Image description
 

বাড়িভাড়া, উৎসব ভাতা এবং মেডিক্যাল ভাতা বাড়ানোর দাবিতে টানা ছয় দিন ধরে মাঠে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা। এর মধ্যে তারা একাধিকবার শাহবাগ এলাকা ত্যাগ করে সচিবালয় ও যমুনার দিকে এগোতে চাইলেও পুলিশি বাধার মুখে পড়েন। প্রথম দিন তাদের ওপর হামলার তীব্র সমালোচনা করে সুশীল সমাজ। এর মধ্যে সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ দৃশ্যমান হয়নি। রাস্তা অবরোধ, দিনের পর দিন অবস্থান ধর্মঘট নিয়ে কেন শিক্ষকদের এই হয়রানিতে পড়তে হলো-প্রশ্নে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, শিক্ষকরা বেতন-ভাতার ন্যায্য দাবিতে আন্দোলন করছেন।

বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) শিক্ষকদের সঙ্গে আলোচনায় বসেও কোনও সমাধান হয়নি। সরকার পাঁচ শতাংশের বেশি বাড়িভাড়া আপাতত বাড়াতে চায় না। অন্যদিকে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা বলছেন, এবার তারা দাবি আদায় করে তবেই ফিরবেন।

এ প্রসঙ্গে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও শিক্ষাবিদ রাশেদা কে চৌধরী বলেন, ‘শিক্ষকদের জন্যই শুধু নয়, শিক্ষার্থীদের জন্যও শিক্ষায় বিনেয়োগ বাড়ানোর বিকল্প নেই। আন্দোলন এখন দমন করা গেলেও আবারও ফিরে আসবে স্থায়ী সমাধানের পথে না হাঁটলে।’ 

এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি না জাতীয়করণ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘জাতীয়করণ সমাধান নয়। আমরা আগেও দেখেছি জাতীয়করণ করার পর শিক্ষার মান কমেছে। তার চেয়ে শিক্ষকদের দাবি মেনে নেওয়া জরুরি। শিক্ষকদের বাড়িভাড়া শতভাগ করলেই জাতীয়করণের আন্দোলন কয়েক বছরে আর প্রয়োজন হবে না। এটা করলে শিক্ষকদের অন্তত খেয়ে পরে বাঁচার ব্যবস্থা তৈরি হবে। শিক্ষকদের চাহিদা কিন্তু বেশি নয়।’

সরকারের প্রতি সুপারিশ তুলে ধরে রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, ‘শিক্ষকদের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। প্রয়োজনে অবৈতনিক শিক্ষা পাবেন শিক্ষার্থীরা। এসডিজিতেও বলা আছে দ্বাদশ পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক করার কথা। তাই শিক্ষায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। শিক্ষকদের সযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে।’

‘বৈষম্যবিরোধী’ অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বাড়িভাড়া, উৎসব ভাতা এবং মেডিক্যাল ভাতা বাড়ানোর দাবির পর গত ৩০ আগস্ট অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থবিভাগ এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ৫০০ টাকা বাড়িয়ে আদেশ জারি করে। শিক্ষক-কর্মচারীদের বাড়িভাড়া ভাতা এক হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৫০০ টাকা করা হয় আদেশে। এই আদেশ প্রত্যাখ্যান করে মূল বেতনের ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া এবং চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে এক হাজার ৫০০ টাকা করার দাবি জানান শিক্ষকরা। এই দাবিতে শিক্ষক-কর্মচারীরা গত ১২ অক্টোবর থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে লাগাতার অবস্থান কর্মসূচি পালনের ডাক দেন।

এর আগে, গত ৫ অক্টোবর শিক্ষা উপদেষ্টা সি আর আবরার চৌধুরী শিক্ষকদের বাড়িভাড়া বাড়াতে অর্থ বিভাগে প্রস্তাব পাঠান। অর্থ বিভাগের সচিবের কাছে পাঠানো প্রস্তাবে শিক্ষকদের দাবি তুলে ধরে ২০ শতাংশ হারে বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা বৃদ্ধি ও কর্মচারীদের ঈদ বোনাস ৭৫ শতাংশে উন্নীত করার কথা বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবে সরাসরি ২০ শতাংশ না কয়েকটি ২০ শতাংশ, ১৫ শতাংশ, ১০ শতাংশ এবং ৫ শতাংশ দেওয়া হলে কত টাকা লাগবে তার হিসাব তুলে ধরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়।

এই টানাপোড়েনে প্রজ্ঞাপন না হওয়া পর্যন্ত লাগাতার অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেন ‘এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট’-এর সদস্যসচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী। এরপর নির্ধারিত কর্মসূচি চলাকালে জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে পুলিশ শিক্ষকদের সরিয়ে দিতে লাঠিচার্জ, জলকামান ও সাউন্ড গ্রেনেড ছোড়ে। ফলে ১৩ অক্টোবর থেকেই আন্দোলন কর্মসূচি কঠোর হয়ে ওঠে।

শহীদ মিনারে কর্মসূচিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরাশহীদ মিনারে কর্মসূচিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা

এ প্রসঙ্গে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণপ্রত্যাশী জোটের সদস্যসচিব অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেছিলেন, ‘শিক্ষা উপদেষ্টা গত ১৩ আগস্ট আমাদের বলেছেন, তারা বাড়িভাড়া মাসিক এক হাজার টাকা থেকে দুই হাজার টাকা এবং চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা থেকে এক হাজার টাকা করতে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠিয়েছেন। কিন্তু আমরা তা মানিনি। পরে তিনি মূল বেতনের শতকরা হারে বাড়িভাড়া দিলে কত টাকা খরচ হবে সে হিসাব আমাদের দিতে বলেছিলেন। আমরা তা দিয়ে এসেছিলাম। কিন্তু আমাদের সে হিসাব গ্রহণ না করেই মাত্র ৫০০ টাকা বাড়িভাড়া বাড়ানো হয়।’

বুধবার (১৫ অক্টোবর) অধ্যক্ষ দেলাওয়ার হোসেন আজিজী বলেছিলেন, ‘দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে। রাতের মধ্যেই যদি প্রজ্ঞাপন জারি না হয় তাহলে বৃহস্পতিবার বেলা ১২টার পর যমুনা অভিমুখে পদযাত্রা করা হবে।’

তবে পদযাত্রার আগেই মন্ত্রণালয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা এবং মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিবের সঙ্গে বৈঠকে বসেন ১৬ জন শিক্ষক প্রতিনিধি। শিক্ষা উপদেষ্টা স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ৫ শতাংশের বেশি আধা শতাংশও বাড়িভাড়া বাড়ানো এখন সম্ভব নয়। প্রস্তাব মেনে নিতে শিক্ষক প্রতিনিধিদলকে আহ্বান জানালে তারা তা প্রত্যাহার করে মন্ত্রণালয় থেকে ফিরে যান আন্দোলন কর্মসূচিতে। 

২০ শতাংশ বাড়িভাড়াসহ তিন দফা দাবি আদায়ে ‘লং মার্চ টু যমুনা’ কর্মসূচি স্থগিত করে আগামী ২৪ ঘণ্টা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থানের পর আমরণ অনশনের ঘোষণা দিয়েছেন তারা। বৃহস্পতিবার (১৬ অক্টোবর) বিকাল সাড়ে ৫টার দিকে শহীদ মিনারে এ ঘোষণা দেন দেলাওয়ার হোসেন আজিজী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, তিন দফা বাদ দিয়ে এক দফার আন্দোলনে যাবো। এক দফার আন্দোলন হচ্ছে এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ।

‎‎জাতীয়করণ কেন প্রয়োজন

শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ কেন প্রয়োজন তা তুলে ধরে বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি (বাশিস) ও এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ লিয়াজোঁ ফোরাম ২০২০ সালে সরকারের কাছে প্রস্তাব দেয়।

শিক্ষক নেতা নজরুল ইসলাম রনির প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল—১. বঙ্গবন্ধুর শিক্ষা দর্শন ছিল অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা, তা বাস্তবায়িত হবে। ২. সরকারের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জন সহজ হবে। ৩. ছাত্র, শিক্ষক-কর্মচারী ও অভিভাবকরা এর সুবিধা পাবে এবং বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা বাস্তবে রূপ নেবে। ৪. দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিবর্তনসহ বিশ্বমানের শিক্ষাব্যবস্থা বাস্তবায়িত হবে। ৫. শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য দূর হবে এবং শিক্ষার গুণগত মান উন্নয়ন হবে। ৬. বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারী কল্যাণ ট্রাস্ট ও অবসর সুবিধা বোর্ডে শিক্ষক-কর্মচারীদের হয়রানি বন্ধ হবে এবং ৭. শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন বৈষম্যসহ নানাবিধ অসন্তোষ দূর হবে।

উল্লেখ্য, দেশের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা জাতীয়করণের জন্য গত কয়েক বছর ধরে সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছেন। একইসঙ্গে জাতীয়করণ না করা পর্যন্ত বাড়িভাড়া ও উৎসব ভাতা শতভাগ এবং মেডিক্যাল ভাতা বাড়ানোর দাবি জানাতে থাকেন। পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের প্রস্তাবও দেন শিক্ষক নেতারা। ২০১৯ সালে দুই হাজার ৭৩৬টি বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত করা হয়। এরপর এমপিওভুক্ত বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো নিজেদের পক্ষে যুক্ত তুলে ধরে জাতীয়করণের দাবি জানায় সরকারের কাছে। ২০২৪ সালে বেসরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা আবারও জাতীয়করণের দাবি জানাতে থাকেন। যতদিন জাতীয়করণ না হয় ততদিন বাড়িভাড়া ও উৎসব ভাতা শতভাগ এবং মেডিক্যাল ভাতা বাড়ানোর দাবি জানান তারা। গত বছরের ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ৮ আগস্ট গঠিত হয় অন্তর্বর্তী সরকার। এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা এক বছর জোরালো কোনও আন্দোলনে যাননি। তারা সরকারের কাছে তিন দফা প্রস্তাব দেন। এগুলো হচ্ছে—বাড়িভাড়া ভাতা ২০ শতাংশ, ১৫০০ টাকা মেডিক্যাল ভাতা এবং কর্মচারীদের জন্য ৭৫ শতাংশ উৎসব ভাতা দিতে হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জাতীয়করণের চেয়ে জরুরি শিক্ষকদের যৌক্তিক আর্থিক চাহিদা মেটানো।