Image description

ফল-ফসল ফলানোর রুটিন ওলটপালট। গ্রীষ্মে যা হওয়ার তা হচ্ছে শীতে, আর শীতেরটা গরমে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মৌসুমের বাইরে সারা বছরই হচ্ছে শসা, টমেটো আর তরমুজ। জেলা ছাড়াও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে উৎপাদিত এই ফল-ফসল। অসময়ের শসা, টমেটো চাষে ভাগ্য বদলেছে অনেকেরই। কোটিপতি হয়েছেন কেউ কেউ। শসা-টমেটোর এই কারিগররা হয়ে উঠেছেন মডেল। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা শাহানা বেগম জানান, অবস্থা এমন হয়েছে ধানের পরিবর্তে শসা, টমেটো, তরমুজ, কাঁচামরিচ করাতেই কৃষক আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। সবজি আবাদ ও বাণিজ্যিক কৃষির গ্রাফ প্রতিবছরই বাড়ছে। তিনি আরও জানান, শসা সাধারণত মার্চ, এপ্রিল ও মে মাসে ফলালেও এখন সেপ্টেম্বর-অক্টোবরেও তা হচ্ছে। একটি জমিতে চারবার শসার ফলন হয়। ৩০/৩৫ দিনেই ফলন পাওয়া যায়। প্রতি কানিতে ৩০/৩৫ হাজার টাকা খরচে ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকার শসা উৎপাদন হয়। 


বিপর্যস্ত জাকিরের ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা: অকালে টমেটো ও শসা উৎপাদনের কারিগরদের একজন মো. জাকির হোসাইন।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার মৈন্দ-মজলিসপুর রাস্তার পাশে নিশ্চিন্তপুরে জাকিরের মেসার্স প্রবাস স্মৃতি এগ্রো ফার্ম। ফার্মের ব্যানারে বড় করে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের ছবি। সবজি উৎপাদনে জাতীয় পর্যায়ে পুরস্কৃতও হয়েছেন এই তরুণ। আবার প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ফসল মার খাওয়ায়, করোনার কারণে বেচা-বিক্রি বন্ধ থাকায় ঋণভারে জর্জরিত হয়েছেন। ঋণের টাকার জন্য মামলা দেয়া হয় তার বিরুদ্ধে। এ নিয়ে অনেক দুঃখবোধ থাকলেও বিপর্যস্ত এই কৃষক আবার ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছেন। ৪০ কানি জমিতে এবার শসা-টমেটোর চাষ করেছেন। তার প্রকল্প ঘুরে দেখা যায়, মালচিং পদ্ধতিতে চাষ করা শসা গাছ থেকে শসা পারছেন একদল নারী ও পুরুষ। সেগুলো একজন জায়গায় স্তূপ করে রেখে বস্তায় ভরা হচ্ছে। এরপর গাড়িতে করে পাঠিয়ে দেয়া হচ্ছে বাজারে।

জাকির হোসাইন জানান, মোট ৯০ কানি জমি নিয়ে তার এই কৃষি প্রকল্প। এর মধ্যে বৃষ্টিকালীন সময়ে ২৫ কানিতে শসা এবং ১৪ কানিতে টমেটো চাষ করেছেন। প্রতিদিন দেড়শ’ মণ শসা বিক্রি করছেন। জেলার বাজার ছাড়াও সিলেট, হবিগঞ্জ, কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মীপুর জেলায় যাচ্ছে তার শসা। মোট দেড়শ’ টন শসা উৎপাদন হবে বলে আশা করছেন তিনি। এরইমধ্যে ৬০/৭০ টন বিক্রি করেছেন। জানান, দেড়মাস ধরে শসা বিক্রি করছেন। বাজার ভালো থাকায় প্রতি বিঘায় উৎপাদিত শসা ২ লাখ টাকা বিক্রি করতে পারছেন। তবে, প্রতি বিঘায় ১ লাখ ২০ হাজার টাকা খরচ হওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, অনেক কৃষি উপকরণ দরকার হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় প্রকৃতির ওপর আমরা নির্ভরশীল।

এত খরচ করে প্রকল্প করার পর প্রকৃতি যখন আমাদের আঘাত করে তখন সরকারিভাবে কোনো সাহায্য পায় না। ঋণের টাকার জন্য ব্যাংক হেনস্তা করে। করোনার সময় ফসল উৎপাদন ভালো হলেও ক্রেতার অভাবে ঋণের আঘাত খেলাম, দ্বিতীয় আঘাতটা পেয়েছি ২০২২ সালে আগাম বন্যার কারণে। সে সময় আমার দেড়শ’ কানি জমিতে করা ফসল তলিয়ে যায়। কৃষক বাঁচলে দেশ বাঁচবে এটা শুধু কথার কথা। এ কথা শুনতে শুনতে আমাদের দিনকাল যাচ্ছে। কৃষি ব্যাংক আমার নামে মামলা দিয়েছে, সম্পদ বিক্রি করে টাকা আদায় করে নিয়েছে। মাঝখানে তিন বছর এনজিওগুলো আমাকে কষ্ট দিয়েছে। এর আগে আট বছর তাদের কাছে আমি জাকির সাহেব ছিলাম। একটা এনজিও পাবে ২ লাখ টাকা। মামলা করেছে ৬ লাখ টাকার। আট বছরে সুদে-আসলে তারা ১০ লাখ টাকা নিয়েছে। কিন্তু এই বিপদের দিনে সে আমার পাশে থাকবে না, এটা কোন রাষ্ট্রে আমরা বসবাস করি। আমাদের একেকটা প্রজেক্টে দেড়-দুইশ’ লোক কাজ করছে। অর্থাৎ ২শ’ পরিবারের খাবারের সংস্থান করছি। কিন্তু কোনো সাহায্য পায় না। সরকারের কাছে আমাদের দাবি আমরা যেন বেঁচে থাকতে পারি, টিকে থাকতে পারি। ব্যাংক যেন ঋণের জন্য আমাদেরকে চাপ দিয়ে না মারে। ব্যানারে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের ছবি দেয়ার কারণ সম্পর্কে জাকির হোসাইন বলেন, তিনি কৃষকের জন্য অনেক আন্দোলন করেছেন। ইতিহাস দেখেছি। ঋণ মওকুফ, ঋণের ব্যবস্থা করেছেন। কৃষক দরদী এই মানুষকে সবাই ভুলে যাচ্ছে। 

৫০ লাখে ১ কোটি: সদর উপজেলার মোহাম্মদপুর গ্রামের জামাল উদ্দিন আর তার ভাই কামাল উদ্দিন। দু’জনই ভাগ্য বদলেছেন অসময়ের টমেটো চাষে। তরমুজও করছেন তারা। গত ২৫ বছর ধরে এ কাজে জড়িত জামাল উদ্দিন জানান, এবারো ৫০/৬০ বিঘা জমিতে টমেটো চাষ করেছি। এর মধ্যে শেড করে আগাম টমেটো করা হয়েছে ২৫ বিঘাতে। বাকি ৩৫ বিঘায় সিজনাল। বলেন, আগাম টমেটো চাষের উদ্দেশ্য একটাই, গ্রীষ্মকালে ভারত থেকে প্রচুর টমেটো আনতে হয়। আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালীন টমেটো অনেক কম হয়। ব্যয়বহুল হওয়ায় তা অনেকেই করতে চায় না। আমরা চেষ্টা করছি ইন্ডিয়া থেকে যাতে টমেটো আনতে না হয়। একশ’ উদ্যোক্তা যদি এভাবে টমেটো চাষ করে তাহলে টমেটো আমদানি করতে হবে না। জ্যৈষ্ঠ মাসের শুরু থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত টমেটোর চারা লাগানো হয়। গত তিন মাস ধরে উৎপাদিত টমেটো বিক্রি করা হচ্ছে। শীতকাল পর্যন্ত এই টমেটো বিক্রি করতে পারবো। ২৫ বিঘা জমিতে টমেটো চাষে ৫০ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছে জানিয়ে বলেন, আশা করি ১ কোটি টাকার মতো বিক্রি করতে পারবো। রামরাইল ইউনিয়নের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা হাবিবুর রহমান খান বলেন, তার ব্লকে ২৫/৩০ বছর ধরে গ্রাফটিং পদ্ধতিতে গ্রীষ্মকালীন টমেটো চাষ হচ্ছে। গ্রীষ্মকালীন টমেটোর চারা ঢলে পড়ে। এটি থেকে বাঁচার জন্য আমরা কাটা বেগুনের সঙ্গে টমেটোর চারা জোড়া লাগিয়ে এটা করে থাকি। এই পদ্ধতি গ্রহণ করে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন।

জাকির, জামাল, কামাল উদ্দিন ছাড়াও আরও অনেকে অকালের টমেটো, শসা করে লাভবান হচ্ছেন। তাদের কয়েকজন কসবার এমদাদুল হক, সদরের মহিউদ্দিন, মোয়াজ্জেম, উজ্জল মিয়া, মুসা মিয়া, আসাদ, কুতুব উদ্দিন, রিপন, জয়নাল প্রমুখ।