
বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়াসহ তিন দফা দাবিতে দ্বিতীয় দিনের মতো কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান নিলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া নেই।
এ প্রসঙ্গে আজ সোমবার দুপুর আড়াইটার দিকে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট’-এর সদস্য সচিব দেলাওয়ার হোসেন আজিজী আমার দেশকে বলেন, এ পর্যন্ত তিন দফা দাবি পূরণের বিষয়ে আমাদের সঙ্গে শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিংবা সরকারের কোনো পক্ষ এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে যোগাযোগ করেনি। তবে বিভিন্ন সূত্রে আমরা খবর পেয়েছি, দাবি পূরণে মন্ত্রণালয় তৎপর ও আন্তরিক। তবে দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কথা জানিয়েছেন।
সোমবার আড়াইটার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে দেখা যায়, সহস্রাধিক শিক্ষক-কর্মচারী দুইভাগ হয়ে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছেন। একটি অংশ শহীদ মিনারের মুলবেদিতে কয়েক শত শিক্ষক-কর্মচারী ব্যানারসহ দাঁড়িয়ে আছেন। সেখানে একসঙ্গে দুইজন অনবরত বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। সেখানে ‘বিশ পার্সেন্ট বাড়ি ভাড়া, দিতে হবে দিয়ে দাও’, ‘অবিলম্বে প্রজ্ঞাপন, দিতে হবে দিয়ে দাও’, ‘১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা, দিতে হবে দিয়ে দাও' স্লোগান দিচ্ছেন।
এর অদূরে শহীদ মিনারের পশ্চিম দিকে গাছতলায় আরো কয়েক শতাধিক শিক্ষক একত্রিত হয়ে একই ধরনের স্লোগান দিচ্ছেন। সেখানে সদস্য সচিব দেলাওয়ার হোসেন আজিজীও রয়েছেন। শিক্ষকরা অনবরত বক্তব্য দিয়ে চলেছেন। বক্তব্যে শিক্ষকরা দাবির পক্ষে তাদের বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরছেন। কিছুক্ষণ পর পর টিভি ক্যামেরা দেখলেই তারা স্লোগানে স্লোগানে ফেঁটে পরছেন। টিভি ক্যামেরা ছাড়াও সেখানে বিভিন্ন মিডিয়ার সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যানসহ শত শত কনটেন্ট ক্রিয়েটররা ভিড় করছেন।
এই দুটি জমায়েত ছাড়াও পশ্চিম উত্তর কোণের গাছতলায় শত শত শিক্ষককে মাদুরবিছিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা গেছে। পুরুষদের পাশাপাশি শতাধিক নারী শিক্ষক-কর্মচারীদেরও দেখা গেছে।
এসময় কথা হয় বরিশালের আগৈলঝাড়া বাশাইল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মোখতারুজ্জামানের সঙ্গে। তিনি আমার দেশকে বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির এই সময়ে একজন শিক্ষক বেতনের সঙ্গে এক হাজার টাকা বাড়িভাড়া আর ৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা দিয়ে কী করে চলছেন; তা কি সরকারের লোকজন একটু ভেবে দেখছেন? তারা যদি এ নিয়ে একটু ভাবতেন তাহলে প্রথম দিনেই শিক্ষক-কর্মচারীদের দাবি মেনে নিতেন। তিনি বলেন, দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে তাই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
কেরানিগঞ্জের কলাতিয়া ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মোনালিসা মুক্তা বলেন, আমরা ক্লাস নিয়ে দুপুরের দিকে এখানে এসেছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আন্দোলন চালিয়ে যাবো।
মুন্সিগঞ্জের কলেজ শিক্ষক হারুন রশীদ আমার দেশকে বলেন, আমরা ন্যায্য অধিকার আদায়ে শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়েছি, সরকার মেনে নিলেই আমরা ক্লাসে ফিরে যাবো। আমরা এখানে অবস্থান কর্মসূচি পালন করছি, আর সারাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি পালিত হচ্ছে। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
শিক্ষক শামীমুর রহমান বলেন, আমাদের কোনো রাজনৈতিক কোনো উদ্দেশ্য নেই। শুধু ন্যায্য অধিকার আদায়ে শহীদ মিনারে অবস্থান নিয়েছি। সারাদেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কর্মবিরতি পালিত হচ্ছে।
বছরের শেষ সময়ে এসে শিক্ষকদের এই আন্দোলনে শিক্ষার্থীদের ক্ষতির বিষয়ে শিক্ষক এরফানুল ইসলাম বলেন, কর্মবিরতির কারণে শিক্ষার্থীদের যে ক্ষতি হবে, তা পূরণে প্রয়োজনে তারা পরবর্তীতে বেশি ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে নেবেন। এরপরও দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা কর্মস্থলে ফিরবেন না।
এর আগে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোট’-এর ব্যানারে গত রোববার সকাল আটটা থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তায় লাগাতার অবরোধ কর্মসূচি শুরু করেছিলেন শিক্ষক কর্মচারীরা। পরে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে শিক্ষকদের একটি প্রতিনিধিদল অর্থ মন্ত্রণালয়ের আহ্বানে সচিবালয়ে যায়। সেখানে মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। তবে প্রজ্ঞাপন জারির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট আশ্বাস না পাওয়ায় এ বৈঠক ফলপ্রসূ হয়নি বলে দুপুর ১টার দিকে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে ফিরে জাতীয়করণ-প্রত্যাশী জোটের আহ্বায়ক অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন ও সদস্য-সচিব অধ্যক্ষ দেলোয়ার হোসেন আজিজী প্রেস দুটি ঘোষণা দেন। এরমধ্যে প্রেস ক্লাবের সামনে থেকে সরে তারা শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন এবং দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত ঢাকা ছাড়বেন না।
দুপুর দেড়টার দিকে অধ্যক্ষ মাঈন উদ্দিন ও অধ্যক্ষ আজিজীর নেতৃত্বে শিক্ষকদের একটি পক্ষসহ বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে শহীদ মিনারের দিকে চলে যায়। অন্যদিকে আরেক পক্ষ প্রেস ক্লাবের সামনেই অবস্থান নিয়ে সচিবালয় অভিমুখে লংমার্চ কর্মসূচি ঘোষণার দাবি তোলে। তারা শহীদ মিনারে যেতে অস্বীকৃতি জানান। এতে ওই সড়কে কয়েক ঘণ্টা যান চলাচল বন্ধ ছিল। পরে পুলিশ লাঠিপেটা, সাউন্ড গ্রেনেড ও জলকামান ছুড়ে শিক্ষক-কর্মচারীদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। পরে রোববার বিকাল তিনটার দিকে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে গিয়ে অবস্থান নেন আন্দোলনকারী শিক্ষক-কর্মচারীরা। সেখানে তারা রাতে অবস্থান করেন। সোমবার সকালেও দ্বিতীয় দিনের অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছেন তারা।
তাদের তিনটি দাবি মধ্যে রয়েছে- বেতনের ২০ শতাংশ বাড়িভাড়া, চিকিৎসা ভাতা দেড় হাজার টাকা করা এবং কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ করা।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের দাবিতে এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ প্রত্যাশী জোটের গত ১৩ আগস্ট জাতীয় প্রেসক্লাবের শিক্ষক সমাবেশে লক্ষাধিক শিক্ষক-কর্মচারী উপস্থিত ছিল। ওইদিন শিক্ষা উপদেষ্টা শিক্ষক নেতাদের সঙ্গে আলোচনায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের বেসিকের ২০ শতাংশ বাড়ি ভাড়া, ১৫০০ টাকা চিকিৎসা ভাতা ও উৎসব ভাতা বৃদ্ধির প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। কিন্তু দীর্ঘ দুই মাস পার হলেও প্রজ্ঞাপন জারি না হওয়ায় এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ।
সূত্রমতে, শিক্ষক-কর্মচারীদের আন্দোলনের মুখে নতুন করে বাড়িভাড়া ভাতা ও মেডিকেল ভাতার বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নতুন প্রস্তাবনা গত ৫ অক্টোবর অর্থ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। এতে বাড়িভাড়া ২০ শতাংশ নির্ধারণে নতুন প্রস্তাব করা হয়। একইসঙ্গে কর্মচারীদের উৎসব ভাতা ৭৫ শতাংশ এবং চিকিৎসা ভাতা এক হাজার টাকার প্রস্তাব করেন শিক্ষা উপদেষ্টা।