রেহনুমা বিনতে আনিস (Rehnuma Bint Anis)
কথা হচ্ছিল ব্রিটিশ সহকর্মী আমিনার সাথে। কথায় কথায় বাড়ি কেনার প্রসঙ্গ উঠে এলো। সুদভিত্তিক পদ্ধতির কারণে মুসলিমদের জন্য অ্যামেরিকা-ক্যানাডা-অস্ট্রেলিয়ার মতই ব্রিটেনেও বাড়ি কেনা কঠিন। একসাথে বাড়ির দাম পরিশোধ করার মত পয়সা অধিকাংশ ব্যক্তির পক্ষেই সঞ্চয় করা সম্ভব হয়ে ওঠেনা। পক্ষান্তরে সুদ হারাম হওয়ায় মুসলিমরা সুদে বাড়ি কেনার কথা চিন্তাও করেনা। আমিনা বলল, “আল্লাহ তা’লা কুর’আনে সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। এতদসত্ত্বেও আমি ব্রিটেনে ভারতীয়-বাংলাদেশী-পাকিস্তানী মুসলিমদের মাঝে সুদে বাড়ি কেনার প্রবণতা দেখে অবাক হয়েছি”। ইসলামের প্রতি ভালবাসা আমিনাকে ব্রিটেন থেকে সৌদি আরব টেনে এনেছে। ওকে কিভাবে বোঝাব কেন আমার স্বজাতীয়রা এত কঠিন হুমকিসত্ত্বেও সুদে বাড়ি কিনতে উদ্বুদ্ধ হয়? ওকে বললাম, “আমাদের বৈষয়িক মনমানসিকতা এবং পারিবারিক চাপ অনেক বেশি। তাই হয়ত অনেকে দুনিয়ার বাড়ির জন্য আখিরাতের বাড়ি বিক্রি করে দেয়”।
ক্লাসের সময় হয়ে গেছিল। আমিনা বলল, “তোমার কথা শুনে একটা ঘটনা মনে পড়ল। ক্লাস শেষে শোনাব ইনশা আল্লাহ”।
ক্লাস শেষ, ছাত্ররা সব বাড়ি ফিরে গিয়েছে, কিছুক্ষণ কাজ সেরে আমরাও রওয়ানা দেব। এ’সময় আমিনা আর আমি লেডিস লাউঞ্জে একত্রিত হলাম। শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য নামাজকক্ষ, কিচেন, বড় বসার ঘর এবং দুটো অফিস নিয়ে এই লেডিস লাউঞ্জ আমাদের প্রশান্তির জায়গা। বসার ঘরটা আমরা ছাত্রী এবং কর্মীদের জন্য ছেড়ে দিয়েছি। একটা ঘর মহিলা শিক্ষকদের জন্য বরাদ্দ করা। এখানেই আমরা মাঝে মাঝে লাঞ্চের সময় এবং ক্লাস শেষে আড্ডা জমাই। আজ আমরা দু’জন ব্যতীত সবাই ব্যস্ত।
আমিনা বলল, “তুমি তো জানো আমাদের ছয় বোনের একটা মাত্র ভাই। সে শুধুমাত্র আমাদের সবচেয়ে ছোট বোনের বড়। আমাদের ব্রিটেনের বাসায় এখন শুধু আমার মা, এই ভাই আর আমার পিচ্চি বোনটা থাকে। একদিন ছোট বোন ফোন করে বলল, “ভাইয়া গতকাল থেকে অনবরত কাঁদছে। তুমি একটু ওর সাথে কথা বল”। আমি খুব অবাক হলাম। আমার ভাই ছয়ফুটের ওপর লম্বা, গাঁট্টাগোট্টা মানুষ। কান্নাকাটি ওর স্বভাবের সাথে যায়না।
“ওকে কল দিলে সে জানাল ওর এক বন্ধু মারা গিয়েছে। ছেলেটা পাকিস্তানী বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ। বুঝলাম। মন খারাপ হওয়াটা স্বাভাবিক। এত অল্প বয়সী একটা ছেলে! কিন্তু এতটা ভেঙ্গে পড়া আমার ভাইয়ের জন্য স্বাভাবিক নয়। আরো জিজ্ঞেস করার পর সে জানাল ছেলেটা বাবা মায়ের পছন্দে বিয়ে করেছিল, দু’টো ফুটফুটে সন্তান ছিল তার। ভালই চলছিল সব। কিন্তু বাচাকাচ্চা হবার পর বৌয়ের মাথায় খেয়াল চাপল, “কতদিন আমরা নিজেদের পয়সায় ভাড়া দিয়ে অন্যের ঘরের মর্টগেজ টানব? কেনই বা টানব? বরং এই পয়সা দিয়ে নিজেরা বাড়ি কিনতে পারি”। ছেলেটা বৌকে বুঝাতে চেষ্টা করল, সুদ বড় ভয়াবহ জিনিস, সুদের সাথে সংশ্লিষ্ট সকলকে আল্লাহ অভিশাপ দিয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে তিনি এবং তাঁর রাসূল যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং আখিরাতে এই ব্যক্তিবর্গ আল্লাহর ক্রোধের শিকার হবে। বৌ বুঝতে নারাজ।
“এক পর্যায়ে সে নিজে বাবামায়ের শরণাপন্ন হল, তাঁরা যেন পুত্রবধূকে বুঝান। আশ্চর্যজনকভাবে, তাঁরা বৌয়ের পক্ষ অবলম্বন করলেন। তাঁরা পুত্রকে বুঝালেন, “তোমার ভাল চাকরী হয়েছে, রয়েছে বৌ, দুটো বাচ্চা। একজন সক্ষম পুরুষ হিসেবে বৌয়ের এই দাবী পূরণ করা তোমার দায়িত্ব”।”
আমিনার গল্পের এই পর্যায়ে আমার এই আয়াতটা মনে পড়ছিল, “হে মুমিনগণ, তোমাদের কোন কোন স্ত্রী ও সন্তান সন্ততি তোমাদের দুশমন” (৬৪:১৬)। কিন্তু যার বাবামা অবুঝ হয়, তার পরীক্ষা ইবরাহীম আ-এর সমতুল্য অথচ আমরা কেউ আল্লাহর নবীদের পায়ের নখের সমতুল্য নই। ছেলেটার জন্য আমার হৃদয় হাহাকার করছিল।
আমিনা বলল, “এই পর্যায়ে ছেলেটা আমার ভাই ও অন্যান্য বন্ধুদের পরামর্শ চাইল। এরা সব অল্পবয়সী ছেলেপেলে। এমনও নয় যে এরা খুব জ্ঞানীগুণী বা প্র্যাক্টিসিং। কিন্তু এদের বুঝ এতটুকু পরিষ্কার ছিল যে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল সুদের দাতা-গ্রহীতা-হিসাবরক্ষক-সাক্ষী সবার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তারা বন্ধুকে বুঝাল, “তুমি শয়তানের ওয়াসওয়াসায় নতি স্বীকার করোনা। ওদের বুঝাও। নিশ্চয়ই তাঁরা বুঝবেন”।
“কিন্তু তাঁরা বুঝতে রাজী হলেন না। অবস্থা আরো ঘনীভূত হল। বৌ রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে দিল, বাবামাও তথৈবচ। ছেলেটা দিশাহারা হয়ে আবার বন্ধুদের কাছে আসল, “আমি কি করব বুঝে পাচ্ছিনা, নাকি বাড়ি কিনেই ফেলব? কিন্তু মন কিছুতেই সায় দিচ্ছেনা”। বন্ধুরা বুঝালো, “অস্থির হয়ে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে বসোনা। একটু ধৈর্য্য ধর, আল্লাহ নিশ্চয়ই কোন উপায় করে দেবেন”।
“ছেলেটা কিছুদিন নিজের সাথে যুঝে সিদ্ধান্ত নিলো, “এভাবে যুদ্ধ করতে থাকলে আমি নিজেই দুর্বল হয়ে যাব। আমার ঈমানের দৃঢ়তা বৃদ্ধি করার জন্য আমার আরো লেখাপড়া করা প্রয়োজন”। সে এক বছরের জন্য মিশরে গিয়ে ইসলাম নিয়ে লেখাপড়া করার সিদ্ধান্ত নিলো। বন্ধুরা বলল, “মিশরের মুদ্রার মূলা অনেক কম। তোমার কিছু টাকাপয়সা জমা আছে, আমরা সবাই মিলে মাসে একশ পাউন্ড করে দিলেও তুমি অনায়াসে এক বছর পড়াশোনা করতে পারবে”।”
এই পর্যায়ে আমার মনে হচ্ছিল ভাল বন্ধু আল্লাহর তরফ থেকে অনেক বড় নেয়ামত। আল্লাহ নিজেও বলেছেন, বন্ধু পরিমণ্ডল মানুষকে জান্নাতে নিতে পারে, কিংবা জাহান্নামে। আল্লাহ আমাকে যাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত করেছেন, তাদের জন্য শুকরিয়া করলাম।
আমিনার গল্প আরো হৃদয়বিদারক দিকে মোড় নিলো। ছেলেটির সিদ্ধান্ত শুনে বৌ দুই বাচ্চা নিয়ে চলে গেল, সে কিছুতেই ব্রিটেন ছেড়ে কোথাও যাবেনা। ছেলেটা ভাঙা মন নিয়ে একাই মিশরে পাড়ি জমাল। সেখানে সে ভালই পড়াশোনা করছিল, নিজেকে একটু একটু করে গড়ে তুলছিল যেন সে নিজের পরিবারকে বোঝানোর যোগ্যতা অর্জন করেতে পারে।
আমিনা বলে চলল, “আমার ভাই জানালো, “সেদিন ছিল জুমা। মসজিদে সবাই ছিল, কিন্তু আমাদের সেই বন্ধু ছিলোনা। জুমার পর সহপাঠীরা তার বাসায় গেল, অসুস্থ কিনা, নাকি কোন সমস্যা। গিয়ে দেখল সে জুমার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, বেরোবার পূর্বমূহূর্তে তার সময় ফুরিয়ে যায়, সে সেখানেই ঢলে পড়ে। রবের কাছে হাজিরা দেয়ার জন্য প্রস্তুত অবস্থায় তার প্রভু তাকে নিজের সান্নিধ্যে নিয়ে যান”।”
নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বুক ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো। আমরা কি ফিরে যাবার জন্য প্রস্তুত?
আমিনা এই বিষয়ে ওর ভাবনাটা তুলে ধরল, “দেখ রেহনুমা, ছেলেটা দুনিয়াতে আসার আগেই আল্লাহ ওর মৃত্যর সময় নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। সে যদি সেই দুর্বল মূহূর্তে আল্লাহর কাছে ফিরে যেত, যখন সে ভাবছিল পরিবারের চাপে বাড়ি কিনেই ফেলবে কিনা, তাহলে আসে আল্লাহর সামনে কি নিয়ে দাঁড়াত? আল্লাহ তাকে সুযোগ দিয়েছেন, ঈমানের সর্বোচ্চ স্তরে তাকে নিজের কাছে ফিরিয়ে নিয়েছেন। আমি অনেককে দেখেছি, স্বামীস্ত্রী একমত হয়েই বাড়ি কিনেছে, কিন্তু আল্লাহ তাদের ওপর থেকে তাঁর বারাকাহ উঠিয়ে নিয়েছেন। হয় পরিবারে অসুস্থতা, নয় একের পর এক বিপদ, অথবা বাড়ি রয়ে গিয়েছে অথচ স্বামীস্ত্রী ছাড়াছাড়ি হয়ে গিয়েছে। কি হবে এই বাড়ি দিয়ে? দুনিয়ার বাড়ির জন্য জান্নাতের বাড়ি ছেড়ে দিয়ে কি পোষায়?”
আমিনা জানালো, সে সময় সে জেদ্দায় থাকত, মক্কায় যাওয়া-আসা সহজ ছিল। ভাইয়ের অনুরোধে সে ছেলেটির নামে ওমরাহ করে। কি সৌভাগ্য ছেলেটির! সে নিজের ঈমান বাঁচিয়ে তার রবের সামনে উপস্থিত হতে পেরেছে।
আমার হৃদয় থেকে আপনিই দু’আ উত্থিত হল, “হে প্রভু, তাকে জান্নাতে তোমার কাছাকাছি একটা বাড়ি দিয়ো। তার পরিবারকে তোমার পক্ষ থেকে বুঝার ক্ষমতা দিয়ো। আমাদের পথ দেখিয়ো, যেন শয়তানের পদাঙ্ক অনুসরণ করতে গিয়ে আমাদের আর কোন ঘর না ভাঙ্গে”।