Image description
ছাত্রদল ও শিবিরের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার আভাস

দীর্ঘ ৩৫ বছর পর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (রাকসু), হল সংসদ ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনের ভোটগ্রহণ আজ। এটি রাকসুর ১৫তম নির্বাচন। ১৯৫৫ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ১৯৬২ সালে প্রথমবার রাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সর্বশেষ রাকসু নির্বাচন (১৪তম) হয়েছিল ১৯৯০ সালের ২৯ জুলাই।

দীর্ঘদিন পর এ নির্বাচন হওয়ায় উচ্ছ্বসিত শিক্ষার্থী, প্রার্থীসহ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবার। ক্যাম্পাসজুড়ে সৃষ্টি হয়েছে উৎসবমুখর পরিবেশ। রাকসুতে ২৩টি পদের বিপরীতে ২৪৭ জন প্রার্থী অংশ নিচ্ছেন। সেখানে আছে আটটি পূর্ণাঙ্গ প্যানেল। মূল প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে ছাত্রদল সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম এবং ছাত্রশিবির সমর্থিত সম্মিলত শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের মধ্যে-এমন আভাস দিয়েছেন সাধারণ শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পদের প্রার্থীরাও। তাদের আরও অভিমত-অনেক পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়েরও সম্ভাবনা রয়েছে। 

এর বাইরে বিভিন্ন প্যানেলের আলোচিত বেশ কয়েকজন প্রার্থী রয়েছেন, যারা এবারের রাকসুতে চমক দেখাতে পারেন। তাদের মধ্যে সাবেক সমন্বয়কদের ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য প্যানেল’-এর জিএস প্রার্থী সালাহউদ্দিন আম্মারসহ আলোচনায় আছেন আরও কয়েকজন। এছাড়া রাকসুর বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে কয়েকজন স্বতন্ত্র প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলেছেন, যারা ক্যাম্পাসের পরিচিত মুখ হিসাবে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগে থেকেই বেশ জনপ্রিয়। ঘোষিত সময়সূচি অনুযায়ী সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ১৭টি ভোটকেন্দ্রের ৯০৯টি বুথে একটানা ভোটগ্রহণ হবে। ভোটগ্রহণ শেষে পরবর্তী ১৭ ঘণ্টার মধ্যে ওএমআর মেশিনে গণনার পর ফল ঘোষণা করা হবে। ভোটকেন্দ্রে থাকছে সিসিটিভি ক্যামেরা। এদিকে রাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ছাড়াও আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা বলয় গড়ে তোলা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন প্রবেশদ্বারে বুধবার সকাল থেকেই শুরু হয়েছে বহিরাগত ও যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ। বুধবার সকালে সিনেট ভবনের সামনে সংবাদ সম্মেলন করে ভোটগ্রহণকালীন ও পরবর্তী নিরাপত্তাব্যবস্থার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান। অন্যদিকে ভোটগ্রহণের খুঁটিনাটি বিষয় তুলে ধরে পৃথক সংবাদ সম্মেলন করেছেন রাকসু নির্বাচনের প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক ড. এফ নজরুল ইসলামসহ প্রধান রিটার্নিং কর্মকর্তা।

নির্বাচন কমিশন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী রাকসুর ২৩টি পদের বিপরীতে ২৪৭ জন, প্রতিটি হল সংসদের ১৫টি করে ১৭টি হলের ২৫৫টি পদের বিপরীতে ৫৯৭ জন, সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধির ৫টি পদের বিপরীতে ৫৮ জনসহ ২৮৩ পদের জন্য রেকর্ডসংখ্যক ৮৬০ জন প্রার্থী ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছেন। প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক নজরুল ইসলামের দাবি, অতীতের ১৪টি রাকসু নির্বাচনের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, রাকসু-২০২৫-এ সবচেয়ে বেশিসংখ্যক প্রার্থী ভোটযুদ্ধে অংশ নিচ্ছেন।

কমিশনের হালনাগাদ রেকর্ডপত্র অনুযায়ী এবারের রাকসু নির্বাচনে মোট ভোটার সংখ্যা ২৮ হাজার ৯০১ জন। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ১৭ হাজার ৫৯৫ জন, যা মোট ভোটারের ৬০ দশমিক ৯ ভাগ। অন্যদিকে নারী ভোটারের সংখ্যা ১১ হাজার ৩০৬ জন, যা মোট ভোটারের ৩৯ দশমিক ১ ভাগ। সূত্রমতে, মোট ভোটারের মধ্যে ৯ হাজার ২৫১ জন আবাসিক এবং ১৯ হাজার ৬৫০ জন অনাবাসিক শিক্ষার্থী, যা মোট ভোটারের ৬৮ শতাংশ। রাকসুতে ভিপি পদে ১৮, জিএস পদে ১৩ এবং এজিএস পদে ১৬ জন প্রার্থী রয়েছেন। একজন ভোটারকে ৪৩টি পদে ভোট দিতে হবে। ভোটার একটি ভোট দিতে পাবেন মাত্র মাত্র ১৪ সেকেন্ড সময়। সেক্ষেত্রে সব ভোট দিতে একজন ভোটার পাবেন ১০ মিনিট সময়। নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক পারভেজ আজহারুল হক জানান, একজন ভোটার বুথের ভেতরে ১০ মিনিটের বেশি অবস্থান করতে পারবেন না। ভোটগ্রহণের মোট সময়কে হিসাব করেই এই সময় নির্ধারণ করা হয়েছে।

ভোটযুদ্ধে আট প্যানেল : রাকসুতে এবারের ভোটযুদ্ধে মোট আটটি প্যানেল অংশগ্রহণ করছে। প্যানেলগুলো হলো-ছাত্রদল মনোনীত প্যানেল ‘ঐক্যবদ্ধ নতুন প্রজন্ম, ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সম্মিলিত শিক্ষার্থী জোট’, ছাত্র অধিকার পরিষদ ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতৃত্বে গঠিত ‘রাকসু ফর র‌্যাডিক্যাল চেঞ্জ’, সাবেক সমন্বয়কদের নেতৃত্বে ‘আধিপত্যবিরোধী ঐক্য’, বাম জোটের ‘গণতান্ত্রিক শিক্ষার্থী পর্ষদ’, ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) ঘোষিত ‘অপরাজেয় ৭১, অপ্রতিরোধ্য ২৪’, সাবেক নারী সমন্বয়কের নেতৃত্বে ‘সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ’ ও ইসলামী ছাত্র আন্দোলন মনোনীত ‘সচেতন শিক্ষার্থী পরিষদ’।

আট প্যানেলের ভিপি-জিএস প্রার্থী যারা : রাকসু নির্বাচনে ভিপি প্রার্থী হলেন ১৮ জন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে হলেন-ছাত্রদল সমর্থিত শেখ নূর উদ্দীন আবীর, ছাত্রশিবির সমর্থিত মোস্তাকুর রহমান জাহিদ, বামপন্থি ছাত্র সংগঠন প্যানেলের ফুয়াদ রাতুল, রাকসু ফর র‌্যাডিক্যাল চেঞ্জের মেহেদী মারুফ, রাকসুর ইতিহাসে প্রথম নারী ভিপি প্রার্থী তাসিন খান, আধিপত্যবাদবিরোধী ঐক্যের মেহেদী সজিব, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের মাহবুর আলম, ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) মাসুদ কিবরিয়া, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী জোটের তাওহিদুল ইসলাম, ইনডিপেনডেন্ট স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্সের আশিকুল্লাহ মুহিব, স্বতন্ত্র ইমতিয়াজ নোমান ইমতিয়াজ।

জিএস প্রার্থী হলেন ১৩ জন। উল্লেখযোগ্যদের মধ্যে হলেন-ছাত্রদল সমর্থিত নাফিউল ইসলাম জীবন, ছাত্রশিবির সমর্থিত ফজলে রাব্বি মো. ফাহিম রেজা, বামপন্থি ছাত্র সংগঠন প্যানেলের কাউছার আহম্মেদ, রাকসু ফর র‌্যাডিক্যাল চেঞ্জের আফরিন জাহান, সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদের রাজন আল আহমেদ, আধিপত্যবাদবিরোধী ঐক্যের সালাহউদ্দীন আম্মার, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের শরিফুল ইসলাম, ছাত্র ইউনিয়নের (একাংশ) পরমা পারমিতা, স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী জোটের নুসরাত জাহান নুপুর, ইনডিপেনডেন্ট স্টুডেন্ট অ্যালায়েন্সের আব্দুল মুকিত এবং স্বতন্ত্র ইমতিয়াজ নোমান ইমতিয়াজ।

রাবিতে তিন ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা : নির্বাচন উপলক্ষ্যে বুধবার সকালে সিনেট ভবনের সামনে নিরাপত্তা বিষয়ে ব্রিফিং করেন আরএমপি কমিশনার মোহাম্মদ আবু সুফিয়ান। কমিশনার বলেন, সুষ্ঠুভাবে ভোটগ্রহণের লক্ষ্যে ক্যাম্পাসে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিরাপত্তার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতটি প্রবেশ ফটক খোলা থাকবে ভোটের দিন। এসব গেট দিয়ে ভোটার, গণমাধ্যমকর্মী ও অন্যান্য সরকারি সংস্থার সদস্যরা নিজের পরিচয় নিশ্চিত করে ক্যাম্পাসে ঢুকতে পারবেন। প্রতিটি গেটে ইতোমধ্যে চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছে। ভোটের আগের দিন, ভোটের দিন এবং ভোটপরবর্তী সময়-এই তিন ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী পরিচালিত হবে। এজন্য ক্যাম্পাস ও সংলগ্ন এলাকায় ২ হাজার ৩০০ জন পুলিশ সদস্য, ছয় প্লাটুন বিজিবি ও ১২ প্লাটুন র‌্যাব সদস্য পালাক্রমে পুরো ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা নিশ্চিত করবেন। এছাড়া গুজব প্রতিরোধে পুলিশের সাইবার টিম অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম পর্যবেক্ষণের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন।

রাকসু ভোটে যানবাহন চলাচলে বিশেষ নির্দেশনা : রাবি প্রক্টর অধ্যাপক মাহবুবুর রহমান বুধবার জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার (আজ) ভোটের দিন ক্যাম্পাসে সব ধরনের যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা হবে। পাঁচটি নির্দেশনার বিষয় জানিয়ে তিনি বলেন, ভোটের দিন ক্যাম্পাসে সব ধরনের মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধ থাকবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টিকার ছাড়া কোনো যানবাহন ক্যাম্পাসে ঢুকতে ও চলাচল করতে পারবে না। প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের জন্য এই নিয়ম শিথিলযোগ্য। গণমাধ্যমকর্মীরা অনুমোদিত পাশ নিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকতে এবং দায়িত্ব পালন করবেন। ভোটকেন্দ্রের দিকে কোনো ধরনের যানবাহন যেতে পারবে না শুধু নির্বাচনি কাজে নিয়োজিত গাড়ি ছাড়া। বিশ্ববিদ্যালয়ে বসবাসরত শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা শুধু কাজলা গেট দিয়ে ঢুকতে ও বের হতে পারবেন।

ভোটে জালিয়াতি করার কোনো সুযোগ নেই : রাকসু, হল সংসদ ও সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচনে জালিয়াতির কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচন কমিশন জানায়, ভোটকেন্দ্রে একজন ভোটার তিন স্তরের যাচাই শেষে ভোট দেবেন। প্রতিটি ধাপে নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। বুধবার দুপুরে সিনেট ভবনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক এফ নজরুল ইসলাম জানান, নির্বাচন কমিশন ইতোমধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। আমাদের মূল লক্ষ্য একটি অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ, শান্তিপূর্ণ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দেওয়া। তাই প্রতিটি ধাপে নির্বাচনকে বিতর্কমুক্ত রাখতে আমরা গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি।

সাংবাদিকের এক প্রশ্নের উত্তরে নির্বাচনে ভোট জালিয়াতি ঠেকাতে তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে জানিয়ে নির্বাচন কমিশনার মোস্তফা কামাল আকন্দ বলেন, ‘ভোটে কারচুপি ঠেকাতে আমরা শুধু অমোচনীয় কালির ওপে নির্ভর করছি না। ত্রিমাত্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করছি। ভোটারের আইডির জন্য একটি ইউনিক আইডি দেওয়া হয়েছে, সেটি যাচাই করব। সবশেষে ভোটারের ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা থেকে নিশ্চিত করা হবে। এ প্রক্রিয়ায় কোনো ধরনের সন্দেহ তৈরি হলে একটি বিশেষ গোপনীয় কিউআর কোড থাকবে। প্রতিটি ধাপে ফুলপ্রুফ নিরাপত্তা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এটিকে অগ্রাহ্য করে কোনো অবস্থায়ই ভোটে কোনো ধরনের জালিয়াতি করার সুযোগ আমরা রাখিনি।’

ভোটের ফলাফল তৈরিতে ৪৩ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি : প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, আমরা ডাকসু ও জাকসুর তিক্ত অভিজ্ঞতা নিয়েছি। রাকসুতে আমরা সেগুলোর বিষয়ে সতর্ক থেকেছি। নির্বাচনের ফল প্রস্তুত করতে আমরা বিশেষজ্ঞ কমিটি করেছি। তাড়াহুড়া করে ভুল ও অগ্রহণযোগ্য কোনো ফলাফল আমরা প্রকাশ করব না। আমরা ইতোমধ্যে যে ৪৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বনামধন্য অভিজ্ঞ ও বিশেষজ্ঞ নিয়ে একটি কমিটি করেছি। ১৭ ঘণ্টার ভেতরে ফল প্রকাশ করা হবে। ভোটগ্রহণ শেষে ভোট বাক্স সিলগালা করে কাজী নজরুল ইসলাম মিলনায়তনে আনা হবে। সেখানেই ওএমআর মেশিনে গণনা শেষে ভোটের ফল ঘোষণা করা হবে। নির্বাচনে ভোট পরিচালনায় ১৭ জন প্রিসাইডিং কর্মকর্তা এবং ১৯৫ জন সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ ২১২ জন শিক্ষক-কর্মকর্তাসহ ৩০৩ জনের জনবল দায়িত্ব পালন করছে।