Image description
 

২০০৫ সালে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার অপারেটর হিসেবে জেলা প্রশাসনে যোগ দিয়েছিলেন জামাল উদ্দিন। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। ক্রমে তিনি জেলা প্রশাসনের ‘অঘোষিত হর্তাকর্তা’ হয়ে ওঠেন। সর্বশেষ পদায়নের সময় তার বেতন ছিল মাত্র ৩০ হাজার টাকা অথচ থাকতেন নগরীর কোর্ট রোডের দেড় কোটি টাকা মূল্যের ডাবল ফ্ল্যাটে। যা কেনেন ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে ৮৬ লাখ টাকায়।

 

গত ২৭ সেপ্টেম্বর ‘৩০ হাজার টাকার বেতনে দেড় কোটির ফ্ল্যাটে চট্টগ্রামের নাজির জামাল’ শিরোনামে আমার দেশে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পরদিনই তাকে নোয়াখালীতে বদলি করা হয়। সর্বশেষ ৮ অক্টোবর চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অবমুক্ত করা হয়েছে তাকে।

 

সরকারি কর্মচারী হয়েও কোনো নিয়ম-কানুনের তোয়াক্কা করতেন না জামাল। প্রশাসনের ভেতরে তিনি ছিলেন তদবির বাণিজ্য, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্য, ইজারা ও ভূমি লেনদেন কারবারের মূল নিয়ন্ত্রক। জেলা প্রশাসনের ভেতরে প্রচলিত কথা ‘ডিসি বদলায়, জামাল বদলায় না।’

 

স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর তিনি কিছুদিন গা-ঢাকা দিলেও পরে আবারও দাপটের সঙ্গে হাজির হন সার্কিট হাউজ ও প্রশাসনিক ভবনে। হাসিনার প্রতি অনুগত থাকা সত্ত্বেও বদলি হওয়া সাবেক ডিসি ফরিদা খানমের ঘনিষ্ঠ হিসেবে বহাল ছিলেন তিনি। অভিযোগ রয়েছে, জুলাই আন্দোলনের সময় জামাল আওয়ামী লীগের কর্মীদের খাবার ও অর্থ সরবরাহ করতেন। সরকার পতনের পর তার বিরুদ্ধে আদালত অঙ্গনে পোস্টার সাঁটিয়ে গ্রেপ্তার ও বিচারের দাবি তোলেন ভুক্তভোগীরা।

 

জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)-এ অভিযোগ জমা পড়েছে। আইনজীবীদের এক যৌথ অভিযোগপত্রে বলা হয়-মাসে ৩০ হাজার টাকার বেতনে থেকেও তিনি গড়ে তুলেছেন প্রায় ৪০ কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পদ। এর মধ্যে নগরীর কোর্ট রোডের ফ্ল্যাট ছাড়াও চন্দনাইশ উপজেলার গাছবাড়িয়া এলাকায় তার নামে-বেনামে সম্পদ ও দোকানঘর রয়েছে।

 

অভিযোগপত্রে দাবি করা হয়

 

দুদক যেন ১০ কার্যদিবসের মধ্যে তদন্ত শুরু করে, তার ব্যাংক হিসাব জব্দ করে এবং বিদেশে পালানোর সম্ভাবনা ঠেকাতে আদালতের মাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা জারি করে।

 

অভিযোগকারী আট আইনজীবী হলেন-অ্যাডভোকেট এম শফিকুল আলম, আজিমউদ্দিন পাটোয়ারী, ইয়াছিন আলফাজ, মহি উদ্দীন, নাদিম মাহমুদ, সৈয়দ ওয়াহিদ, সাইফুল্লাহ খালেদ ও শামীম পাটোয়ারী।

 

আইনজীবীরা অভিযোগে আরও উল্লেখ করেন, দুদকে আগেও সম্পদের হিসাব চাইলে জামাল উদ্দিন ইচ্ছাকৃতভাবে বেশিরভাগ সম্পদ গোপন করে মাত্র ১৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকার স্থাবর ও ২২ লাখ ৮৬ হাজার টাকার অস্থাবর সম্পদের তথ্য দেন। তার স্ত্রী রুনা আক্তারের নামে দেখানো হয় ৫৫ লাখ টাকার সম্পদ, যদিও বাস্তবে পরিমাণ এর বহু গুণ বেশি।

 

চট্টগ্রাম কর অঞ্চল-৪ এর আয়কর রিটার্ন অনুযায়ী, ২০২৪–২৫ অর্থবছরে তার সম্পদের পরিমাণ দেখানো হয়েছে মাত্র অর্ধকোটি টাকা। অথচ প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে বিভিন্ন হোটেল, রেস্তোরাঁ ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে আত্মীয়দের নামে বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করেছেন তিনি।

 

মুজিব বন্দনায়ও ছিলেন সবার আগে

 

দুদকে জমা দেওয়া নথিতে বলা হয়, নিজেকে ‘মুজিবপ্রেমী’ প্রমাণে জামাল উদ্দিন আওয়ামী ঘনিষ্ঠ চ্যানেল ও পত্রিকা ভাড়া করতেন, বক্তৃতা দিতেন বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনাকে নিয়ে। মুজিববর্ষ উপলক্ষে দেওয়া এক ভিডিও বক্তব্যে তিনি বলেন, শেখ মুজিবকে নিয়ে কথা বলতে গেলে দিনের পর দিন লাগবে। হাসিনা পৃথিবীর সেরা নেতা, তার মতো নেতৃত্ব ইতিহাসে আর আসবে না।

 

সহকর্মীরা বলেন, জামাল কোনো কর্মকর্তা না হয়েও কর্মকর্তা সেজে থাকতেন। তার আচরণে অহংকার, প্রভাব বিস্তার ও চাকরিবিধি লঙ্ঘন ছিল নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তার সঙ্গে যোগাযোগের জন্য একাধিকবার ফোন করা হলেও পাওয়া যায়নি।

 

চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনের কর্মচারীরা এখন বলছেন, ১৫ বছরের রাজত্বের অবসান সেই নাজির জামালের।