
গত বছর বিশ্ব খাদ্য দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল উন্নত জীবন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের জন্য খাদ্য অধিকার। অর্থাৎ সবার জন্য পুষ্টিকর খাবার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা এবং খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টির বিরুদ্ধে লড়াই করা। কিন্তু গত এক বছরে দেশে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার উন্নতির পরিবর্তে অবনতি হয়েছে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার (ডব্লিউএফপি) গ্লোবাল অন ফুড ক্রাইসিস প্রতিবেদন-২০২৫ অনুসারে বিশ্বের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় থাকা ৫টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ। বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, চলতি বছর দেশে অতিদরিদ্র মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৮ লাখে দাঁড়াবে।
এরকম এক প্রেক্ষাপট সামনে রেখে আজ দেশে পালিত হচ্ছে বিশ্ব খাদ্য দিবস। খাদ্য দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য-‘হাতে রেখো হাত, উন্নত খাদ্য ও উন্নত আগামীর পথে।’
খাদ্য দিবসের প্রত্যাশা সম্পর্কে জানতে চাইলে সাবেক কৃষিসচিব আনোয়ার ফারুক যুগান্তরকে বলেন, খাদ্য নিরাপত্তা মানে খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার। কেউ না খেয়ে থাকবে না-এটা নিশ্চিত করবে সরকার। কিন্তু দেশের সব মানুষের খাদ্যপ্রাপ্তির নিশ্চয়তা বিধান করা সম্ভব হয়নি। নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার নিয়ে কথা বলে লাভ নেই। দেশে নিরাপদ খাবার বলতে কিছুই নেই। সব ধরনের খাবারে ভেজাল।
তিনি আরও বলেন, উৎপাদন থেকে খাবার প্লেট পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে অনিরাপদ খাবারের ছড়াছড়ি অবস্থা। অপরদিকে আহরণের সময়ও বিপুল পরিমাণ খাদ্যশস্য বিনষ্ট হয়। আবার খাবার টেবিলে নষ্ট হয় প্রায় ৩৩ শতাংশ খাদ্য। একজন মানুষ বছরে প্রায় ৮০ কেজি খাবার নষ্ট করে। সেই হিসাবে দেশে বছরে প্রায় ২ কোটি টন খাবার নষ্ট হয়। আহরণ-পরবর্তী সময়েও বিপুল পরিমাণ খাদ্য নষ্ট হয়। এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে উৎপাদিত ৩৫ শতাংশ আলু ও টমেটো শুধু সংরক্ষণের অভাবে বিনষ্ট হয়। অথচ এসব ক্ষেত্রে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই।
আনোয়ার ফারুক বলেন, আমাদের মনে রাখতে হবে, জনসংখ্যা বাড়ছে। ফলে গবেষণা ও উৎপাদন বাড়াতে হবে। অফসিজনে সব ধরনের ফল ও ফসলের উৎপাদনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। বর্তমানে বছরজুড়ে পেয়ারা, পেপে, কলা, আম, আনারস পাওয়া যায়। এছাড়া মানুষকে খাদ্য অপচয়ের বিষয়ে সচেতন ও সতর্ক করতে হবে। উৎপাদন, আহরণ, পরিবহণ ও বিপণনের অপচয় ঠেকাতে হবে। খাবার টেবিলে কোনো খাবার নষ্ট করা যাবে না। বিয়ে বাড়ি এবং সামাজিক অনুষ্ঠাদিতে খাবার অপচয় বন্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ না নিলে খাদ্য নিয়ে আরও বড় সংকট তৈরি হবে।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সচিবের রুটিন দায়িত্বে) মো. আবু জুবায়ের হোসেন বাবলু যুগান্তরকে বলেন, খাদ্যের নিরাপত্তা বিধান, নিরাপদ খাদ্য এবং পুষ্টি নিশ্চিত করা কতটুক সম্ভব হয়েছে, সে ধরনের কোনো ইনডেক্স নেই। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় খাদ্য উৎপাদনে যথেষ্ট অগ্রগতি অর্জন করেছে। আগামী দিনে কৃষি উৎপাদন আরও বাড়াতে হবে। তবে গমের উৎপাদন এ দেশে সেভাবে করা সম্ভব হবে না। কারণ, গম উৎপাদনের জন্য যে মাত্রায় যতদিন শীত থাকা প্রয়োজন, তা আমাদের দেশে থাকে না। ভালো গম উৎপাদনের জন্য টানা ৯০ দিন শীত প্রকোপ থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের দেশে এরকম শীত বড়জোর থাকে ১৫ থেকে ২০ দিন। আমদানি সংক্রান্ত এক প্রশ্নের জবাবে জুবায়ের হোসেন বলেন, আমদানি করে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হয়। এটাই সত্য। তবে প্রত্যাশা অনুযায়ী উৎপাদন বাড়াতে পারলে হয়তো ভবিষ্যতে আমদানি করতে হবে না। পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন বিপণনে সরকার কাজ করছে।
বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের মহাপরিচালক জাকারিয়া যুগান্তরকে বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে। একদিনে সব ঠিক করা যাবে না। আমাদের আইন আছে বিধি নেই। বিধি এখনো চূড়ান্ত হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে ডিজি বলেন, নিজস্ব ভবন নেই। এরপরও সরকার নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে দিনরাত কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করতে আমরা নমুনা সংগ্রহ করে খাদ্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছি। এতে সচেতনতা বাড়ছে। তবে আইন করতে সময় লাগে, আইনের অভাবে অনেক কাজ করা যায় না। বর্তমান আইনের অধীনে বিধিও নেই। গত এক বছরে নিরাপদ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার কতটা নিশ্চিত করা গেল-এমন প্রশ্নে জাকারিয়া বলেন, এমন কোনো গবেষণা সংস্থাটির নেই।
পুষ্টিবিদ ও পুষ্টিরোগ বিশেষজ্ঞ রুবাবা হায়াত রীতা যুগান্তরকে বলেন, একজন সুস্থ মানুষের প্রতিদিন ১৭০০ থেকে ১৮০০ ক্যালরি গ্রহণ করতে হবে। এর কম ক্যালরি গ্রহণ করলে সমস্যা হবে। এক হাজার ক্যালরি বা এর কম ক্যালরি গ্রহণ করলে তারা যেমন অপুষ্টিতে ভুগবে, তেমনই নানা ধরনের রোগব্যাধিতেও ভুগবে। বিশেষ করে কর্মক্ষমতা হারাবে, চোখ ও চামড়ার রোগ এবং স্মৃতিশক্তি লোপ পাবে।
দেশের অতিদরিদ্ররা পুষ্টিহীনতায় ভুগছে উল্লেখ করে রুবাবা হায়াত আরও বলেন, সরকারের পাশাপাশি ধনী আত্মীয় ও সমাজপতিদের হতদরিদ্রের খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এগিয়ে আসা উচিত। তাছাড়া তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। এটি করতে পারলে দেশে অপুষ্টিতে ভোগা মানুষ কমে আসবে। ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ প্রতিষ্ঠিত হবে।