
বাংলাদেশের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। গত ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাস্তবায়ন হয়েছে সর্বকালের সর্বনিম্ন—মাত্র ৬৮ শতাংশেরও কম। চলতি অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেও খরচের গতি একই রকম। অন্তত পাঁচ মন্ত্রণালয় এখনও ব্যয় শুরুই করতে পারেনি। সরকারি খাতের পাশাপাশি বেসরকারি খাতেও বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি নেমে এসেছে ৭ শতাংশের নিচে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, গত অর্থবছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। অর্থনৈতিক স্থবিরতা কর্মসংস্থান কমিয়ে দিয়েছে। মজুরি বাড়েনি, অথচ মূল্যস্ফীতি মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির পূর্বাভাস কমিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আইএমএফ গত জুন মাসে ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রবৃদ্ধির হার ৫ দশমিক ৪ হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছিল। গত মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক প্রতিবেদন প্রকাশ করে সংস্থাটি বলেছে, অর্থবছর শেষে এই হার হবে ৪ দশমিক ৯।
ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাঠামোগত সংস্কার ও নীতি বাস্তবায়নের ধীরগতি এখনও বড় বাধা।
মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (এমসিসিআই) ও পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের (পিইবি) যৌথভাবে প্রকাশিত বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিবিএক্স) ২০২৪-২৫ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যবসায়িক পরিবেশের সামগ্রিক স্কোর সামান্য বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৯.৬৯ পয়েন্টে, যা আগের অর্থবছরে ছিল ৫৮.৭৫।
তবে প্রতিবেদনে স্পষ্ট বলা হয়, এই সামান্য বৃদ্ধি ব্যবসায়িক আস্থা ফেরানোর জন্য যথেষ্ট নয়। ব্যবসায়ীরা চলতি অর্থবছরের অবস্থা বর্ণনা করেছেন “কিছু বাধা রয়েছে”—যা এখনও “সহায়ক ব্যবসা পরিবেশ”-এর নিচে।
মোটা দাগে সামগ্রিক ব্যবসায়িক পরিবেশ এখনও নাজুক অবস্থায় রয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকারের কিছু নীতিগত পদক্ষেপ এবং ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে এর সমন্বয়ের কারণে গত অর্থবছরের স্কোরে খানিকটা উন্নতি হয়ে থাকতে পারে। তবে সংস্কারে ধীরগতি রয়েছে। এই গতি এখনও ব্যবসায়িক আস্থা পুনরুদ্ধারের জন্য যথেষ্ট নয়।
অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা প্রধান বাধা
বাংলাদেশ বিজনেস ক্লাইমেট ইনডেক্স (বিবিবিএক্স) ২০২৪-২৫ প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিনিয়োগ ও নীতিগত অনিশ্চয়তা, বৈদেশিক মুদ্রার অস্থিরতা, উচ্চ সুদের হার এবং দীর্ঘস্থায়ী মূল্যস্ফীতি ব্যবসা পরিবেশকে চাপে রেখেছে। রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর নীতি প্রণয়ন ও প্রশাসনিক পরিবর্তনের ঘন ঘন ধারা ব্যবসা আস্থায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
১১টি সূচকে ৫টিতে উন্নতি, ৬টিতে অবনতি
বিবিবিএক্স ১১টি সূচকের ওপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করেছে। এর মধ্যে অর্থায়ন প্রাপ্তির সূচক সবচেয়ে উন্নত— ২৮.১১ থেকে বেড়ে ৪০.০৭ পয়েন্টে উঠেছে। এছাড়া ব্যবসা শুরু, বিরোধ নিষ্পত্তি ও কর পরিশোধের ক্ষেত্রেও উন্নতি দেখা গেছে।
অপরদিকে, ব্যবসায়িক অবকাঠামো, শ্রমনীতি, বাণিজ্য সুবিধা, প্রযুক্তি গ্রহণ এবং পরিবেশগত আইন ও মান সূচকে অবনতি ঘটেছে। ব্যবসা অবকাঠামোর স্কোর ৭১.০৮ থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ৬৮.৮২ পয়েন্টে, বাণিজ্য সহজীকরণে কমেছে ৬০.৮৭ থেকে ৫৯.৫৬।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যিক পরিবেশের সাম্প্রতিক অবস্থা বিশ্লেষণ করতে মোট ১২টি প্রধান খাতের ওপর জরিপ পরিচালনা করা হয়েছে। এসব খাত হলো—খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা, পরিবহন, নির্মাণ, ইলেকট্রনিকস ও হালকা প্রকৌশল, চামড়া ও ট্যানারি, কৃষি ও বনায়ন, আবাসন, খাদ্য ও পানীয়, ওষুধ ও রাসায়নিক, তৈরি পোশাক, বস্ত্র এবং আর্থিক মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান।
বিবিবিএক্স জরিপ অনুযায়ী, বাংলাদেশে ব্যবসায়িক পরিবেশ সূচকের গত কয়েক বছরের ট্রেন্ড কিছুটা পার্থক্য নির্দেশ করছে। ২০২১-২২ অর্থবছরে সার্বিক সূচক ছিল ৬১.০১ পয়েন্ট, যা ২০২২-২৩ অর্থবছরে সামান্য বেড়ে ৬১.৯৫ পয়েন্ট হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কিছু ক্ষেত্রে উন্নতি দেখা গেলেও অন্য ক্ষেত্রগুলোতে অবনতি লক্ষ করা গেছে।
উন্নতির দিকগুলো
ব্যবসা শুরু করা সম্পর্কিত সূচক: ৬২.৭৪ পয়েন্ট থেকে বেড়ে ৬৪.৭২ পয়েন্ট। জমি প্রাপ্তির সূচক: ৫৩.১১ পয়েন্ট থেকে বেড়ে ৫৪.১০ পয়েন্ট। বিরোধ নিষ্পত্তি ও কর পরিশোধ সূচক: গত বছরের তুলনায় সামান্য উন্নতি।
অবনতি বা হ্রাসপ্রাপ্ত সূচকগুলো
ব্যবসা সম্পর্কিত আইনকানুনের তথ্যপ্রাপ্তি সূচক: ৬৮.০৪ থেকে কমে ৬৭.৭০ পয়েন্ট। ব্যবসা অবকাঠামো সূচক: ৭১.০৮ থেকে কমে ৬৮.৮২ পয়েন্ট। বাণিজ্য সহজীকরণ সূচক: ৬০.৮৭ থেকে কমে ৫৯.৫৬ পয়েন্ট। প্রযুক্তি গ্রহণ ও পরিবেশ/মান নিয়মাবলির সূচক: হ্রাস লক্ষ করা গেছে। অর্থায়ন প্রাপ্তি সূচক: সর্বনিম্ন হলেও আগের বছরের তুলনায় বেড়েছে—২০২৩-২৪ অর্থবছরে ছিল ২৮.১১ পয়েন্ট, যা ২০২৪-২৫-এ বেড়ে ৪০.০৭ পয়েন্ট হয়েছে।
যেসব চ্যালেঞ্জ
ব্যবসায়িক কাঠামোগত সীমাবদ্ধতাগুলোর মধ্যে রয়েছে অর্থায়নে সীমিত প্রবেশাধিকার। ভূমি নিবন্ধন ও মালিকানা হস্তান্তরের জটিলতা। অনানুষ্ঠানিক লেনদেন ও ঘুষ। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ইউটিলিটি খরচ।
এছাড়া ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোকে সামষ্টিক অর্থনীতির চ্যালেঞ্জের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হচ্ছে, যেমন- মূল্যস্ফীতি, নির্বাচন সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, ঋণের উচ্চ সুদহার, বিভিন্ন দেশের নীতিগত সিদ্ধান্তের ঝুঁকি।
খাতভিত্তিক পারফরম্যান্স ও ভৌগোলিক বৈষম্য
খাতভিত্তিকভাবে কৃষি, খাদ্য ও পানীয়, ওষুধ ও রাসায়নিক খাত ভালো করেছে। তবে তৈরি পোশাক (আরএমজি), বস্ত্র, নির্মাণ ও হালকা প্রকৌশল খাত পিছিয়ে আছে। আরএমজি খাতের স্কোর ৫৯.২৪, যা মূল রফতানি খাতেও কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা নির্দেশ করে। ভৌগোলিকভাবে বরিশাল (৬২.৮), সিলেট (৬১.৫) ও ময়মনসিংহ (৬১.৩) শীর্ষে। বিপরীতে ঢাকা (৫৯.০) ও চট্টগ্রাম (৬০.১) পিছিয়ে। এমসিসিআই মনে করে, “এটি অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বিকেন্দ্রীকরণের জরুরি প্রয়োজন নির্দেশ করে।”
দারিদ্র্য বাড়ছে, কর্মসংস্থান কমছে
বিশ্বব্যাংকের ‘বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট আপডেট ২০২৫’ অনুযায়ী, অর্থনৈতিক মন্দার কারণে দেশের ৩০ লাখ মানুষ অতি দারিদ্র্যের মধ্যে পড়তে পারে। বিবিএসের ২০২২ সালের জরিপে দারিদ্র্যের হার ছিল ১৮.৭ শতাংশ, তবে বিশ্বব্যাংকের সাম্প্রতিক হিসাব বলছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা বেড়ে ২১.২ শতাংশে পৌঁছেছে। পিপিআরসির গবেষণা অনুসারে বর্তমানে প্রায় ২৮ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে এবং ৪ কোটি মানুষ বহুমাত্রিক দারিদ্র্যে বসবাস করছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “বিনিয়োগ স্থবিরতা, ঋণ প্রবৃদ্ধির পতন এবং চার বছর ধরে চলমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্য বাড়ছে। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও সুশাসন ছাড়া এই পরিস্থিতি বদলানো সম্ভব নয়।”
বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী (পারভেজ) বলেন, “এখন ব্যবসায়ীদের রক্তক্ষরণ হচ্ছে, কিন্তু কেউ জানে না কেন হচ্ছে। বন্দরের জট, ঋণের অনিশ্চয়তা, গ্যাস ও জ্বালানি সংকট, সব মিলিয়ে খরচ বাড়ছে।”
আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স ইন বাংলাদেশ (অ্যামচেম) নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করতে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি দমন এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতির ধারাবাহিকতা বজায় রাখার ওপর গুরুত্ব দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে।
বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) অ্যামচেমের আয়োজনে ‘অ্যামচেম ইনসাইটস: ইকোনমিক অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট আউটলুক’ শীর্ষক মতবিনিময় সভায় সভাপতি সৈয়দ এরশাদ আহমেদ বলেন, “বাংলাদেশ বর্তমানে একটি গুরুত্বপূর্ণ রূপান্তর পর্বের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এ সময়ে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ধরে রাখতে হলে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, দুর্নীতি কমানো এবং দীর্ঘমেয়াদি নীতি অব্যাহত রাখা অত্যন্ত জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “দেশে লজিস্টিক অবকাঠামো উন্নয়ন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) দুটি পৃথক ইউনিটে বিভক্ত করা এবং ব্যাংকিং খাতের সুশাসন জোরদারের মতো সংস্কারগুলো একটি টেকসই ও বিনিয়োগবান্ধব অর্থনীতি গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্দেশ করছে।”