Image description

আমার দু্ইডা পোলা এতিম হইয়া গেল! এহন কেমনে সংসার চলব, এহন কে ওগো খাওয়াইব? ওগো বাবা আগুনে পুইড়া মইরা গেছে!’

এই বলে দৌড়ে স্বামীর মরদেহের পাশে গিয়ে আহাজারি করতে থাকেন ইসরাত জাহান এ্যানি। গতকাল বুধবার ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল মর্গের সামনে কাঁদতে কাঁদতে এসব কথা বলেন তিনি।

গত মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর মিরপুর রূপনগর শিয়ালবাড়ি এলাকায় পোশাক কারখানা ও রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় পুড়ে মারা গেছেন এ্যানির স্বামী আল মামুন। এই পোশাককর্মীসহ আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া ১৬ জনের লাশ এখন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে।
এর মধ্যে ১০ জনের মরদেহ গতকাল সন্ধ্যা পর্যন্ত শনাক্ত করেন স্বজনরা। ডিএনএ পরীক্ষার পর স্বজনদের কাছে এসব মরদেহ হস্তান্তর করা হবে বলে জানান দায়িত্বরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা।

এই অগ্নিকাণ্ডের ঘটনার সূত্রপাত ও আগুন নেভাতে এত সময় লাগার কারণ নিয়ে তদন্ত চলছে। গতকালও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছে ফায়ার সার্ভিসের একটি বিশেষজ্ঞদল।
বুয়েটের বিশেষজ্ঞদলও ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে।

গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে ফায়ার সার্ভিসের পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স) লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম বলেন, ফায়ার সার্ভিসের অবৈধ প্রতিষ্ঠানের তালিকায় মিরপুরের শিয়ালবাড়িতে আগুনে পুড়ে যাওয়া রাসায়নিক গুদাম আলম ট্রেডার্সও ছিল। সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সরকারি সংস্থাকে জানানোর পাশাপাশি তিনবার এই গুদামে নোটিশও দেওয়া হয়।

তিনি বলেন, ঘটনাস্থলের আশপাশের এলাকা এখনো মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ।
কারণ সেখানে রাসায়নিকের ধোঁয়া ও বিকিরণের মতো গ্যাস নির্গত হচ্ছে। এই পদার্থগুলো মানবস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর।

ছবি হাতে মরদেহের জন্য স্বজনদের অপেক্ষা : গতকাল ঢাকা মেডিক্যালের মর্গের সামনে গিয়ে দেখা যায়, মরদেহের অপেক্ষায় থাকা স্বজনদের মধ্যে কারো হাতে মেয়ে, কারো হাতে ভাইয়ের ছবি। তাঁরা আহাজারি করছিলেন।

১৩ বছরের কিশোরী আসমা দুই দিন আগে বাবাকে ফোন করে বলেছিল, ‘আব্বা, আমি আর এইহানে থাকমু না।
এইবার বেতন পাইলেই আমি বাড়ি চইলা আসমু।’ কিন্তু সেই বাড়ি আর যাওয়া হলো না আসমার।

আসমার বাবা নয়ন মিঞা বলেন, ‘আমার মাইয়াডা এইহানে থাকতে চায় নাই। কইছিলাম দুই-এক দিনের মধ্যে বেতন পাইয়া চইলা আসতে। কিন্তু আমার মাইয়াডা জীবিত আর আইল না।’

নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ উপজেলার মেয়ে আসমা শিয়ালবাড়িতে খালার বাসায় থাকত। গতকাল আগুন লাগার খবর পেয়ে গ্রাম থেকে ছুটে আসেন বাবা নয়ন মিঞা। ঢামেক মর্গে এসে মেয়ের গায়ের বলপ্রিন্টের জামা দেখে শনাক্ত করে তাকে।

‘সকালে ওরে ঘুমে রাইখাই আমি কামে চলে গেছিলাম। শেষবারের মতো একটাবারও কথা হইল না!’—বিষণ্ন্ন মুখে এভাবে কথাগুলো বলছিলেন আগুনে পুড়ে মারা যাওয়া মুনার স্বামী নাইম। ছয় মাস তাঁদের বিয়ের বয়স। সংসার শুরু করতে না করতে সব শেষ।

নাইমের বোন চম্পা জানান, মাত্র তিন দিন হলো মুনা এখানে পোশাককর্মী হিসেবে কাজ শুরু করেন। ঘটনার দিন সকাল ৮টার দিকে কাজে যান মুনা। প্রতিদিন দুপুরে বাসায় এসে খেয়ে যান। কিন্তু ওই দিন আর আসেননি। আর আসবেন না কোনো দিন।

আগুনে পুড়ে মারা গেছেন একই কারখানার তরুণ দম্পতি জয় (২৩) ও মার্জিয়া (১৮)। মাত্র আট দিন হলো কাজ শুরু করেছিলেন তাঁরা। জয় ও মার্জিয়া দুজনের বাবাই এসেছেন সন্তানদের লাশ নিতে।

আগুনে পুড়ে আরো অঙ্গার হয়েছেন ১৯ বছরের নার্গিস, তরতাজা তরুণ রবিন। রবিনের মরদেহ নিতে এসে তাঁর মা বলেন, ‘আমার পোলা দুইটা মাস কাম করল। না পাইল বেতন, না পাইল জীবন!’

গতকালও ঘটনাস্থলে ধোঁয়া উড়েছে : গতকাল বিকেল ৩টা পর্যন্ত গুদাম থেকে ঘন সাদা ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত সেই ধোঁয়া ওঠা অব্যাহত ছিল। দুপুর ২টা ২০ মিনিটে রাসায়নিক গুদামের আগুন নিয়ন্ত্রণে এলেও তা নির্বাপণ সম্ভব হয়নি বলে জানিয়েছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গুদামের আগুন নেভানোর কাজ করছেন ফায়ার সার্ভিসের সদস্যরা। তাঁদের সহযোগিতা ও জননিরাপত্তায় পুলিশ ও সেনা সদস্যদের পাশাপাশি বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবীদের দেখা গেছে।

ধোঁয়ায় অসুস্থ অর্ধশত কর্মী : সকালে খুলে দেওয়া হয়েছিল পুড়ে যাওয়া রাসায়নিক গুদামের পাশের গলিতে থাকা রাইজিং গার্মেন্টস। প্রতিদিনের মতো হাজির হয়েছিলেন কারাখানার কর্মীরা। কারাখানায় ঢুকে অসুস্থ হয়ে পড়েন প্রায় অর্ধশত কর্মী। পরে তাঁরা রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নেন।

ওই কারখানার পোশাককর্মী মো. আলামীন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কারখানা বন্ধের কোনো নোটিশ না পাওয়ায় প্রতিদিনের মতো সকালে কর্মস্থলে আসি। কারখানার সুপারভাইজার দরজা খোলার পর আমরা ভেতরে বাতি ও ফ্যানগুলো চালিয়ে দিই। এ সময় পোড়া ভবনের রাসায়নিকের সাদা গ্যাসে ঘর ভরে যায়। অনেকের শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। কেউ বা বমি করেছে, আবার কেউ অজ্ঞান হয়ে পড়েছে। ওই সময় কারাখানায় উপস্থিত ৪০ থেকে ৫০ জন অসুস্থ হয়ে পড়েন। ধোঁয়া দেখে আমি সঙ্গে সঙ্গে নাকে কাপড় বেঁধে কারখানা থেকে বের হয়ে যাই।’

সুপারভাইজার বেলাল হোসেন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘কারখানা খোলার পর সবাই অসুস্থ বোধ করলে কারাখানা বন্ধ করে দিই। ধোঁয়ায় অন্তত ৩০ জন অসুস্থ হয়েছে। তাদের স্থানীয় হাসপাতালসহ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে।’

ফায়ার সার্ভিসের ঢাকা বিভাগের সহকারী পরিচালক কাজী নজমুজ্জামান বলেন, গোডাউনে থাকা বিভিন্ন কেমিক্যালের ধোঁয়া থেকে টক্সিক গ্যাস তৈরি হয়ে বাতাসের সঙ্গে মিশে গেছে। এ ছাড়া ক্লোরিন গ্যাস ছড়িয়েছে, যা থেকে মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাস, ফুসফুস, হার্ট ও ত্বকের সমস্যা হতে পারে।

নির্বাপণে অপেক্ষা আরো ৭২ ঘণ্টা : পরিচালক লে. কর্নেল তাজুল ইসলাম বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে সংবাদ সম্মেলন করেন। তিনি বলেন, এখানে ছয়-সাত ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য আছে। কী কী রাসায়নিক আছে, তা জানা না থাকায় ধাপে ধাপে নির্বাপণের কাজ চলছে। এটা সময়সাপেক্ষ বিষয়। প্রাণহানি রোধে প্রযুক্তির ব্যবহার করছি। কেমিক্যালগুলো ‘ড্রেন আউট’ করছি। আলম ট্রেডার্সের ভবনটি অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পিলারে ফাটল ধরেছে। তাই সেখানে কার্যক্রম পরিচালনা করা বেশ ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সব মিলিয়ে আগুন নেভাতে আরো ৭২ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে।

বুয়েটের পর্যবেক্ষকদল : গতকাল সকাল ১১টার পর ফায়ার সার্ভিসের টিম মূল ফটকের তালা ভেঙে রাসায়নিক গুদামের ভেতর প্রবেশ করে। এ সময় বুয়েটের অধ্যাপক ড. ইয়াসির আরাফাতের নেতৃত্বে একটি বিশেষজ্ঞদল প্রাথমিকভাবে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। বিকেলে বুয়েটের আরেকটি বিশেষজ্ঞদল ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে কেমিক্যাল বিষয়ে বিশদ ধারণা দেয় এবং আগুন নেভানোর বিষয়ে বিভিন্ন পরামর্শ দেয়।