Image description

না পারিশ্রমিকেই রাতদিন নিরলসভাবে কাজ করে বহুল আলোচিত আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভকে বাস্তবে রূপ দেন নিভৃতচারী স্থপতি নাজমুল হক নাঈম। বুয়েট থেকে অনার্স মাস্টার্স ও পিএইচডি করা; বর্তমানে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আর্কিটেকচার বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ স্থপতির ভাষায়-আবরার যে আলো জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন সে আলো এখানে জ্বলবে আর অনুপ্রেরণা জোগাবে তরুণদের মাঝে। এটি এমন এক স্থাপনা, যা শুধু আবরারের স্মৃতিই নয়, বরং যুগে যুগে আগ্রাসন ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের চেতনাকেও বহন করবে।

অনুভূতি ব্যক্ত করে স্থপতি নাঈম আমার দেশকে বলেন, স্বৈরাচার সরকারের আমলে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া সেই প্রথম নির্মিত স্তম্ভের থিমের আলোকে উদ্যোক্তা সংশ্লিষ্টদের দিকনির্দেশনায় কিছু নতুনত্ব যোগ করে আমার স্মৃতিময় ক্যাম্পাস এলাকায় এটিকে বাস্তবে রূপ দিতে পেরে খুবই ভালো লাগছে।

উদ্যোক্তাদের মূল কনসেপ্টÑমানবিক মর্যাদা, সাংস্কৃতিক স্বাধীনতা, দেশীয় শিল্প-কৃষি-নদী-বন-বন্দর রক্ষা, অর্থনৈতিক স্বনির্ভরতা, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, গণ-প্রতিরক্ষা, গণতন্ত্র ও সার্বভৌমত্বের আটটি পিলার আটটি আইডিয়া বা ধারণাকে একে অপরের সঙ্গে রিলেটেড এবং ধাপে ধাপে সেগুলো আমাদের সার্বভৌমত্বের দিকে নিয়ে যায়।

প্রতিটি পিলারকে এমনভাবে ডিজাইন করা যেন দেখে মনে হয়, সুপার ন্যাচারাল কিছু শূন্যে ভেসে আছে। পিলারের নিচের অংশে আছে কালো একটি বেজ, যা শোকের প্রতীক। পিলারগুলো কিছু কালো সাপোর্ট (অরিজিনাল ডিজাইনে যা মেটালের ছিল এবং অনেক চিকন) দিয়ে সেই বেজের সঙ্গে সংযুক্ত, যেন রাতের বেলা এদের ভেসে থাকা কিছু প্রতীকী অবয়ব মনে হয়, যারা অসম্ভব সাহসের প্রতীক। পিলারের মাঝের কংক্রিট অংশটা আবরারের মতো চরিত্রগুলোর দৃঢ়তার প্রতীক, যারা শত প্রতিকূলতায় টিকে থাকে তাদের আদর্শে। উপরের জং ধরা মেটালের অংশে আছে কিছু ছিদ্র, যা শোষকের আঘাতে আর বুলেটে জর্জরিত শোষিতের দেহকে তুলে ধরে। জং ধরা মেটাল মনে করায় আবরারের মতো অসংখ্য শহীদ আর নির্যাতিতদের কথা যাদের রক্ত শুকিয়ে গেলেও তারা আমাদের মনে ভাস্বর হয়ে আছে অনন্ত অসীমকালের জন্য। রাতের বেলা সেই ক্ষত-বিক্ষত দেহ থেকে আবার ঠিকরে বের হয় আলো, যা নতুন পথিকদের পথ দেখায়। উপরের দিকে ছুড়ে দেওয়া আলো মনে করায় তাদের অনন্ত অসীমের পথে যাত্রার কথা, যা দূর থেকেও অনুপ্রেরণা জোগায়।

এ উদ্যোগে শুরু থেকে বাস্তবায়নের জন্য কাজ করেছেন এম ওয়ালি উল্লাহ (সেশন ২০১৩-১৪), শামসুজ্জামান সম্রাট (সেশন ২০১৬-১৭), আলী আম্মার মুয়াজ (সেশন ২০১৬-১৭), আবরার ফাইয়াজসহ অনেকে। সিটি করপোরেশন, বুয়েট, ট্রাফিক বিভাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে কাজটির গুরুত্ব বোঝানো এবং দ্রুত বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করেছেন তারা।

এনসিপি নেতা আখতার হোসেন ও তার টিম প্রজেক্টটি বাস্তবায়নের জন্য পেছনে থেকে কাজ করেছেন। নামকরণ ও আইডিয়া দিয়ে সাহায্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া কাজটি দ্রুত সম্পাদন করতে নিজে এর তত্ত্বাবধান করেছেন। সিটি করপোরেশনের এক ঝাঁক ইঞ্জিনিয়ার, ঠিকাদার ও নির্মাণশ্রমিক দিন-রাত কাজ করে নির্দিষ্ট দিনের ভেতর এটি বাস্তবায়ন করেছেন। সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় কাজটি দ্রুত সম্পন্ন হয়ে এখন তা বাস্তবে দাঁড়িয়ে আছে সেই পলাশীর চত্বরে।

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন সূত্র জানায়, আগ্রাসনবিরোধী আট স্তম্ভ নির্মাণে ব্যয় হয়েছে ৩৯ লাখ ৫৯ হাজার টাকা। তবে নিভৃতচারী স্থপতি নাজমুল হক নাঈম ডিজাইন কিংবা পারিশ্রমিক বাবদ কোনো টাকা গ্রহণ করেননি। প্রকল্পটি চলাকালে কেবল সুপারভিশনের জন্য তাকে আসা-যাওয়ার খরচ দেওয়া হয়েছে।

আগ্রাসনবিরোধী অবস্থানের কারণে ২০১৯ সালে ৭ অক্টোবর বুয়েটের তড়িৎ ও ইলেকট্রনিক প্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করে তৎকালীন ছাত্রলীগের বুয়েট শাখার সদস্যরা। নির্মম এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তীব্র আন্দোলনে অচল হয়ে পড়েছিল দেশে প্রকৌশল শিক্ষার সর্বোচ্চ প্রতিষ্ঠান বুয়েট। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল সারা দেশে।