
পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন কয়লাভিত্তিক তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণ শেষ হলেও কয়লা আমদানি জটিলতায় ১০ মাস ধরে বন্ধ রয়েছে। এতে বিদ্যুৎ আমদানি-নির্ভরতা বাড়ার পাশাপাশি সরকারকে প্রতিদিন প্রায় পাঁচ কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে বলে জানান সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
সরকারের মালিকানাধীন বাংলাদেশের রুরাল পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড (আরপিসিএল) ও চীনের নরিনকো ইন্টারন্যাশনাল যৌথভাবে পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণ করেছে। প্রকল্পটির মধ্যে এক দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার এসেছে চীনা ঋণ থেকে। চলতি বছরের জানুয়ারিতে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির দুটি ইউনিটের নির্মাণকাজ শেষে গত এপ্রিলে জাতীয় গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। এরই মধ্যে পরীক্ষামূলক বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত থাকার পরও চালু না করায় আর্থিক ক্ষতি বাড়ছে। সেপ্টেম্বর থেকে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে জরিমানাও গুনতে হচ্ছে সরকারকে।
খাত সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতে পূর্ববর্তী সরকারের ভুলনীতি বর্তমান সরকারও বহাল রেখেছে। ফলে দেশীয় উৎপাদন কমে আমদানি-নির্ভরতা বাড়ছে। লুণ্ঠনের ধারা থেকে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতকে বের করার পরিবর্তে এখনো আগের আমলের নীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে, বিশেষ করে আদানি পাওয়ারের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে। এ সময় দেশে গ্যাসনির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদন ৪৬ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে নেমে ৪৩ দশমিক ৯ শতাংশে এবং স্থানীয় কয়লাভিত্তিক উৎপাদন ৩০ দশমিক ১ শতাংশ থেকে কমে ২৬ দশমিক ২ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। উল্টো দিকে চলতি বছর মোট বিদ্যুৎ সরবরাহে আমদানির অংশ গতবারের তুলনায় প্রায় ৬ শতাংশ বেড়েছে।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, পটুয়াখালীতে ৯৫০ একর আয়তন জায়গাজুড়ে আরএনপিএল নামের এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটির নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৯ সালের আগস্টে। মোট নির্মাণ ব্যয়ের ২ দশমিক ৫৪ বিলিয়ন ডলারের মধ্যে ১ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার চীনের ঋণ। ১৫ বছর মেয়াদি এই ঋণচুক্তির মধ্যে চার বছর গ্রেস পিরিয়ড রয়েছে। চুক্তিতে প্রকল্প শেষ হওয়ার ছয় মাস পর থেকে ঋণ পরিশোধ করার কথা রয়েছে। এরই মধ্যে ক্যাপাসিটি চার্জ শুরু হলেও বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালুর বিষয়ে সরকারের উদ্যোগ দৃশ্যমান নয়।
কয়লা আমদানি নিয়ে জটিলতা
বিদ্যুৎকেন্দ্রে নিয়োজিত এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পটুয়াখালীর এ তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের কয়লা আমদানির জন্য ২০২২ সাল থেকে এ পর্যন্ত চার দফা দরপত্র আহ্বান করেও সরবরাহকারী চূড়ান্ত করা যায়নি। চারবারই অংশ নিয়েছে সিঙ্গাপুরভিত্তিক কোম্পানি ইয়াংথাই এনার্জি প্রাইভেট লিমিটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান। সর্বশেষ দরপত্র বাতিল করার পর প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ চেয়ে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সব যোগ্যতা থাকা এবং দরপত্রের সব শর্ত মানার পরও কার্যাদেশ না পাওয়ায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের ভুল ধারণা তৈরি হতে পারে। যা দেশের বিদেশি বিনিয়োগে প্রভাব ফেলবে বলেও চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।
ইয়াংথাই এনার্জির দাবি, বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য ইতিপূর্বে নেওয়া সব সিদ্ধান্ত পরিচালনা বোর্ডের অনুমোদনক্রমে নেওয়া হলেও চতুর্থ দফা দরপত্র বাতিলের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বোর্ডের অনুমোদন ছাড়াই। নতুন দরপত্র আহ্বানের সুপারিশে কয়লার মানসহ বিভিন্ন শর্ত আরো শিথিল করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এর আগে বিপিডিবি ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের যৌথ কমিটি কয়েক দফায় দরপত্রের মান শিথিল করেছে বলেও সংস্থাটি অভিযোগ করেছে।
বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারিগরি নথি অনুযায়ী, কয়লার মান বা অ্যাশফিউশন হলে আন্তর্জাতিক মান অনুযায়ী না হলে বিদ্যুৎকেন্দ্রের বয়লার ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এছাড়া কয়লার ক্যালরি মান কম হলে উৎপাদন ব্যয় উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যেতে পারে।
ভারত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নিয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রের উদ্বেগ
তিন বছর ধরে কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচিত করতে না পারার ব্যর্থতা কার? এমন এক প্রশ্নের জবাবে বিদ্যুৎকেন্দ্র সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, নসরুল হামিদ সিন্ডিকেটের বাধায় চারবার দরপত্র আহ্বান করেও প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়নি। চতুর্থ দফায় দরপত্র বাতিলের পর পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে।
তিনি বলেন, ভারত-সংশ্লিষ্ট একটি কোম্পানি বারবার দরপত্রে অংশ নিলেও যোগ্যতা অর্জন করতে পারেনি। তবু নানা মহল থেকে তাদের বিবেচনায় নিতে চাপ এসেছে। এ প্রতিষ্ঠানকে সুবিধা দিতে একাধিকবার দরপত্রের শর্তও শিথিল করা হয়েছে, যা জটিলতার মূল কারণ বলে তিনি উল্লেখ করেন। তবে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানটির নাম বলতে রাজি হননি ওই কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরুর নির্ধারিত সময় পার হলেও কয়লা সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারার পেছনে পুরোনো সিন্ডিকেটেই দায়ী। তাদের দাবি, ১৫ বছর ধরে সাবেক বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদের সংশ্লিষ্টরা যেভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জ্বালানি সরবরাহ করে আসছিল, এখনো তারাই এ খাতটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করে আসছে। এর প্রভাব পড়ছে পটুয়াখালী আরএনপিএল বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য কয়লা সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান নির্বাচনের ক্ষেত্রেও।
ভারতীয় বিদ্যুৎ আমদানি অব্যাহত রাখতে কারসাজির অভিযোগ
ভারতের আদানি গ্রুপ থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ আমদানি করে লুণ্ঠন ব্যবস্থা বহাল রাখতে পটুয়াখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্রটিসহ দেশের প্রায় সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের উৎপাদন সক্ষমতা কাজে লাগানো হয়নি বলে মনে করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম। আমার দেশকে তিনি বলেন, পটুয়াখালীর বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পুরোপুরি চালু করা হলে আদানির কাছ থেকে আর বিদ্যুৎ এনে দেশের কোটি টাকা গচ্চা দিতে হতো না। এখানে সুবিধাভোগী শ্রেণির আর্থিক সুবিধা জড়িত থাকায় তারা কোনোভাবেই দেশের বিদ্যুৎকেন্দ্র চালু করতে চায় না।
আগের লুণ্ঠনকারী সরকার যে পদ্ধতি অবলম্বন করত, এ সরকারও সেখান থেকে বের হতে পারেনি বলে মনে করেন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) উপদেষ্টা অধ্যাপক এম শামসুল আলম। তিনি আরো বলেন, এ সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর স্বাভাবিকভাবেই আমরা আশা করেছিলাম, আগের সরকার বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত নিয়ে যে অলিগার্ক তৈরি করে গেছে, সেটা ভাঙা হবে। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় এক বছর পার হলেও অন্তর্বর্তী সরকার সেই অলিগার্কের থাবা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনি। আগের সেই সুবিধাভোগী শ্রেণি এখনো এ খাতের নিয়ন্ত্রণ করছে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সাবেক অধ্যাপক এবং জ্বালানি ও টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন আমার দেশকে বলেন, আমরা কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো চালু করতে পারলে ফার্নেস ওয়েলের মতো উচ্চ ব্যয়ের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর প্রয়োজন হতো না। এতে বিপুল পরিমাণ অর্থ সাশ্রয় হতো। প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপরও চাপ কমতো। সেই গ্যাস আমরা শিল্পে সরবরাহ করতে পারলে শিল্প কারখানার মালিকরাও কিছুটা স্বস্তিতে থাকতে পারতেন। এখন সরকার তুলনামূলক কম ব্যয়ের দেশীয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে বসিয়ে রাখছে। আবার ভারতের আদানির কাছ থেকে বেশি দামে বিদ্যুৎ আমদানি করছে। পুরো বিষয়টি নিয়ে আসলে একটি জটিলতা তৈরি হয়েছে। সরকারকে এখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন জ্বালানি খাতের এ বিশেষজ্ঞ।