
প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনের সঙ্গে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে যোগাযোগ ব্যাপকভাবে ত্বরান্বিত হচ্ছে। এতে বিনোদন ও যোগাযোগের নানা মাধ্যম একদিকে জীবন সহজ করছে, অন্যদিকে এতে আসক্ত হয়ে পড়েছে শিশু-কিশোর ও তরুণ প্রজন্ম থেকে সব বয়সিরা। মোবাইল ফোনকে ঘিরে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম তাদের জীবনের এক বড় অংশ হয়ে পড়েছে। পড়াশোনা, আড্ডা, বিনোদন ও কর্মক্ষেত্রসহ সবকিছুতেই এর প্রভাব প্রতিফলিত হচ্ছে। এতে একাকিত্ব ও মানসিক চাপ বেড়েই চলেছে। ফলে শুধু সুবিধা নয়, মোবাইল ফোনের সর্বগ্রাসী থাবায় নতুন প্রজন্ম। অন্যদিকে স্মার্ট ডিভাইসকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত জনপ্রিয়তা ও আয়ের লোভ অনেক তরুণকে নৈতিকতা হারাতে বাধ্য করছে।
বর্তমানে শিশু, কিশোর, তরুণ এমনকি প্রবীণদের ওপর এর প্রভাব দৃশ্যমান হয়েছে। নেদারল্যান্ডসভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘সায়েন্সডিরেক্ট ডটকম’-এর তথ্য বলছে, বিশ্বজুড়ে মুঠোফোন আসক্ত ২৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ মানুষ, তার মধ্যে ১৪ দশমিক ২২ শতাংশ মানুষ ইন্টারনেট আসক্ত। অন্যদিকে বাংলাদেশের আঁচল ফাউন্ডেশনের জরিপে দেখা গেছে, দেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে ৫১ শতাংশ ইন্টারনেট ব্যবহারের প্রতি আসক্তি অনুভব করে। সরকারের ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সির আরেকটি জরিপের তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩ কোটি মানুষ দৈনিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয়। এর মধ্যে ১২ লাখ তরুণ নিয়মিত কনটেন্ট তৈরি করে মনিটাইজেশনে চেষ্টা করেন। তবে তাদের একটি বড় অংশ কেবল ভিউ ও লাইক বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিচ্ছেন।
ইন্টারনেট আসক্তি নিয়ে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের এক জরিপের তথ্য অনুযায়ী, ব্যবহারকারীদের মধ্যে ১০ থেকে ১৪ বছরের শিশুর সংখ্যা (১ কোটি ৭০ লাখ) ১০ দশমিক ৮ শতাংশ, ১৫ থেকে ২৫ বছরের তরুণের সংখ্যা (৩ কোটি ২০ লাখ) ২৬ শতাংশ। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ ভিডিও দেখেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যস্ত থাকেন ৫৫ দশমিক ৯ শতাংশ, গেমিংয়ে সময় ব্যয় করেন ৫৪ দশমিক ৫ শতাংশ। ব্যবহারকারীদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করেন ৭৯ দশমিক ৪ শতাংশ, ল্যাপটপ ৩ দশমিক ৯ শতাংশ, সাধারণ মোবাইল ফোন ৪ দশমিক ৫ শতাংশ, ডেস্কটপ ২ দশমিক ৮ শতাংশ। এ প্রসঙ্গে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. তৈয়বুর রহমান রয়েল যুগান্তরকে বলেন, মোবাইল ফোন, ট্যাব ও কম্পিউটারের অতিরিক্ত ব্যবহার ও অপব্যবহারে শিশু-কিশোর তরুণ থেকে সব বয়সিরা শারীরিক ও মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এতে পরবর্তী সময়ে তাদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের রোগ তৈরি হতে পারে। বিশেষ করে ঘুমের ব্যাঘাত হওয়া। অনেকে মানসিক চাপ ও হতাশা কাটাতে অ্যালকোহল বা মাদকদ্রব্যের আশ্রয় নিতে পারে। পরিবার-স্বজনদের সঙ্গে দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা দেখা দিতে পারে। এছাড়া বিষণ্নতা, হতাশা, একিউট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার ও পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডারের মতো রোগ সৃষ্টি হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ধরনের রোগকে আমলে নেওয়া হয় না। এ পরিস্থিতিতে আক্রান্তদের মানসিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্ব দিতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহজাবীন হক যুগান্তরকে বলেন, টেকনোলজির ব্যবহার যদি আমরা না শিখি তাহলে এটার নেতিবাচক প্রভাব আমাদের বয়ে বেড়াতে হবে। এটা একটা জেনারেশনের পর আরেকটা জেনারেশনে প্রভাবিত হবে। একটা শিশু খাচ্ছে না, তার বাবা-মা তার হাতে গ্যাজেট তুলে দিচ্ছে। কার্টুন দেখে খাচ্ছে। তাকে চুপ করার একটাই হাতিয়ার। এতে হয়তো বাবা-মার পরিত্রাণ হলো ওই মুহূর্তের জন্য, কিন্তু ক্ষতি হচ্ছে বাচ্চার। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনার খাতিরেও স্মার্টফোন ব্যবহার করতে হচ্ছে। তাদের যোগাযোগ, এন্টারটেইনমেন্ট, পরীক্ষা বা নোটিশের বিষয়গুলো সব অনলাইনে আসছে। তাদের পুরোপুরি আপনি বিচ্ছিন্ন করতে পারছেন না। বড়দের ক্ষেত্রে কিন্তু এখানেই থাকতে হচ্ছে, কারও কারও পুরো কাজে অনলাইনে থাকতে হচ্ছে। এতে তার মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর, তার আচরণ ও শরীরের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের মানসিক রোগ ও মাদকাসক্তি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. মো. মুনাইম রেজা মুনিম যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে শিশু-কিশোরদের মধ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বিনোদনের অন্যান্য মাধ্যমের অভাব। যেমন শহরে অধিকাংশ শিশু মাঠে খেলার সুযোগ পায় না। তাদের দিনের একটা বড় অংশ চলে যায় স্কুল-কোচিং-প্রাইভেটের পেছনে এবং বাকি সময়টার মধ্যেও তাদের সুস্থ বিনোদনের কোনো সুযোগ নেই।
ডা. মুনিম বলেন, মোবাইল ব্যবহার কতটুকু হওয়া দরকার এ ব্যাপারে অধিকাংশ পরিবারেই কোনো গাইডেন্স নেই। শুধু শিশু নয়, যে কেউই দীর্ঘ সময় স্মার্টফোন দেখলে তার আসক্তি তৈরি হয়ে যেতে পারে। আসক্তি থেকে বাঁচতে খেলাধুলা, ব্যায়াম ও চিত্রাঙ্কন করা, বই পড়ার মতো কাজে সময় বাড়াতে হবে। শুধু বাচ্চাদের স্মার্টফোন ব্যবহারে বাধা দিলেই হবে না, বড়দেরও সচেতন হতে হবে।