Image description
 

বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) গণিত বিভাগের অধ্যাপক নজরুল ইসলামের। জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই একের পর এক বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সমালোচনার মুখে পড়েছেন ক্যাম্পাসে বিএনপিপন্থি হিসেবে পরিচিত এই শিক্ষক। সম্প্রতি তার বাসায় কাজ করতে অস্বীকৃতি জানানোয় ফজিলতুন্নেসা হলের তিন কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করে ফের বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন তিনি। অধ্যাপক নজরুল ওই হলেরই প্রাধ্যক্ষ। এদিকে, সুষ্ঠু বিচার ও চাকরি ফেরতের দাবিতে হলে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন ওই কর্মচারীরা। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

 
 

চাকরিচ্যুত কর্মচারী ও বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ওই তিন কর্মচারীকে বাসার কাজ করতে বলেন অধ্যাপক নজরুল। তারা কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায়। এতে ক্ষিপ্ত হয়েছে তাদের চাকরিচ্যুত করেন এই শিক্ষক। তার বিরুদ্ধে জুলাই বিপ্লবের পর গণস্বাস্থ্য হাসপাতাল দখল করতে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে। শুরু থেকেই জাকসু নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করেছেন তিনি। টাঙ্গাইলে একটি কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হয়েছেন প্রভাব খাটিয়ে। দুর্নীতিবাজ সাবেক উপাচার্য ফারজানা ইসলামকে রক্ষায় এগিয়ে এসেছিলেন তিনি। এত বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পরও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কারণ, তিনি ক্যাম্পাসে বিএনপিপন্থি শিক্ষক হিসেবে পরিচিত।

 

সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অধ্যাপক নজরুলের এসব কর্মকাণ্ডে বিব্রত ক্যাম্পাসে দুঃসময়ে জাতীয়তাবাদী শিক্ষক ফোরামের রাজনীতি করা শিক্ষকদের একটি অংশ। তবে ছাত্রদলের একটি বৃহৎ অংশের সঙ্গে ওই শিক্ষকের ঘনিষ্ঠতার কারণে কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। বরং দুঃসময়ে রাজনীতি করা শিক্ষকদের ওপর খবরদারি করেন ওই শিক্ষক।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএনপিপন্থি একাধিক শিক্ষক আমার দেশকে জানান, অধ্যাপক নজরুল সব সময়ই সুবিধাজনক অবস্থানে ছিলেন। তিনি আওয়ামী লীগের সময়ও উপাচার্যের ঘনিষ্ঠজন ছিলেন। নিজের স্ত্রীকে ক্যাম্পাসে চাকরি দিতে তৎকালীন আওয়ামীপন্থি দুর্নীতিবাজ উপাচার্য ফারজানা ইসলামের পক্ষে কাজ করেছিলেন। জুলাই বিপ্লবের পর তিনি এখন বড় ত্যাগী শিক্ষক বনে গেছেন। বিষয়টি নিয়ে আমরা বিব্রত।

 

অধ্যাপক নজরুলের বিতর্কিত যত কর্মকাণ্ড

জুলাই বিপ্লবের পর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে প্রভাব খাটিয়ে দখল করতে যাওয়ার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর গণস্বাস্থ্য হাসপাতালে যান তিনি। এ সময় তিনি প্রায় শতাধিক বহিরাগত লোক নিয়ে ঢুকে হামলা করেন। এ ঘটনায় তখনই উপাচার্য বরাবর অভিযোগ করেন গণস্বাস্থ্য ও সমাজভিত্তিক মেডিকেল কলেজের উপাধ্যক্ষ ডা. মহিবুল্লাহ খন্দকার। এ বিষয়ে তিনি উপাচার্যের হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

 

অভিযোগ রয়েছে, গত ১১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার দিন থেকে নির্বাচন বানচালের চেষ্টা করেন অধ্যাপক নজরুল। এরপর নির্বাচনের দিন চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করেন তিনি। নির্বাচনের দিন প্রথমে তার হলের ভোট কেন্দ্রে প্রায় ১ ঘণ্টা পরে ভোটগ্রহণ শুরু করেন। এ সময় সাংবাদিকদের ভোট কেন্দ্রে প্রবেশে বাধা দেন তিনি। এরপর ১৫ নম্বর ছাত্রী হলে প্রাধ্যক্ষের অনুমতি ছাড়া জোরপূর্বক ভোটকেন্দ্রে প্রবেশ করেন। এ সময় তার পিছু পিছু ছাত্রদলের ভিপি প্রার্থীসহ কয়েকজন অছাত্র কর্মী ছিলেন। তখন হট্টগোল সৃষ্টি হয় এবং হলের নারী শিক্ষার্থীরা এর প্রতিবাদ জানান।

 

তখন নজরুল জানান, তিনি নির্বাচন মনিটরিং টিমের সদস্য তাই ভোটকেন্দ্রে প্রবেশের জন্য তার অনুমতির প্রয়োজন নেই। তবে মনিটরিং টিমের সদস্য তালিকায় অধ্যাপক নজরুলের নাম ছিল না। এখানেই শেষ নয়, জাকসু নির্বাচনকে বিতর্কিত করতে নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় মনিটরিং টিমের সদস্য না হয়েও পদত্যাগ করেন তিনি। এ সময় তিনি কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়া ভিত্তিহীনভাবে নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেন।

 

এছাড়া অধ্যাপক নজরুলের বিরুদ্ধে প্রভাব খাটিয়ে টাঙ্গাইল শহরের মেজর জেনারেল মাহমুদুল হাসান আদর্শ কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি হওয়ার অভিযোগ রয়েছে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হওয়ার সুবাদে কলেজ থেকে নাম প্রস্তাব না করার পরও তিনি কলেজ পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মনোনীত হন।

 

এ বিষয়ে মাহদুল হাসান কলেজের অধ্যক্ষ আমিনুল ইসলাম বলেন, অধ্যাপক নজরুলকে আমরা চিনতাম না। এর আগে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাকে দুবার অ্যাডহক কমিটির সভাপতি মনোনীত করা হয়েছিল। এবার তিনি সভাপতি হলেও আমরা প্রতিষ্ঠান থেকে তার নাম পাঠাইনি। আমরা সভাপতি পদে তিনজন ও বিদ্যোৎসাহী সদস্য পদে তিনজনের নাম পাঠিয়েছিলাম।

 

এদিকে শেখ রেহানার বান্ধবী দুর্নীতিবাজ সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলামকে রক্ষার অভিযোগ উঠছে অধ্যাপক নজরুলের বিরুদ্ধে।

 

তৎকালীন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ২০১৯ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান ‘অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্প’ থেকে ফারজানা ইসলাম ও তার পরিবারের সদস্যদের উপস্থিতিতে প্রকল্পের দুই কোটি টাকা শাখা ছাত্রলীগ ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের মধ্যে ভাগাভাগির খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এরপর থেকে ফারজানার বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসে আন্দোলন শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে এটি উপাচার্যের পদত্যাগ দাবির আন্দোলনে রূপ নেয়। এরপর আন্দোলনকারীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন।

 

এ সময় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ও শিক্ষকদের একটি অংশ আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের মারধর করেন এবং উপাচার্যকে গাড়িতে করে বাসভবন থেকে বের করে নিয়ে আসেন। উপাচার্যকে বের করে আনার সময় শিক্ষকদের মধ্যে সামনের সারিতে ছিলেন অধ্যাপক নজরুল। এ সংক্রান্ত কিছু ছবি ও ভিডিও প্রতিবেদকের হাতে এসেছে।

 

অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অ্যান্ড কলেজে স্ত্রীর নিয়োগ নিশ্চিত করার জন্য আওয়ামীপন্থিদের হয়ে কাজ করেন অধ্যাপক নজরুল।

 

এ বিষয়ে পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জামাল উদ্দিন বলনে, তখনকার ভিসি ফারজানার দুর্নীতি ও অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন একসময় এক দফা ভিসিবিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। আমাদের (বিএনপিপন্থি) অনেকেই ওই সময়ে ফারজানা ইসলামের পক্ষে অবস্থান নেয়। যেটি তাদের ভুল ছিল বলে আমরা মনে করি।

 

অধ্যাপক নজরুলের বিষয়ে দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলনে, তখন বিএনপির একটা অংশ পুরোপুরি ফারজানা ইসলামের পক্ষে ছিল। এ সময় নজরুল ইসলাম ভিসি ফারজানা ইসলামকে শেল্টার দিয়ে আনা-নেওয়া করতেন।

ফারজানা ইসলামকে রক্ষা করার অভিযোগ প্রসঙ্গে অধ্যাপক নজরুল বলেন, আমি কেন ফারজানাকে এসকর্ট দেব। আমি সে সময়ে রাস্তায় ছিলাম। তাকে এসকর্ট দেওয়ার আমি কে। এছাড়া বাকি অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাওয়া হলে এই অধ্যাপক বলেন, ‘এ ধরনের অভিযোগ বানোয়াট।’