Image description
 

বহুল আলোচিত জুলাই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান হবে আজ শুক্রবার। সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি এখনও নির্ধারিত না হলেও সই করতে রাজি বিএনপি। স্বাক্ষরে রাজি করাতে জামায়াতে ইসলামী এবং এনসিপির দাবিতে সনদের সম্ভাব্য বাস্তবায়ন পদ্ধতি তাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে। দুটি দলই চায়, সনদ স্বাক্ষরের আগে বাস্তবায়ন পদ্ধতি প্রকাশ্যে আনতে হবে। তা করা না হলেও গতকাল বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে চলেছে সমঝোতার দৌড়ঝাঁপ। সরকার এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে।

তবে জামায়াত আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে, সনদ বাস্তবায়নে নির্বাচনের আগে গণভোটের দাবিতে অনড় থাকলেও সংস্কারের স্বার্থে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আমন্ত্রণে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাবে। সই করবে কিনা, তা শুক্রবার (আজ) জানাবে। 

 
 

এনসিপি বলেছে, বাস্তবায়ন পদ্ধতির খসড়া, নির্বাচনের আগে গণভোট, সনদের আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা এবং আগামী সংসদকে কনস্টিটুয়েন্ট ক্ষমতা না দিলে তারা সনদ সই অনুষ্ঠানে যাবে না। মধ্যরাতের বৈঠকে এই অবস্থানের পরিবর্তন হয়েছে বলে একটি সূত্র সমকালের কাছে দাবি করেছে। 

গতকাল শেষ সময়েও সনদের ত্রুটি সংশোধন করা হয়েছে। সনদে রয়েছে, ২০১১ সালে সংবিধানের যুক্ত করা পঞ্চম, ষষ্ঠ এবং সপ্তম তপশিল বাদ যাবে। সপ্তম তপশিল একাত্তরের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের জারি করা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার সমকালকে নিশ্চিত করেছেন, সপ্তম তপশিল বাদ যাবে না। ভুলবশত সনদে সপ্তম তপশিল বাদের বিষয়টি এসেছে।    

 

গতকাল রাজধানীর এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে কমিশনের সদস্য বদিউল আলম মজুমদার এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার গিয়ে  স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণপত্র বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাতে তুলে দেন। তারা বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের আমন্ত্রণপত্রও দিয়েছেন। 

এরপর আমন্ত্রণপত্র পৌঁছে দিতে  বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় জামায়াত আমির শফিকুর রহমানের বাসায় এবং বনশ্রীতে এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের বাসায় যায় ঐকমত্য কমিশনের দুই প্রতিনিধি।  
সমঝোতার তৎপরতা

সূত্র জানিয়েছে, জামায়াত এবং এনসিপির সঙ্গে সমঝোতার আলোচনা হয়েছে। জামায়াত সই করতে রাজি হয়েছে। নাহিদের বাসায় তথ্য উপদেষ্টা মাহফুজ আলমও গিয়েছিলেন। তিনি সরকারের তরফে এনসিপিকে বুঝিয়েছেন। এনসিপি সনদে সই করতে নমনীয় হয়েছে। 
তবে রাত পৌনে ২টার দিকে এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব খুদে বার্তায় সমকালকে জানান, এনসিপি সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাবে না। তবে যেহেতু পরেও সনদ সইয়ের সুযোগ রয়েছে, তাই সংস্কারের পরবর্তী কার্যক্রমে এনসিপি যুক্ত হবে। এ বিষয়ে নাহিদের বক্তব্য জানতে পারেনি সমকাল। 

রাতের বৈঠকের পর কমিশন সূত্র জানায়, নির্বাচনের আগে জুলাই সনদের পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন এবং গণভোটের দাবিতে জামায়াতের সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা দলগুলোও স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাবে। 

সনদ প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐকমত্য কমিশন সূত্র সমকালকে বলেছে, সইয়ের আগে বাস্তবায়ন পদ্ধতির খসড়া প্রকাশ্যে আনা হবে না। এতে সনদে স্বাক্ষরে রাজি অন্য দলগুলো বেঁকে বসতে পারে। 

ঐকমত্য কমিশনের বিশেষজ্ঞ প্যানেল আগেই পরামর্শ দিয়েছে, সাংবিধানিক আদেশে জুলাই সনদ কার্যকর করা হবে। এই আদেশের অধীনে হবে গণভোট। পরবর্তী সংসদের প্রথম অধিবেশন হবে ‘সংবিধান সংস্কার পরিষদ’। এ অবিধেশনে সংস্কার অনুমোদিত হবে, যা জামায়াত এবং এনসিপির দাবির অনেকটাই কাছাকাছি। যদিও দুটি দলই নির্বাচনে আগে গণভোট চায়। বিএনপির অবস্থান হলো, নির্বাচন এবং গণভোট এক দিনে হবে। গণভোট কখন হবে– এই পরামর্শ বিশেষজ্ঞ প্যানেল দেয়নি। তারা বলেছে, গণভোটের সময় নির্ধারণ করবে সরকার। 

কমিশন সূত্র সমকালকে জানিয়েছে, জামায়াতকে অনানুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়েছে সাংবিধানিক আদেশ জারি সনদ কার্যকর করে গণভোট করা হবে। একই বার্তা দিয়ে এনসিপিকে বলা হয়েছে, আগামী সংসদের প্রথম অধিবেশনকে কন্সটিটুয়েন্ট ক্ষমতা দেওয়ার সুপারিশ করবে কমিশন। 

জুলাই সনদে সংস্কারের ৮৪টি সিদ্ধান্ত রয়েছে সংলাপে অংশগ্রহণ করা দলগুলোর সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতে। পিআর পদ্ধতিতে সংসদের উচ্চকক্ষ গঠনসহ ৯ সংস্কারের সিদ্ধান্তে বিএনপির নোট অব ডিসেন্ট রয়েছে। একটি নোট অব ডিসেন্ট দেওয়ার জামায়াত বলছে, জুলাই সনদে গণভোটে অনুমোদিত হলে, পুরোটা বাস্তবায়ন করতে হবে। নোট অব ডিসেন্ট রাখার বিপক্ষে এনসিপিও। 

তবে বিএনপি নোট ডিসেন্টে অনড়। দলটি বলেছে, যেসব সংস্কারে নোট অব ডিসেন্ট দিয়েছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলে সেগুলো বাস্তবায়ন করবে না। গতকাল বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলামী আলমগীর বলেছেন, সনদে নোট অব ডিসেন্ট থাকতে হবে। 

বিএনপির পক্ষে তিনি এবং স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদের সই করবেন সনদে। কমিশনের একজন সদস্য সমকালকে বলেছেন, সনদে থাকা নোট অব ডিসেন্ট গণভোটেও রাখা হবে কিনা– এ আলোচনা চলছে। গণভোটের ব্যালটে জুলাই সনদ নিয়ে একটি প্রশ্ন রাখতে চায় কমিশন। কিন্তু এর জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য প্রয়োজন। 

জামায়াতের সহকারী জেনারেল হামিদুর রহমান আযাদ সমকালকে বলেছেন, আশা করছি কমিশন শুক্রবারের মধ্যে সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতির বিষয়ে পরিষ্কার করবে। জামায়াত সনদ সই অনুষ্ঠানে যাবে। 

এ মাসেই বাস্তবায়ন পদ্ধতি
৩১ অক্টোবরের মধ্যে সনদ বাস্তবায়নের সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট ও পূর্ণাঙ্গ সুপারিশ সরকারকে করা হবে জানিয়ে ঐকমত্য কমিশনের অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, কমিশনের মেয়াদ পূর্তির আগেই সরকার সুপারিশ অনুযায়ী সনদ বাস্তবায়ন শুরু করবে। শুক্রবার যেসব দল জুলাই সনদে সই করবে না, তারা পরবর্তী সময়ও করতে পারবে। 

সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের অগ্রগতি সম্পর্কে জানাতে গতকাল জাতীয় সংসদের এলডি হলে সংবাদ সম্মেলনে আলী রীয়াজ বলেছেন, সঠিকভাবে এবং সবার অংশগ্রহণে যাতে সনদ বাস্তবায়নে পথে অগ্রসর হওয়া যায়, এই বিধান থাকবে সুপারিশে। নোট অব ডিসেন্টসহ যে ৮৪ সংস্কারে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোই রয়েছে সনদে, যা আগামী শুক্রবার প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে স্বাক্ষর হবে। মতভিন্নতা সত্ত্বেও আশা করি, সনদ প্রণয়নে যুক্ত রাজনৈতিক দলের নেতারা আসবেন, সই করবেন। 

এনসিপির অবস্থানকে ‘দুঃখজনক’আখ্যা দিয়ে আলী রীয়াজ বলেন, বুঝতে পারি, এটি তাদের রাজনৈতিক অবস্থান। তবে আমরা আশাবাদী, সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনা করে তারা সনদে স্বাক্ষর করবেন। 

আলী রীয়াজ বলেন, জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আজ শুক্রবার জাতীয় জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের কারণে সংসদ এলাকায় ড্রোন ওড়াতে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। 

সনদে ত্রুটি, বর্ণাঢ্য আয়োজনের প্রস্তুতি 
সংলাপে ঐকমত্য হয়েছিল, সদর উপজেলা বাদে অন্যান্য উপজেলায় পর্যায়ক্রমে আদালত স্থাপন করা হবে। বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ সব দল এই সংস্কারে একমত রয়েছে। কিন্তু চূড়ান্ত সনদে এই সংস্কার বাদ পড়ে। গতকাল শেষ সময়ে তা ধরা পড়েছে। আলী রীয়াজ বলেন, করণিক ত্রুটি হয়েছে। তা সংশোধন করা হবে। 

২০১১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সংবিধানের পঞ্চম তপশিলে ৭ মার্চে ভাষণ, ষষ্ঠ তপশিলে ২৫ মার্চ রাতের বেতার বার্তাকে স্বাধীনতার ঘোষণা স্বীকৃতি দিয়ে যুক্ত করেন। সপ্তম তপশিলে যুক্ত করা হয় স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র। কমিশন সূত্র জানিয়েছে, পঞ্চম এবং ষষ্ঠ তপশিল বাদের প্রস্তাবে সপ্তমও যুক্ত হয়েছিল ভুলবশত। 

গতকাল এলডি হলে সংবাদ সম্মেলনে সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী সংবাদ সম্মেলনে বলেন, সনদ বাস্তবায়ন করা গেলে রাজনৈতিক সংস্কৃতির বড় পরিবর্তন হবে। অনুষ্ঠানে ছোট্ট একটি তথ্যচিত্র থাকবে। এতে দেখানো হবে, কোথা থেকে কোথায় এলাম। সনদ আসলে কী দেবে জনগণকে। আগামী দুই মাসে তুলে ধরা হবে সনদ কীভাবে মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করবে। সনদ সইয়ের মাধ্যমে আমরা উৎসবমুখর নির্বাচনের দিকে যাত্রা করব। 

স্বাক্ষর অনুষ্ঠানকে বর্ণাঢ্য করতে কয়েকদিন ধরেই প্রস্তুতি চলছে সংসদের দক্ষিণ প্লাজায়। তিন হাজার অতিথি থাকবেন এই অনুষ্ঠানে। মঞ্চ নির্মাণ করা হয়েছে দক্ষিণ প্লাজার সিঁড়িতে। সেখানেই সই হবে জুলাই সনদ। থাকবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। 

স্বাক্ষর অনুষ্ঠান বর্জনের হুঁশিয়ারি এনসিপির
সনদের আইনি ভিত্তির নিশ্চয়তা এবং বাস্তবায়ন পদ্ধতির খসড়া না দেখে এনসিপি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যাবে না বলে জানিয়েছেন নাহিদ ইসলাম। বৃহস্পতিবার রাজধানীর বাংলামটরে অস্থায়ী কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, বাস্তবায়নের আদেশ জারির আগে স্বাক্ষর আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। সনদ ইতোমধ্যেই প্রণীত হয়েছে। জুলাই ঘোষণাপত্রেরও আইনি ভিত্তির দাবি করেছিলাম। সেখানে শব্দচয়নেও প্রতারণা করা হয়েছে। ঘোষণাপত্র পাঠের আগে এনসিপিকে দেখানো হয়নি। ফলে আরেকটা প্রতারণার সাক্ষী হতে চাই না। 

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পদ ছেড়ে এনসিপির দায়িত্ব নেওয়া নাহিদ বলেছেন, আইনি ভিত্তি ও আদেশের নিশ্চিয়তা ছাড়া সনদে স্বাক্ষর হবে মূল্যহীন। পরে সরকার কীসের ভিত্তিতে আদেশ দেবে, এ নিশ্চিয়তা পাচ্ছি না। 

নাহিদ ইসলাম বলেছেন, সনদ বাস্তবায়ন আদেশ এবং গণভোটের প্রশ্নটি চূড়ান্ত করে জনগণের কাছে প্রকাশ করতে হবে। আদেশের খসড়া জনগণের সার্বভৌম অভিপ্রায়ের বহিঃপ্রকাশ হিসেবে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জারি করবেন। সনদের ৮৪ সংস্কার নিয়ে গণভোট করতে হবে। সেখানে নোট অব ডিসেন্টের আলাদা কার্যকারিতা থাকবে না। গণভোটের রায় অনুযায়ী নির্বাচিত সংসদ তাদের ওপর প্রদত্ত গাঠনিক ক্ষমতা (কনস্টিটুয়েন্ট পাওয়ার) বলে সংবিধান সংস্কার করবে। সংস্কারকৃত সংবিধানের নাম হবে– বাংলাদেশ সংবিধান, ২০২৬।
সংবাদ সম্মেলনে এনসিপির সদস্য সচিব আখতার হোসেন, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদীব প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

চার বাম দল সই করবে না 
সংবিধানের চার মূলনীতি বাদ দিয়ে সনদে সই করবে না বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী) ও বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ। 

বৃহস্পতিবার পল্টনের মুক্তি ভবনে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে চারটি দল জুলাই সনদে স্বাক্ষর না করার সাতটি কারণ তুলে ধরে।