
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু), হল ও সিনেট ছাত্র প্রতিনিধি নির্বাচন দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে। দীর্ঘ প্রায় ৩৬ বছর পর হচ্ছে এ নির্বাচন। নিজেদের প্রতিনিধি বেছে নিতে শেষ মুহূর্তে নানা সমীকরণ মেলাচ্ছেন ভোটাররা। নানা ধর্ম, বর্ণ, জাতিসত্তার বৈচিত্র্যের এক অনন্য বিদ্যাপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশ্লেষকদের মতে, বেশ কয়েকটি সমীকরণে নির্ধারণ হবে চূড়ান্ত ফলাফল। একই সঙ্গে পূর্ণ প্যানেলে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনাও কম। চমক দেখাতে পারেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও।
অনাবাসিক ও নারী ভোটার:
চূড়ান্ত তালিকা অনুযায়ী চাকসু নির্বাচনে ভোটার সংখ্যা ২৭ হাজার ৫১৮ জন। যেখানে নারী ভোটারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১১ হাজার। যা প্রায় ৪১ শতাংশ। অন্যদিকে চবিতে আবাসন ব্যবস্থা আছে ৬ হাজার ৩২৮ জনের। ছেলেদের হলে আছে ৩ হাজার ৬৮৭টি আসন, মেয়েদের হলে আছে ২ হাজার ৬৪১টি আসন। সে হিসাবে মাত্র ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসিক। বাকি ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থীই অনাবাসিক। অনাবাসিক ও নারী ভোটারের এই বিশাল সংখ্যা পার্থক্য গড়বে।
সংখ্যালঘু ও পাহাড়ি শিক্ষার্থী:
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে পাহাড়ি ও সংখ্যালঘু শিক্ষার্থীদের উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি। পার্বত্য রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবানের উপজাতি শিক্ষার্থীদের ভোটও নির্বাচনে প্রভাব ফেলবে। এছাড়া সংখ্যালঘু, বৃহত্তর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভোটও প্রভাবক হয়ে উঠবে।
বাস্তবভিত্তিক ইশতেহার:
চাকসু নির্বাচন ঘিরে নানা প্রতিশ্রুতি ও ইশতেহার নিয়ে ভোটারদের মাঝে প্রচারণা করেছেন প্রার্থীরা। তবে অনেকেই দিচ্ছেন সাধ্যের বাইরের প্রতিশ্রুতি। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যারা বাস্তবভিত্তিক প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন এবং অতীতে শিক্ষার্থীদের পাশে ছিলেন তাদেরই বেছে নেবেন তারা। এরমধ্যে আবাসন ও পরিবহণ সংকট, নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোকে প্রাধান্য দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।
আলোচনায় ৮ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী প্রার্থী:
চাকসু নির্বাচনে আলোচনায় আছেন ৮ দৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেল থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মিজান মিয়া প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কার্যনির্বাহী সদস্য পদে। ইসলামী ছাত্রশিবির সমর্থিত সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট প্যানেল থেকে সমাজতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষার্থী আকাশ দাস লড়ছেন একই পদে। স্বতন্ত্র হিসেবে ইতিহাস বিভাগের মো. সুরত আলম প্রার্থী হয়েছেন স্বাস্থ্যবিষয়ক সম্পাদক পদে। ছাত্র ইউনিয়ন (একাংশ) ও ছাত্রফ্রন্ট সমর্থিত দ্রোহ পর্ষদ প্যানেল থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ সোহেল রানা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সমাজসেবা ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক পদে। একই পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন সর্বজনীন শিক্ষার্থী সংসদ প্যানেল থেকে আইন বিভাগের শিক্ষার্থী মেহেদী হাসান। বিনির্মাণ শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেল থেকে আবিদুর রহমান প্রার্থী হয়েছেন কার্যনির্বাহী সদস্য পদে। এএফ রহমান হলে নির্বাহী সদস্য পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মো. নাদিম হোসেন। বিজয় ২৪ হলে ছাত্রী সংস্থা সমর্থিত প্যানেল থেকে প্রার্থী হয়েছেন আয়েশা খাতুন।
আলোচনায় তিন জুলাইযোদ্ধা:
চাকসু নির্বাচনে আলোচনায় আছেন জুলাই আন্দোলনে সম্মুখসারিতে থাকা তিনজন। এদের মধ্যে একজন মো. মাহবুবুর রহমান। তিনি কম্পিউটার সাইন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি সম্পাদক পদে প্রার্থী হয়েছেন। জুলাই আন্দোলনের সময় ছাত্রলীগের হামলায় গুরুতর আহত হন তিনি।
বাংলা বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মো. শুভ হোসেন। সমাজসেবা ও পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক পদে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন তিনি। ২০২৪ সালের ১৬ জুলাই চট্টগ্রামের মুরাদপুরে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন শুভ। সেদিন ছাত্রলীগের গুলিতে গুরুতর আহত হন তিনি। বুলেটটি তার ডান চোখ ভেদ করে তিন স্তর অতিক্রম করে ভেতরে আটকে যায়।
জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম অগ্রনায়ক ছাত্রদল কর্মী আব্দুল্লাহ আল মামুন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (চাকসু) নির্বাচনে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেলে জায়গা পাননি তিনি। তবে মামুন স্বতন্ত্রভাবেই নির্বাচনে লড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ২০২০-২১ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। গত বছরের জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনে তিনি ছিলেন সম্মুখসারিতে। মহাসড়ক অবরোধ থেকে শুরু করে ‘বাংলা ব্লকেড’—প্রতিটি কর্মসূচিতে তার সক্রিয় উপস্থিতি নজরে আসে।
প্রচারণার শেষদিন:
সোমবার ছিল চাকসু নির্বাচনে প্রচার-প্রচারণা শেষদিন। রাত ১২ টায় শেষ হচ্ছে প্রচারণা কার্যক্রম। শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করেছেন প্রার্থীরা। ক্যাম্পাসের শহীদ মিনার চত্বর, বুদ্ধিজীবী চত্বর, লেডিস ঝুপড়ি, কলা ঝুপড়ি, সমাজবিজ্ঞান ঝুপড়ি, প্রতিটি অনুষদ প্রাঙ্গণ, আবাসিক হল প্রাঙ্গণ, জিরো পয়েন্টসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে ছিল প্রার্থীদের প্রচারণার ভীড়।
বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বরে সরেজমিন দেখা যায়, প্রার্থীরা ভোটারদের দ্বারে দ্বারে যাচ্ছেন। নানা প্রতিশ্রুতি দিয়ে আকৃষ্ট করার চেষ্টা করছেন তাদের।
প্রশাসনের নিষ্ক্রিয়তার অভিযোগ ছাত্রশিবিরের:
চাকসু নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সাইবার বুলিং ও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়ে প্রার্থীদের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে ভুয়া পোস্ট, বিকৃত তথ্য ও উস্কানিমূলক মন্তব্য করা হচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছেন ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট’।
সোমবার দুপুর দেড়টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবী চত্বরে সংবাদ সম্মেলনে এ অভিযোগ তোলেন সম্প্রীতির শিক্ষার্থী জোট প্যানেলের প্রার্থীরা। এ সময় তারা দাবি করেন এসব অনলাইন অনিয়ম মোকাবিলায় প্রশাসন নিষ্ক্রিয়তা দেখাচ্ছে।