
জাতিসংঘ মাঝপথে বাতিল করেছে বাংলাদেশ পুলিশের একটি সম্পূর্ণ শান্তিরক্ষী কন্টিনজেন্টের মিশন। মাত্র এক মাস ২০ দিন আগে কঙ্গোর শান্তিরক্ষা মিশনে যোগ দেওয়া ১৮০ জন সদস্যের পুরো দলকে ফেরত আনতে পুলিশ সদর দপ্তরকে জানানো হয়েছে। অন্যান্য দেশের কন্টিনজেন্ট থেকে সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ সদস্য কমানো হলেও বাংলাদেশের পুরো দলকেই প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। দলগতভাবে কঙ্গোতে অবস্থান করা পুলিশের একমাত্র এ মিশন ‘রক্ষা’ করতে না পারার পেছনে কূটনৈতিক ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন বাহিনীটির সংশ্লিষ্ট সদস্যরা। গতকাল বুধবার থেকে জাতিসংঘ কঙ্গোতে বাংলাদেশের পুলিশ মিশনকে ‘অকার্যকর’ ঘোষণা করেছে। যদিও ঢাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশের দায়িত্বশীলরা জানিয়েছেন, জাতিসংঘ তহবিল সংকটের কারণে মিশন বাতিলের সিদ্ধান্ত জানালেও পুরো দলটি দেশে ফেরার আগ পর্যন্ত ওই মিশনটি রক্ষার চেষ্টা চলছে। কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে।
শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের সুনাম রয়েছে। বিশেষ করে নারীরা দক্ষতার পরিচয় দিয়ে আসছেন। পুলিশের এ মিশন রক্ষায় যথাযথ তৎপরতা চালানো দরকার বলে মনে করেন বাহিনীটির সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি কালবেলাকে বলেন, ‘ফান্ড ক্রাইসিসের (তহবিল সংকট) বাইরে কোন প্রেক্ষাপটে পুরো দলকে বাদ দেওয়া হচ্ছে, তা আমার জানা নেই। তবে পুলিশের এ মিশন রক্ষায় আমাদের জোর তৎপরতা রাখা জরুরি ছিল। এখনো সুযোগ থাকলে সেটা করা উচিত।’
ঢাকার পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, বর্তমানে কঙ্গোতে অবস্থান করা বাংলাদেশ পুলিশের ফরমড পুলিশ ইউনিটটি (এফপিইউ) গত ২৬ আগস্ট ঢাকা ছেড়েছিল। যেখানে ১৮০ জন সদস্যের মধ্যে ৭০ জন নারী। পুরো জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী বাহিনীর মধ্যে একমাত্র নারী কন্টিনজেন্ট ছিল এটি। এই দলের মিশন আগামী বছরের আগস্টে শেষ হওয়ার কথা ছিল। একটি দলের মিশন শেষ হলে পরে আরেকটি দল যোগ দেয়। ১৮তম রোটেশনে এই ১৮০ জন মিশনে যোগ দিয়েছিলেন।
এক সপ্তাহ আগেই খবর আসে, বিশ্বব্যাপী চলমান জাতিসংঘের ৯টি শান্তিরক্ষী মিশনে আগামী কয়েক মাসে শান্তিরক্ষীর সংখ্যা প্রায় এক-চতুর্থাংশ কমানো হবে। ভবিষ্যতে যুক্তরাষ্ট্র থেকে তহবিল পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তায় শান্তিরক্ষী কমানোর এ সিদ্ধান্ত হয়েছে। জাতিসংঘের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রয়টার্সকে জানান, প্রায় ২৫ শতাংশ শান্তিরক্ষী সৈন্য ও পুলিশকে তাদের সরঞ্জামসহ প্রত্যাহার করা হবে। পাশাপাশি এসব মিশনে কাজ করা অনেক বেসামরিক কর্মীও এর আওতায় পড়বেন। এর ফলে ১৩ থেকে ১৪ হাজার সৈন্য ও পুলিশ এবং উল্লেখযোগ্য বেসামরিক কর্মী এ ছাঁটাইয়ের আওতায় আসবেন। শুরুতেই ছাঁটাইয়ের এ কোপ পড়েছে বাংলাদেশে।
কালবেলার হাতে থাকা জাতিসংঘের একটি নথিতে দেখা গেছে—কঙ্গো, মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র এবং দক্ষিণ সুদানের ফরমড পুলিশ ইউনিটগুলোর মধ্যে ১৭ থেকে ২৪ শতাংশ পর্যন্ত কমানো হয়েছে; কিন্তু কঙ্গোতে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে হয়েছে ব্যতিক্রম। কঙ্গোতে ফরমড পুলিশ ইউনিটে মোট সদস্য আছেন ১ হাজার ৫০ জন। তার মধ্যে কমানো হয়েছে ১৮০ জন। যার পুরোটা কমেছে বাংলাদেশের একমাত্র পুলিশ কন্টিনজেন্টটি বাতিল করার মাধ্যমে। এ ছাড়া কঙ্গোতে বিভিন্ন দেশের ইন্ডিভিজুয়াল পুলিশ অফিসার (আইপিও) ছিলেন ২৬৭ জন। তার মধ্যে কমেছে ১০০ জন।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, ‘ফান্ড ক্রাইসিসের কারণে ডাউন সাইজের (সংখ্যা কমানোর) খবরটি জানা ছিল। আমাদের ধারণা ছিল, সর্বোচ্চ ২৫ শতাংশ কমতে পারে। এতে ৩০ থেকে ৩২ জনকে কমানো হলেও আরও প্রায় দেড়শ সদস্য মিশনে থাকতেন; কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে আমাদের পুরো কন্টিনজেন্ট বাতিল হয়েছে।’
কঙ্গো মিশনে থাকা এক পুলিশ কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘কঙ্গোতে শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারত, সেনেগাল ও মিশরের পুলিশ কন্টিনজেন্ট আছে। সবল কূটনীতিক যোগাযোগ ও আন্তঃসম্পর্কের কারণে এসব কন্টিনজেন্টকে রিপ্যাট্রিয়েশনের (প্রত্যাবাসন) সম্মুখীন হতে হচ্ছে না। শুধু বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট এ কঠিন পরিস্থিতির মুখোমুখি।’
পূর্ববর্তী রোটেশনে কঙ্গোতে দায়িত্ব পালন করে আসা আরেক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘কঙ্গোতে পুলিশের নারী সদস্যরা অত্যন্ত সুনাম ও দক্ষতার সঙ্গে কাজ করে আসছেন। গত ৭ আগস্ট ১৭তম রোটেশনের মেডেল প্যারেড অনুষ্ঠিত হয়। যেখানে জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ প্রতিনিধি এবং কঙ্গোতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রধান উপস্থিত ছিলেন, যা সচরাচর দেখা যায় না। বাংলাদেশ দলের প্রতি বিশেষ আস্থা ও নির্ভরশীলতার স্বাক্ষর হিসেবেই মিশনপ্রধান অনুষ্ঠানে ছিলেন। মাঠপর্যায়ে আমরা সক্ষমতার পরিচয় দিয়ে এলেও সরকারের ঊর্ধ্বতন পর্যায় থেকে কোনো পদক্ষেপ না থাকায় বাংলাদেশ পুলিশের একমাত্র কন্টিনজেন্ট এখন অস্তিত্বহীন হওয়ার পথে।’
যদিও গতকাল রাত থেকে পুলিশের কঙ্গো কন্টিনজেন্ট নন অপারেশনাল (অকার্যকর) করলেও, তা রক্ষায় কাজ চলছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, ‘কঙ্গোতে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের প্রধানের সঙ্গে মঙ্গলবার সাক্ষাৎ করে কথা বলেছে আমাদের একটি দল। মিশনপ্রধান বলেছেন, এখন যারা বাদ পড়ছেন, পরবর্তী সময়ে সুযোগ এলে তাদের প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার) দিয়ে নেওয়া হবে।’
পুরো কন্টিনজেন্ট বাতিল করার বিষয়ে বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক বাহারুল আলম কালবেলাকে বলেন, ‘পিস কিপিং (শান্তি রক্ষা) কার্যক্রম নির্ভর করে দুনিয়ার পরিস্থিতির ওপরে। এটা তো ইচ্ছা করলেই তৈরি করা যায় না। ইউএন (জাতিসংঘ) কস্ট কাটিংয়ের (ব্যয় সংকোচন) জন্য ফোর্স কমিয়েছে। এখানে সবই এক্সটারনাল ফ্যাক্টর। এখানে আমাদের তরফ থেকে কিছু বলা যায় না। পরবর্তী সুযোগের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।’
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশ পুলিশের যাত্রা শুরু হয় ১৯৮৯ সালে, নামিবিয়া মিশনের মাধ্যমে। বাংলাদেশ পুলিশের এফপিইউ ২০০৫ সাল থেকে এবং নারী কন্টিনজেন্ট ২০১১ সাল থেকে কঙ্গোতে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালন করে আসছে। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশ পুলিশের ২১ হাজার ৮১৬ জন সদস্য শান্তিরক্ষা মিশনে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে দায়িত্ব পালন শেষে দেশে ফিরেছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশ পুলিশের ২৪ জন অকুতোভয় সদস্য জীবন উৎসর্গ করেছেন।
পুলিশ সদর দপ্তর জানিয়েছে, পুলিশের এফপিইউ পুরোটা বাতিল হলেও বিভিন্ন মিশনে ইন্ডিভিজুয়াল পুলিশ অফিসাররা কর্মরত আছেন। তবে তাদের সংখ্যা অনেক কম।