Image description

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টাদের নিয়ে সাম্প্রতিক অভিযোগ রাজনীতির পর্দায় এক নতুন নাটক উন্মোচন করেছে। অভিযোগ—সরকারের কেউ কেউ ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, কেউবা ‘সেফ এক্সিট’ পরিকল্পনা করছেন। জামায়াত ও এনসিপির পক্ষ থেকে ওঠা এই অভিযোগ এখন রাজনৈতিক অঙ্গনের সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। নাহিদ ইসলাম ও ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের বক্তব্য যেন তেল পড়া আগুন—একই সঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা দুই-ই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে।

অভিযোগের সূত্রপাত সাবেক উপদেষ্টা এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামের সেই সাক্ষাৎকারে, যেখানে তিনি বলেন, ‘উপদেষ্টাদের অনেকেই বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে লিয়াজোঁ করে ফেলেছেন, তারা নিজেদের সেফ এক্সিটের কথা ভাবছেন।’ পরে জামায়াত নেতা তাহেরও অভিযোগ তোলেন, সরকারের কোনো কোনো উপদেষ্টা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত, এমনকি তাদের ‘কণ্ঠরেকর্ড’ পর্যন্ত আছে। তিনি ইঙ্গিত করেছেন—প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নিকটতমদের কেউ কেউ নীলনকশার নির্বাচন আয়োজনের চেষ্টা করছেন।

এই মন্তব্যগুলো শুধু বিতর্ক নয়, রাজনৈতিক বিশ্বাসের কেন্দ্রবিন্দুতে একটি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। কারণ, এই অন্তর্বর্তী সরকারে অংশ নেওয়া দলগুলোরই এখন উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার মানে হচ্ছে, ক্ষমতার কেন্দ্রের ভেতরে আস্থার সংকট তৈরি হওয়া।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের অধিকাংশই নামকরা পেশাজীবী, শিক্ষাবিদ, মানবাধিকার কর্মী বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিরপেক্ষ প্রশাসন গঠন ও নির্বাচন পরিচালনা। কিন্তু এখন প্রশ্ন উঠছে—তারা কি সত্যিই নিরপেক্ষ?

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে ‘টেকনোক্র্যাট’ উপদেষ্টার ধারণা অনেক পুরনো। তারা প্রশাসনের দৈনন্দিন কাজ সামলালেও, প্রায়শই রাজনৈতিক পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেন—কেউ সচেতনভাবে, কেউ পরিস্থিতির চাপে। এই বাস্তবতা থেকেই জন্ম নেয় ‘হাইব্রিড টেকনোক্র্যাট’—যিনি একদিকে পেশাজীবী, অন্যদিকে রাজনৈতিক সুবিধাভোগী। ফলে যখন তারা কোনো সিদ্ধান্ত নেন—নিয়োগ, পদোন্নতি, কিংবা প্রশাসনিক পরিবর্তন—সেটি প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়ে।

অভিযোগ রয়েছে, কিছু উপদেষ্টা প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে রদবদল করে নিজেদের প্রভাবশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছেন। এর ফলে তারা ‘গভীর রাষ্ট্র’-এর ভেতরে একটি বিকল্প ক্ষমতা কেন্দ্র তৈরি করছেন। এটি শুধু প্রশাসনিক শৃঙ্খল ভাঙছে না, বরং অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতার মূল ধারণাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে।

আরেক শ্রেণির উপদেষ্টাকে বলা হচ্ছে ‘অপর্চুনিস্ট এক্সিট-সিকার’—যারা বর্তমান উত্তপ্ত রাজনীতিতে নিজেদের ভবিষ্যৎ নিরাপদ রাখতে ‘সেফ এক্সিট’ খুঁজছেন। তারা হয়তো এমনভাবে দায়িত্ব পালন করছেন যাতে নির্বাচনের মাধ্যমে দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়ে দ্রুত রাজনীতি বা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে চলে যেতে পারেন। এই প্রবণতা সরকারকে একটি ‘অস্থির ও অবিশ্বাসযোগ্য’ প্রশাসনিক চিত্রে দাঁড় করাচ্ছে।

১.

রাজনৈতিক দলগুলো—চাপ ও কৌশল দুই-ই: অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে ভূমিকা রাখা দলগুলো—বিশেষ করে জামায়াত, এনসিপি ও বিএনপি—এখন উপদেষ্টাদের আচরণে অসন্তুষ্ট। একদিকে তারা সরকারের অংশীদার, অন্যদিকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে নিজেদের বাদ পড়ার ভয়ে উদ্বিগ্ন। তাই তারা উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে চাপ সৃষ্টি করছে—কেউ সরাসরি অভিযোগ করছে, কেউ গণমাধ্যমে বার্তা পাঠাচ্ছে।

এই কৌশলকে বলা যায় ‘প্রেশার পলিটিকস’—যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে প্রশাসনিক প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। কিন্তু এর ফল হচ্ছে, সরকারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া জটিল হয়ে পড়ছে এবং অভ্যন্তরীণ বিভাজন তীব্র হচ্ছে। বিএনপি’র স্থায়ী কমিটির বৈঠকে যেমন বলা হয়েছে, কিছু উপদেষ্টার আচরণ সরকারের নিরপেক্ষতাকে ক্ষুণ্ন করছে। অর্থাৎ, দলগুলো শুধু বাইরে নয়, ভেতর থেকেও সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করছে।

২.

সংবাদমাধ্যম ও সুশীল সমাজ—নিরীক্ষক শক্তি: বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যম এখন এই বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু। টেলিভিশন সাক্ষাৎকার, সংবাদ প্রতিবেদন ও সম্পাদকীয়—সব মিলিয়ে ‘উপদেষ্টাদের ষড়যন্ত্র’ এখন জনআলোচনার মূল বিষয়। সাংবাদিকতা ও নাগরিক সমাজের এই ভূমিকা যেমন ইতিবাচক, তেমনি ঝুঁকিপূর্ণও—কারণ প্রমাণ ছাড়া অভিযোগ ছড়ালে সেটি সরকার ও উপদেষ্টাদের প্রতি অযথা অবিশ্বাস সৃষ্টি করতে পারে।

তবু এই পর্যবেক্ষক শক্তি (watchdog power) গণতন্ত্রের জন্য অপরিহার্য। তারা না থাকলে ক্ষমতার ভেতরের গোপন আচরণ ও স্বার্থের সংঘাত কখনো প্রকাশ পেত না।

৩.

প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ প্রতিরোধ: অভিযোগ আছে, কিছু সচিব ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা উপদেষ্টাদের ‘পক্ষপাতদুষ্ট’ আচরণে ক্ষুব্ধ। তারা প্রশাসনিক নোট ও মিটিংয়ে বিরোধিতা শুরু করেছেন। যদি এই প্রতিরোধ শক্তিশালী হয়, তবে উপদেষ্টাদের গোপন প্রভাব খাটো হতে পারে—কিন্তু সরকার নিজেই স্থবির হয়ে পড়তে পারে।

৪.

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও কূটনৈতিক চাপ: বাংলাদেশে যে কোনো রাজনৈতিক অস্থিরতা আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষকদের চোখ এড়ায় না। নির্বাচন ঘিরে যদি স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়, কূটনৈতিক চাপ বাড়বে—বিশেষ করে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও জাতিসংঘের পক্ষ থেকে। এই চাপ উপদেষ্টাদের জন্য এক ধরনের ‘মরাল অডিট’—যা তাদের পেশাগত ও ব্যক্তিগত আচরণ নিয়ন্ত্রণে রাখে।

উপদেষ্টাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগের প্রভাব এখন বহুমাত্রিক।
প্রথমত, এটি সরকারের নৈতিক শক্তি দুর্বল করছে। যাদের ওপর জনগণের আস্থা থাকার কথা, তারা এখন সন্দেহের তালিকায়। ফলে ‘এই সরকার কার?’—এই প্রশ্নই জনমনে ঘুরছে।
দ্বিতীয়ত, প্রশাসনের মধ্যেও বিভাজন সৃষ্টি হচ্ছে। একদল উপদেষ্টার পছন্দ-অপছন্দের ভিত্তিতে নিয়োগ ও বদল হলে সরকারি কর্মকর্তাদের মনোবল কমে যায়।
তৃতীয়ত, রাজনৈতিক দলগুলো এই পরিস্থিতিকে পুঁজি করে সরকারকে কোণঠাসা করার চেষ্টা করবে। অভিযোগের আড়ালে তারা নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত করতে চাইবে।
চতুর্থত, আন্তর্জাতিক মহলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে—যা অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক সম্পর্কের ওপরও প্রভাব ফেলতে পারে।

এখন সবচেয়ে প্রয়োজন—প্রমাণভিত্তিক তদন্ত ও খোলামেলা সংলাপ।
১. অভিযোগকারীদের যদি সত্যিই তথ্য-প্রমাণ থাকে, সেটি প্রকাশ করা হোক। গোপন ইঙ্গিত ও গুজব দিয়ে রাষ্ট্রের মর্যাদা নষ্ট করা যাবে না।
২. উপদেষ্টাদের কার্যক্রম পর্যালোচনার জন্য একটি স্বাধীন তদারকি কমিটি গঠন করা উচিত, যেখানে প্রশাসন, নাগরিক সমাজ ও গণমাধ্যমের প্রতিনিধি থাকবে।
৩. প্রত্যেক উপদেষ্টার স্বার্থ-ঘোষণাপত্র (declaration of interest) বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে তাদের কোনো ব্যক্তিগত বা রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা প্রকাশিত থাকে।
৪. প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি আনুষ্ঠানিক সংলাপের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন—যাতে তারা সরকারের নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে আস্থা পায়।

এই পথেই কেবল অন্তর্বর্তী সরকারের ভাবমূর্তি পুনর্গঠন সম্ভব। কারণ বর্তমান রাজনৈতিক আবহে আস্থাহীনতা যত বাড়বে, ততই সরকারের কার্যকারিতা হ্রাস পাবে।

রাষ্ট্রের শক্তি তার বাহু নয়, বরং তার বিশ্বাসে। উপদেষ্টা, প্রশাসন, রাজনৈতিক দল—সবাই যদি পরস্পরের প্রতি সন্দেহে আচ্ছন্ন থাকে, তাহলে গণতান্ত্রিক রূপান্তর সম্ভব নয়। আধুনিক রাষ্ট্রচিন্তক ম্যাক্স ওয়েবার বলেছিলেন,

‘রাষ্ট্র কেবল ক্ষমতার যন্ত্র নয়, এটি এক ধরনের নৈতিক কর্তৃত্ব, যা নাগরিকের বিশ্বাস ছাড়া টিকে থাকতে পারে না।’

আজ বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য সেই কথাটিই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক। ক্ষমতা বা পদ নয়—বিশ্বাসই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

লেখক:নিয়াজ মাহমুদ,সিনিয়র সাংবাদিক ও কলামিস্ট