালিক পক্ষ ক্ষতিপূরণ পাবে। কিন্তু আমাদের কি হবে। কাজ নেই, বেতন কেন দেবে। পরিবার পরিজন নিয়ে কোথায় যাবেন সেই চিন্তায় অস্থির তিনি। তবে ইপিজেড কর্তৃপক্ষ বলছে, কারখানার শ্রমিকদের বেতনসহ পাওনা আদায় করে দেয়া হবে। তাছাড়া কারখানা চালুর ব্যাপারেও সব ধরনের সহযোগিতা দেয়া হবে।