
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটনে ডিবি ও র্যাবের পর পিবিআইয়ের নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্সও ব্যর্থ হতে চলেছে। খুনি কে বা কারা এবং হত্যার মোটিভ কী সে সম্পর্কে কোনো তথ্যই উদ্ঘাটন করতে পারেনি তদন্ত সংস্থাগুলো।
তেমনি এই মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত হিসেবে চিহ্নিত এই দম্পতির ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও দুটি মোবাইল ফোনও উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনে ইন্টেরিম (অন্তর্বর্তী) সরকারও ব্যর্থ হয়েছে। তবে এই নৃশংস ঘটনা যে দুই খুনি ঘটিয়েছে, এটা নিশ্চিত হয়েছে তদন্তকারীরা।
তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমলে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সংঘটিত বহুল আলোচিত সাগর-রুনির চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের ১৩ বছরের তদন্ত সম্পর্কে আমার দেশ’র এক ব্যাপকভিত্তিক অনুসন্ধানে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। এ নিয়ে আমরা সংশ্লিষ্ট তদন্ত সংস্থা, ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তা, সাগর-রুনির পরিবার এবং বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথাও বলেছি।
আদালতে সাগর-রুনি হত্যা মামলার তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের জন্য আগামী ৩০ নভেম্বর তারিখ ধার্য রয়েছে। প্রতিবেদন দাখিলের জন্য এ পর্যন্ত ১২১ বার সময় নেওয়া হয়েছে। আদালত পিবিআইকে দ্রুত তদন্ত শেষ করার নির্দেশ দিয়েছে।
হত্যাকাণ্ড কীভাবে ঘটেছে সর্বশেষ তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ না থাকলেও তদন্তকারীদের মধ্যে এ নিয়ে দুটি মত রয়েছে। একটি মত হচ্ছে, ভাড়াটে খুনি কিংবা পেশাদার দুজন চোর বা ডাকাত দিয়ে নেপথ্যের কোনো ক্ষমতাবান চক্র এই ঘটনা ঘটিয়ে থাকতে পারে। ওই ক্ষমতাবান চক্রটি হয়তো ভাড়াটে খুনিদের দিয়ে সাগর-রুনির ল্যাপটপ ও ফোন কবজায় নেওয়ার পর ওই দুই খুনিকেও দুনিয়া থেকে সরিয়ে দিয়েছে কিংবা দেশের বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছে। অন্য মত হচ্ছে, গ্রিল কেটে দুই পেশাদার চোর কিংবা ডাকাত সাগর-রুনির বাসায় ঢুকে চুরি করতে গিয়ে এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। এই সন্দেহে রাজধানীর পাঁচটি থানার ১৩০টি চুরি-ডাকাতির মামলার ১৪৫ জন আসামিকে (সন্দেহভাজন চোর-ডাকাত) গ্রেপ্তার করে গোপনে ও প্রকাশ্যে তদন্ত করে দেখা হয় এরা জড়িত কিনা। কিন্তু প্রমাণিত হয়, সন্দেহভাজন এসব চোর-ডাকাত এই ঘটনায় জড়িত নয়। অর্থাৎ চুরির ঘটনাটিও প্রমাণিত নয়।
এ সম্পর্কে সাগর-রুনির পরিবারেরও সুস্পষ্ট বক্তব্য, ‘গ্রিল কেটে চুরি করতে চোর ঢুকেছে, এই পুরোনো গল্প আর শুনতে চাই না। আমরা আশা ছেড়ে দেওয়ার পরও অনুসন্ধান করতে গিয়ে আমরা আরো জেনেছি, পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) নেতৃত্বাধীন টাস্কফোর্স তাদের তদন্ত কাজ প্রায় সম্পন্ন করে নিয়ে এলেও তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে সাহস পাচ্ছে না। কারণ তাদের ভয়, এটি গ্রহণযোগ্য হবে কিনা এমন প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। ফলে দেশের ইতিহাসে অন্যতম আলোচিত হত্যাকাণ্ডের মামলাটি সম্ভবত ‘অমীমাংসিত হত্যা মামলা’ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকার আশঙ্কা রয়েছে।
আমার দেশ অনুসন্ধানে আরো জানা গেছে, পুলিশের গোয়েন্দা সংস্থা ডিবি ও এলিট ফোর্স র্যাবের মতো পিবিআই-এর তদন্তকারীরাও নিশ্চিত দুই খুনি সাগর-রুনির বাসার রান্নাঘরের গ্রিল কেটে ভেতরে প্রবেশ করেছে। হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাস্থল থেকে চারজনের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের এফবিআই-এর সহযোগিতায় সেখানকার ল্যাবে এই ডিএনএ পরীক্ষা হয়েছে। সাগর ও রুনির ডিএনএ ম্যাচ করেছে। কিন্তু অন্য দুজনের (খুনি) ডিএনএ ম্যাচ হয়নি। এ সম্পর্কে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘যুক্তরাষ্ট্রের PARABON Nanolabs-এ এই পরীক্ষা করে। কিন্তু ডিএনএতে অধিক মিশ্রণজনিত কারণে PARABON SNAPSHOT ছবি প্রস্তুত করতে পারেনি।’
অনুসন্ধানে জানা যায়, পিবিআইয়ের নেতৃত্বে টাস্কফোর্স র্যাবের তৎকালীন কমান্ডার এম সুহায়েল ও মেজর জেনারেল (বরখাস্ত) জিয়াউল আহসান, ডিবির মনিরুল ইসলাম, এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান, সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহানসহ বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। সামিট গ্রুপের জ্বালানি পাইপ নিয়ে রিপোর্টের জন্য পাওয়া ডকুমেন্ট সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির কাছে ছিল বলে যে কথাবার্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে, সে বিষয়েও টাস্কফোর্স সামিট গ্রুপের সংশ্লিষ্টতা খতিয়ে দেখেছে। কিন্তু কোনো কূলকিনারা পায়নি।
অনুসন্ধানে গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় সম্পর্কে অবহিত হওয়া গেছে। সেটি হলোÑএলিট ফোর্স র্যাব তাদের তদন্ত শেষে মামলার রহস্য উদঘাটন এবং খুনিদের শনাক্ত করতে না পারায় ২০২১ সালে ফাইনাল রিপোর্ট দিতে চেয়েছিল। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করতে দেননি। তৎকালীন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক তদন্তকারীদের বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে অনেক মামলার নজির আছে, যা রুজুর পর এখনো Undispossal অবস্থায় আছে, এটিও থাক।’
জানা গেছে, সর্বশেষ (এখন পর্যন্ত) পিবিআই-এর তদন্ত প্রতিবেদনের (টাস্কফোর্স) মতামত হচ্ছে, ‘সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত রহস্য উদঘাটন করা সম্ভব হয়নি। মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত সাগর-রুনির ব্যবহৃত ল্যাপটপ ও দুটি ফোন উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। বিভিন্ন সংস্থা কর্তৃক তদন্ত করলেও মামলাটির তদন্তে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়নি।’ এছাড়াও পারিবারিক বা দাম্পত্য কলহ, পেশাগত, অর্থ ও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, এসব সম্ভাব্য কারণও প্রমাণিত হয়নি।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে হাইকোর্ট চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ড মামলাটি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্সের মাধ্যমে তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র সচিবকে নির্দেশ প্রদান করে। হাইকোর্টের নির্দেশের আলোকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পিবিআই প্রধানকে আহ্বায়ক করে পুলিশ অধিদপ্তরের প্রতিনিধি, অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রতিনিধি ও র্যাবের প্রতিনিধি সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। পিবিআইকে লিডিং অর্গানাইজেশন হিসেবে মামলার তদন্ত কাজ পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। সংস্থার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আজিজুল হক তদন্ত কাজ পরিচালনার দায়িত্বে রয়েছেন।
তদন্ত সম্পর্কে তদন্ত সংস্থা ও সাগর-রুনির পরিবারের সাক্ষাৎকার
সর্বশেষ বিষয়ে জানার জন্য আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে তদন্ত সংস্থা পিবিআই ও টাস্কফোর্সের প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোস্তফা কামালের সঙ্গে পিবিআই সদর দপ্তরে কথা হয়। তিনি জানান, হত্যাকাণ্ড ঘটেছে ২০১২ সালে। আমরা এক যুগেরও বেশি সময় পর এর দায়িত্ব নিয়েছি। তদন্ত করতে গিয়ে এই মামলার সবকিছু খতিয়ে দেখেছি। এর মধ্যে পুরোনো তদন্ত নথি ও সংশ্লিষ্ট সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তবে তদন্তে এখনই বলার মতো কোনো অগ্রগতি হয়নি।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই-এর অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আজিজুল হক আমার দেশকে বলেন, মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম একটি টাস্কফোর্সের অধীনে চলছে। তদন্তাধীন বিষয়ে এর বেশি কিছু বলা সম্ভব নয়।
মামলার বাদী সাংবাদিক মেহেরুন রুনির আপন ভাই মো. নওশের আলম রোমান বলেন, সাগর-রুনি হত্যা মামলার রহস্য উদঘাটন সম্পর্কে আমরা আশা ছেড়ে দিয়েছি। এখনো আমরা মনে করি, এই ঘটনায় তৎকালীন সরকার জড়িত। প্রশিক্ষিত বাহিনী জড়িত। সাগর-রুনির ছেলে মেঘকে কয়েক দফায় ডিবি ও র্যাবসহ তদন্তকারীরা তাদের অফিসে ডেকে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ ও জবানবন্দি নিয়েছে। তিনি জানান, হত্যাকাণ্ডের ঘটনার সময় বাসায় মেঘ ছিল। সেদিন খুনিরা মেঘের গলা টিপে ধরেছিল। তখন সে অজ্ঞান হয়ে যায়। খুনিরা হয়তো ভেবে থাকতে পারে, মেঘ মারা গেছে। নইলে সেদিন মেঘও হত্যার শিকার হতো।
সাগর-রুনির সন্তান মাহির সরওয়ার মেঘ আমার দেশকে বলেন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর আমরা ভেবেছিলাম মামলার তদন্ত গতি পাবে। কিন্তু এখন আমরা অনেকটাই হতাশ। দীর্ঘ এই সময়ে আমার নানু মারা গেছেন। আমার দাদি বার্ধক্যে পৌঁছেছেন। আমি আশা করব অন্তত, দাদি এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার দেখে যেতে পারবেন।’
পিবিআইয়ের জিজ্ঞাসাবাদে বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গ
র্যাবের তৎকালীন নৌবাহিনীর কর্মকর্তা কমান্ডার এম সুহায়েল সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের পর বলেছিলেন, ‘তদন্তে রহস্য উদঘাটনের খুব দ্বারপ্রান্তে রয়েছি’Ñ কেন এমন কথা বলেছিলেন জিজ্ঞাসাবাদে জানান, দেশের মানুষ এবং সাংবাদিক সমাজকে বিভ্রান্ত করার জন্যই বলেছিলাম। র্যাবের তৎকালীন গোয়েন্দা শাখার প্রধান জিয়াউল আহসান বলেন, হত্যাকাণ্ডের খবর পাওয়ার পর আমিই প্রথম ঘটনাস্থলে যাই। কি পেয়েছেন জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, গ্রিল কেটে চোরের দল সাগর-রুনির বাসায় ঢুকে হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল। একই কথা ডিবির মনিরুলও পিবিআইকে জানিয়েছেন। ডিবির মনিরুলও ঘটনাস্থলে যান এবং অভিযোগ রয়েছে তিনি আলামত নষ্টের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া তখন থেকেই তিনি ঘটনাটিকে চুরির ঘটনা দেখানোর অপচেষ্টা চালান। সাংবাদিকদের আন্দোলন থেকে সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী কেন সরে গেলেন জিজ্ঞাসাবাদে বলেন, সরকারি পদে থেকে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা সম্ভব ছিল না।
১৩ বছরের তদন্তে যেসব বিষয় তদন্ত প্রতিবেদনে উঠে এসেছে
২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হন। পরদিন ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় পেনাল কোডের ৩০২/৩৪ ধারায় মামলা রুজু হয়। মামলার নম্বর ২৩। মামলাটির বাদী সাংবাদিক মেহেরুন রুনির আপন ভাই মো. নওশের আলম রোমান (২৮)। এজাহারে বলা হয়, ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ২টা থেকে সকাল সাড়ে ৭টার মধ্যে যে কোনো সময় শেরেবাংলা নগর থানার পশ্চিম রাজাবাজারস্থ ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া সাংবাদিক মেহেরুন নাহার রুনি ও গোলাম মোস্তফা সরোয়ার ওরফে সাগর সরোয়ারকে অজ্ঞাতনামা দুষ্কৃতকারীরা হত্যা করে। ঘটনাস্থল শেরেবাংলা নগর থানাধীন ৫৮/এ/২ পশ্চিম রাজাবাজার হোল্ডিংয়ে অবস্থিত শাহজালাল রশিদ লজ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের ৫ম তলা। মামলাটি রুজু হয় ১২ ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালে বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে। এজাহারভুক্ত আসামি অজ্ঞাতনামা। খুনি কর্তৃক লুণ্ঠনকৃত মালামালের মধ্যে রয়েছে একটি ল্যাপটপ, দুটি মোবাইল ফোন, আনুমানিক ১১শ ইউরো ও কয়েক ভরি স্বর্ণালঙ্কার। গ্রেপ্তারকৃত সন্দিগ্ধ আসামিরা হলেনÑ মো. বকুল মিয়া (২৬), মো. কামরুল হাসান অরুন (২৭), মো. রফিকুল ইসলাম (২৫), মো. মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু (২৫), মো. আবু সাইদ (২৮), মো. তানভীর রহমান (২৯), পলাশ রুদ্ধ পাল (৩০) ও এনাম আহমদ ওরফে হুমায়ুন কবীর ওরফে আমিনুল হক কলিম (২৩)। এর মধ্যে তানভীর রহমান ও পলাশ রুদ্ধ পাল জামিনে আছেন। মামলায় ১৬১ ধারায় গৃহীত সাক্ষীর সংখ্যা ১৬৯ জন। ১৬৪ ধারায় এখন পর্যন্ত কোনো আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেই। জব্দকৃত আলামতের মধ্যে রয়েছে, একটি লোহার তৈরি রক্তমাখা বঁটি, একটি ১২ ইঞ্চি রক্তমাখা স্টিলের ছুরি, একটি রক্তমাখা কাঠের রঙ জাতীয় প্লাস্টিক ছুরির বাঁট, একটি রক্তমাখা ব্লু রঙের কামিজ, একটি রক্তমাখা সিনথেটিক কালো হলুদ প্রিন্টের কামিজ, দুটি অব্যবহৃত মোবাইল ফোন সেট, একটি বাঁটবিহীন রক্তমাখা ছুরি, লোহার ফ্ল্যাটবার দিয়ে তৈরি গ্রিলের অংশ, সাগর-রুনির পরিধেয় রক্তমাখা বস্ত্রাদি ইত্যাদি। এসব আলামত শেরেবাংলানগর থানায় সংরক্ষিত আছে।
তদন্ত সম্পর্কে বলা হয়, ‘২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম রাজাবাজারের ৫৮/এ/২ নম্বর বিল্ডিংয়ের ৫ম তলায় ভাড়া বাসায় খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর সরোয়ার ও মেহেরুন রুনি। সাগর সে সময় মাছরাঙা টিভি এবং রুনি এটিএন বাংলায় কর্মরত ছিলেন। এর আগে সাগর ২০০৮ সালে ডয়েচে ভেলেতে চাকরির সুবাদে জার্মানি যান এবং এর এক বছর পর ২০০৯ সালে তার স্ত্রী মেহেরুন রুনি দেড় বছর বয়সের ছেলে মাহির সরোয়ার মেঘকে সঙ্গে নিয়ে জার্মানি যান। ২০১১ সালে তারা বাংলাদেশে ফিরে আসেন। মামলাটি রুজু হওয়ার পর শেরেবাংলা নগর থানার তৎকালীন এসআই জহিরুল ইসলাম চারদিন তদন্ত করেন। তিনিসহ থানা এবং জোনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা দফায় দফায় ঘটনাস্থল পরিদর্শনসহ খুনিদের শনাক্তের চেষ্টা করেন। এর চারদিন পর ২০১২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি মামলাটির তদন্তভার ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)তে হস্তান্তর করা হয়। ডিবির তৎকালীন পুলিশ পরিদর্শক মো. রবিউল আলম মামলাটি তদন্ত করেন। সে সময় ঘটনাটি দেশজুড়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে। তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন (মরহুম) সব মিডিয়া কর্মীর সামনে ঘোষণা করেন, ‘৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তার করা হবে।’ এ অবস্থায় ডিবির সব স্পেশাল টিম অনেক চেষ্টার পরও মামলার প্রকৃত রহস্য উদঘাটন এবং খুনিদের শনাক্ত ও গ্রেপ্তারে ব্যর্থ হয়।
তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার ৬২ দিন পর ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে ডিবি প্রধান মনিরুল ইসলাম ডিবির ব্যর্থতা স্বীকার করে প্রতিবেদন জমা দেন। হাইকোর্টের নির্দেশে মামলার তদন্তভার দেওয়া হয় র্যাবকে। ২০১২ সালের ১৯ এপ্রিল থেকে নভেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত মামলাটি তদন্ত করে র্যাব। তদন্ত করতে গিয়ে শেরেবাংলা নগর, তেজগাঁও, মোহাম্মদপুর, ধানমন্ডি এবং কলাবাগান থানা ১৩০টি চুরি/ডাকাতি মামলার সন্দিগ্ধ ১৪৫ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। আসামিদের সম্পর্কে গোপনে ও প্রকাশ্যে তদন্ত করা হয়। কিন্তু এই ১৪৫ জন মামলায় জড়িত মর্মে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। মামলার জব্দকৃত হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত ছুরি, বঁটি, ছুরির বাঁট এবং সাগর-রুনির পরিধেয় বস্ত্রাদিসহ অন্যান্য আলামত ও সন্দিগ্ধ গ্রেপ্তারকৃতদের মোট ২৫ ব্যক্তি Buccal Swab সংগ্রহপূর্বক ডিএনএ পরীক্ষা করা হয়। আলামতের প্রাপ্ত ডিএনএ-এর সঙ্গে প্রেরিত ব্যক্তিদের ডিএনএ ম্যাচিং হয়নি বলে ল্যাব কর্তৃক প্রতিবেদনে বলা হয়। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, ঘটনাস্থলে মোট চার ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে তিনজন পুরুষ ও একজন মহিলা।
চার জনের মধ্যে দুজনের ডিএনএ হলো সাগর ও রুনির। বাকি দুজন অজ্ঞাত পুরুষ ব্যক্তি কারা তা উদঘাটন করা যায়নি। এরাই খুনি। অজ্ঞাতনামা এই দুই পুরুষের ডিএনএ থেকে ছবি করতে ডিএনএ সেলে ছবি প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান PARABON Nanolabs, USA-তে ডিএনএ পাঠানো হয়। কিন্তু ডিএনএ-তে অধিক মিশ্রণজনিত কারণে PARABON SNAPSHOT ছবি প্রস্তুত করতে পারেনি। ঘটনাস্থলের রান্না ঘরের পূর্ব পাশের বারান্দার গ্রিল ওই সময় ভাঙা ছিল। ভাঙা অংশের ওয়ালের কার্নিশে ও বিপরীত পাশে সংলগ্ন অপর বিল্ডিংয়ের কার্নিশেও পায়ের ছাপ ছিল।
নথিদৃষ্টে দেখা যায় যে, ঘটনাস্থলে পুলিশ আসার আগেই বহু লোক চলে আসায় ওই পায়ের ছাপ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি মর্মে উল্লেখ আছে। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের সম্ভাব্য কারণ হিসেবে পারিবারিক বা দাম্পত্য কলহ, পেশাগত, অর্থ ও জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধ ইত্যাদি সব বিষয় গভীরভাবে তদন্ত করেও কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। কে বা কারা হত্যাকাণ্ডে জড়িত বা হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কী ইত্যাদি তথ্য উদঘাটিত হয়নি। ২০১৭ সালের ১৫ মার্চ র্যাবের পক্ষ থেকে সিএমএম আদালতে অগ্রগতি প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ঘটনার একমাত্র প্রত্যক্ষদর্শী সাগর-রুনির একমাত্র সন্তান মাহির সারওয়ার মেঘের (৫.৫ বছর) জবানবন্দি রেকর্ড করা হয়েছে এবং ৮ জন গ্রেপ্তার হয়েছে। র্যাব চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিতে চাইলেও তৎকালীন স্বরাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী প্রতিবেদন প্রকাশ করতে দেননি। তৎকালীন আইনমন্ত্রী যুক্তি দেখান যে, পৃথিবীর অনেক মামলার নজির আছে যে, যা রুজুর পর এখনো Undispossal অবস্থায় আছে।
সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের সেই তোলপাড় সময়
সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনির সন্তান মেঘের বয়স এখন ১৮ বছর পেরিয়ে গেছে। হত্যাকাণ্ডের সময় তার বয়স ছিল পাঁচ বছর পাঁচ মাস। ওই সময়ের শিশু মেঘ প্রতি রাতেই নাকি তার মা-বাবার সঙ্গে কথা বলত। একটি টিভি চ্যানেলের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সে এ বক্তব্য দিয়েছিল। মা-বাবাহারা এই এতিম শিশুর মানসিক অবস্থা তখন কোন পর্যায়ে ছিল, তার এ বক্তব্যই তখন সবকিছু বলে দেয়। ছোট্ট মেঘ তখন আরো বলেছিল, মা-বাবার ডাক সে শুনছে কিন্তু তাদের ছুঁতে পারছে না, কোলে উঠতে পারছে না এবং তাদের আদরও সে পাচ্ছে না।
মেঘের মা-বাবা ও আমাদের সহকর্মী সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আজ ১৩ বছর পেরিয়ে গেছে। কিন্তু আজও জানা যায়নি, এই সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের খুনি কে? কেন তারা খুন হলেন? খুনের রহস্য কী?
রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ পশ্চিম রাজাবাজারের ফ্ল্যাটের বেডরুমে ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নৃশংসভাবে খুন হন সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি। এই চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ডের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন বলেছিলেন, ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিচক্রকে গ্রেপ্তার করা হবে। পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার হত্যাকাণ্ডের দুদিন পর বলেছিলেন, ‘সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তে প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।’ ডিসি ডিবি মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘সাগর-রুনির খুনিচক্র সম্পর্কে আমরা নিশ্চিত হয়েছি, তাদের গ্রেপ্তার করা এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র।’ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরো বলেছিলেন, ‘এই হত্যাকাণ্ডের তদন্ত স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী মনিটরিং করছেন।’ কিন্তু সবকিছু যে ফাঁকা বুলি, জানা যায় কয়েকদিন পরেই। এই হত্যাকাণ্ডের ৫৭ দিন পর শোনা গেল অন্য কাহিনি। তদন্তের দায়িত্বে নিয়োজিত ডিবি পুলিশকে হাইকোর্ট তলব করলে তারা আদালতকে জানায়, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই, তদন্তে তারা ব্যর্থ। ডিবি পুলিশ ব্যর্থতা স্বীকার করায় মহামান্য হাইকোর্ট ডিবির কাছ থেকে তদন্তভার ফিরিয়ে নিয়ে র্যাবকে দায়িত্ব দেওয়ার নির্দেশ দেয়। দায়িত্ব পেয়ে র্যাব হত্যাকাণ্ডের ৭৫ দিনের মাথায় সাগর-রুনির লাশ ভিসেরা পরীক্ষার জন্য কবর থেকে ওঠায়। অর্থাৎ সাগর-রুনির লাশ ভিসেরা পরীক্ষা ছাড়াই দাফন করা হয়েছিল। আগের তদন্তকারী সংস্থা ডিবি তদন্তের জন্য ভিসেরা পরীক্ষা করা যে প্রয়োজন, সেটাও অনুধাবন করতে পারেনি। ভিসেরা পরীক্ষার পর ২০১২ সালের ২৯ মে র্যাবের কাছে রিপোর্ট জমা হয়। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের কোনো ক্লু র্যাব পেয়েছিল কি না, তা জানা যায়নি।
যে ডিবি পুলিশের কর্মকর্তা জোর গলায় বলেছিলেন, সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের আসামিদের গ্রেপ্তার এখন সময়ের ব্যাপারমাত্র, সে একই কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম ২০১২ সালের ১৮ এপ্রিল হাইকোর্টে দাঁড়িয়ে বললেন, আমরা ব্যর্থ। ওইদিন শুনানির সময় ডিসি ডিবি মনিরুলের সঙ্গে ছিলেন তদন্ত কর্মকর্তা রবিউল আলম। শুনানির শুরুতে রবিউল দাঁড়ালে আদালত বলে, ‘আপনাদের প্রতিবেদনে তো কিছুই নেই, শূন্য। আপনাদের অগ্রগতি দেখে তো আমরা শঙ্কিত। তিন মাসে এ রকম একটি চাঞ্চল্যকর মামলায় আপনারা কিছুই করতে পারলেন না। অনেক সাংবাদিকের অপমৃত্যু হয়েছে। আপনারা একটারও কূল-কিনারা করতে পারেননি। এটাকে আমরা ব্যর্থতাই বলব।’ এরপর আদালত ১৬১ ধারার জবানবন্দি দেখেন। প্রায় ২৫ মিনিট পর্যালোচনার পর ডিসি ডিবি মনিরুলের বক্তব্য শুনতে চায় আদালত। মনিরুল বলেন, ‘সর্বোচ্চ চেষ্টার পর এখনো সুনির্দিষ্ট কোনো ক্লু খুঁজে বের করতে পারিনি। আপনি কি ব্যর্থতা স্বীকার করছেন—আদালতের জিজ্ঞাসায় মনিরুল বললেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা ব্যর্থ।”
যতটুকু জানা যায়, ডিবি পুলিশ ঘটনাটিকে একটি মামুলি চুরির ঘটনা হিসেবে সাজাতে চেয়েছিল। এজন্যই তারা বলেছিল, আসামি গ্রেপ্তার সময়ের ব্যাপারমাত্র। কিন্তু হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের প্রেক্ষিতে সেদিকে আর বিষয়টিকে নেওয়া হয়নি। এরপর তদন্ত করেছে র্যাব। কিন্তু তদন্তের কোনো অগ্রগতি নেই ভিসেরা রিপোর্ট দেওয়া ছাড়া। ভিসেরা রিপোর্টে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে যে, কোনো বিষাক্ত কিছু কিংবা মাদকদ্রব্য সেবনের আলামত নেই।
ওইদিন সকালে মানুষ ঘুম ভেঙেই জেনেছে নৃশংস এবং একই সঙ্গে মর্মান্তিক এই হত্যাকাণ্ডের খবর। আগের রাতে সাগর সারওয়ারের দায়িত্ব ছিল মাছরাঙা টেলিভিশনের রাত ১টার খবর প্রচারের ব্যবস্থা করা। অথচ ভোর হতেই সারাদিন ধরে সাগর সারওয়ার নিজেই হয়ে যান প্রধান খবর। খবরের কাগজে কাজ করতে গিয়ে জীবনসঙ্গী করেছিলেন সম্প্রচার সাংবাদিকতার পরিচিত মুখ মেহেরুন রুনিকে। খবরের পেছনের এই মানুষটির জীবনও শেষ হলো খবরের শিরোনাম হয়ে। মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক ছিলেন সাগর সারওয়ার (গোলাম মুস্তফা সারওয়ার), মেহেরুন রুনি (মেহেরুন নাহার) এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তারা সাংবাদিকতা পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। রাজধানীর পশ্চিম রাজাবাজারের ৫৮/১/২ নম্বর বাড়ির পঞ্চম তলার ভাড়া ফ্ল্যাট থেকে পুলিশ এ দু’জনের মৃতদেহ উদ্ধার করে। মৃত্যুর এই খবর অবশ্য প্রথম পেয়েছিলেন বুনির মা নুরুন্নাহার মির্জা। আর খবরটি দেয় ওই সাংবাদিক দম্পতির সাড়ে পাঁচ বছরের ছেলে মাহিন সারওয়ার (মেঘ)। নৃশংস এই হত্যার সময় ঘরেই ছিল সে। সে-ই টেলিফোন করে ওর নানিকে জানায় তার ছোট্ট এই জীবনের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর খবরটি।
ধারালো অস্ত্রের উপর্যুপরি আঘাতে ১০ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার রাত তিনটা থেকে ভোর পাঁচটার মধ্যে তাদের হত্যা করা হয়। শরীরে ২০টির বেশি ছুরিকাঘাতের চিহ্ন, ডান বগলে একটি বাঁটহীন ছুরি বিদ্ধ অবস্থায় ছিল। রুনির পেটে ছুরিকাঘাতের বড় ক্ষত ছিল।
সাংবাদিক দম্পতি হত্যার ঘটনায় গণমাধ্যম কর্মীদের মাঝে নেমে আসে শোকের ছায়া। হত্যাকারীদের দ্রুত খুঁজে বের করার নির্দেশ দেন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের নির্দেশ দেন।
পুলিশ ও নিহত ব্যক্তিদের স্বজনরা জানান, ১১ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যায় মেহেরুন রুনি তার কর্মস্থল এটিএন বাংলা থেকে বাসায় ফেরেন। রাত দুটার দিকে ফেরেন সাগর সারওয়ার। সকালে হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে পুলিশ, র্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। ছুটে যান সাংবাদিক দম্পতির স্বজন, বন্ধু, সহকর্মী ও গণমাধ্যম কর্মীরা। পাঁচ কক্ষের এ বাসায় তিল ধারণের জায়গা ছিল না সেদিন। দুপুর ১২টার পর মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। ওইদিন লাশ যেভাবে পড়েছিল শয়নকক্ষের মেঝেতে, ছিল থকথকে রক্ত। সেখানে পড়ে ছিলেন রক্তাক্ত সারওয়ার ও মেহেরুন। সারওয়ারের পরনে থ্রি-কোয়ার্টার, গা খালি। মেহেরুনের পরনে ছিল ঘরের পোশাক। সাগরের হাত পিছমোড়া করে এবং পা লাল কাপড় দিয়ে বাঁধা, সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড এতই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে যে, দ্বিধাবিভক্ত সাংবাদিকরা শয়নকক্ষ ছাড়া বাসার আর কোথাও কোনো রক্তের দাগ ছিল না। জিনিসপত্র গোছানো। ছোট খাবার টেবিলটিও ছিল পরিপাটি। রান্নাঘরে কেবল একটি ম্যাগি নুডুলসের প্যাকেট পড়েছিল।
রুনির মা নুরুন্নাহার মির্জা সাংবাদিকদের বলেন, সকাল সাতটার দিকে মেঘ তাকে মোবাইল ফোনে বলে, ‘মেমি (মা)-বাবা মারা গেছে।’ এরপর তিনি ইন্দিরা রোডের বাসা থেকে ছুটে আসেন, দরজা ভেতর থেকে খুলে দেয় মেঘ। এটিএন বাংলাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মেঘ বলে, ‘খুনিদের হাতে পিস্তল ও ছুরি ছিল। আমাকে গুলি করতে চেয়েছিল। সে আরো জানায়, দুজন প্রথমে তার বাবাকে ও পরে মাকে হত্যা করে।’
সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ড এতই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে যে, দ্বিধাবিভক্ত সাংবাদিকরা এ ইস্যুতে ঐক্যবদ্ধ হন এবং ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলন শুরু করেন। বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক (বিএফইউজে) দুই অংশ এবং ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে), দুই অংশসহ জাতীয় প্রেস ক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি একসঙ্গে বসে কর্মসূচি প্রণয়ন করে। এ কর্মসূচিতে বাংলাদেশ ফটোজার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন, ক্রাইম রিপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন, সাব-এডিটরস কাউন্সিল, ফোরাম ফর এনার্জি রিপোর্টার্স বাংলাদেশ, ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরাম, ডিপ্লোম্যাটিক রিপোর্টার্সসহ সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন যোগ দেয়। কিন্তু পরে অদৃশ্য কারণে এ আন্দোলনও দ্বিধাবিভক্ত হয়। ১৩ বছর পরও সাগর-রুনি হত্যাকাণ্ডের তদন্তের সুরাহা হয়নি। খুনিচক্র এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরেই রয়ে গেছে।