Image description

সাইফুল করিম ছিলেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ গোয়েন্দা সংস্থার মাদকসংক্রান্ত একাধিক তালিকার শীর্ষে। মিয়ানমার থেকে ইয়াবার বড় সব চালান নিয়ে বিক্রি করতেন বাংলাদেশে। ২০১৯ সালের ৩০ মে রাতে আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ নেতৃত্বাধীন দলের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারান তিনি। নিহতের ছয় বছর পর তার সম্পদ নিলামে তুলছে ব্যাংক।

‘ইয়াবা ডন’ খ্যাত সাইফুলের নেটওয়ার্ক ছিল বিশাল। কামিয়েছেন কাড়ি কাড়ি টাকা। কক্সবাজার ও চট্টগ্রামে একাধিক মাদক মামলা বাদেও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) দায়ের করা মামলারও আসামি ছিলেন তিনি। সাইফুল করিমের নেতৃত্বেই বাংলাদেশে প্রথম ইয়াবার চালান আনা হয় বলে কথিত আছে।

২০১৯ সালের ৩০ মে রাতে আলোচিত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ (বর্তমানে মেজর সিনহা হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত) নেতৃত্বাধীন দলের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারান সাইফুল। নিহত হওয়ার আগে বেশ কয়েক বছর কক্সবাজার জেলায় শীর্ষ করদাতা হিসেবে সিআইপি (ব্যবসা ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি) হওয়ার সম্মানও পান ওই সময়ের শীর্ষ এ ইয়াবা ডিলার। নিহত হওয়ার পর থেকে আলোচনার খাতায় ক্রমে নিচের দিকে চলে যায় অর্ধযুগ আগের এ ইয়াবা সম্রাটের নাম।

বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার ছয় বছর পর আবার আলোচনায় সাইফুল করিমের নাম। এবার সাইফুলের কাছ থেকে আট কোটি টাকার বেশি পাওনা আদায়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজারে তার স্থাবর সম্পদের নিলাম ডেকেছে বেসরকারি খাতের ইসলামী ব্যাংক। এ নিয়ে পত্রিকায় নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রামের ওআর নিজাম রোড শাখা।

 

ইসলামী ব্যাংকের নিলাম বিজ্ঞপ্তি

গত ৭ অক্টোবর পত্রিকায় প্রকাশিত নিলাম বিজ্ঞপ্তি অনুসারে জানা যায়, ইসলামী ব্যাংক ওআর নিজাম রোড শাখার খেলাপি গ্রাহক মেসার্স হানিফ ইন্টারন্যাশনালের কাছ থেকে গত ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকের আট কোটি ২১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩১ টাকা পাওনা আদায়ে কক্সবাজারের টেকনাফ, সদর থানা এবং চট্টগ্রাম নগরীর কোতোয়ালি থানা এলাকার চার তফসিলে ৭২ দশমিক ১৬ শতক জমি ও এর ওপর নির্মিত ফ্ল্যাট, দোকান ভবন নিলামে তোলে ইসলামী ব্যাংক ওআর নিজাম রোড শাখা।

ঋণটি ২০১২ সালের। ২০১৯ সালে সাইফুল করিম নিহত হওয়ার পর ব্যাংকের আর কোনো পাওনা শোধ করেননি। আমরা ২০১৯ সালের পর থেকে অনেক চেষ্টার পরেও পাওনা টাকা উদ্ধার করতে পারিনি। এরপর অর্থঋণের জন্য আমাদের কাছে মর্টগেজ করা তার সম্পদগুলো আমরা নিলামে বিক্রি করে পাওনা আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছি।- ইসলামী ব্যাংক ওআর নিজাম শাখার প্রধান এসভিপি মোহাম্মদ সানা উল্লাহ

নিলামে ডাকা সম্পত্তিগুলো ২০১২ এবং ২০১৪ সালে রেজিস্ট্রার্ড কবলামূলে ব্যাংকে বন্ধক রাখেন প্রতিষ্ঠানটির কর্ণধার সাইফুল করিম। বাবার নাম উল্লেখ করা হয় মোহাম্মদ হানিফ। অফিস ঠিকানা উল্লেখ করা হয়- এস বিল্ডিং (৩য় তলা), ১২৫ ব্রিজঘাট, ফিরিঙ্গি বাজার, কোতোয়ালি, চট্টগ্রাম।

বিজ্ঞপ্তিতে সাইফুল করিমকে ‘মরহুম’ উল্লেখ করে ঋণ নেওয়ার সময় দেওয়া নগরীর কোতোয়ালি থানার ফিরিঙ্গি বাজারের প্রাতিষ্ঠানিক ঠিকানা উল্লেখ করা হলেও স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানা উল্লেখ করা হয়নি। আগামী ২৯ অক্টোবর দুপুর ২টার মধ্যে দরপত্র জমা দেওয়া যাবে। ওইদিন বিকেল ৩টায় দরপত্র খোলা হবে বলে বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।

এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংক ওআর নিজাম শাখার শাখাপ্রধান এসভিপি মোহাম্মদ সানা উল্লাহ জাগো নিউজকে বলেন, ‘ঋণটি ২০১২ সালের। ২০১৯ সালে সাইফুল করিম নিহত হওয়ার পর ব্যাংকের আর কোনো পাওনা শোধ করেননি। এর মধ্যে তার স্ত্রী হামিদা বেগম ও সাইফুল করিমের সম্বন্ধি টেকনাফের আবদুল্লাহর সঙ্গে কথা হয়। তার স্ত্রীর সঙ্গে এখনো কথা হচ্ছে। আমরা ২০১৯ সালের পর থেকে অনেক চেষ্টার পরেও পাওনা টাকা উদ্ধার করতে পারিনি। এরপর অর্থঋণের জন্য আমাদের কাছে মর্টগেজ করা তার সম্পদগুলো আমরা নিলামে বিক্রি করে পাওনা আদায়ের উদ্যোগ নিয়েছি।’

বন্দুকযুদ্ধে মৃত্যুর ৬ বছর পর নিলামে ‘ইয়াবা ডন’ সাইফুলের সম্পদ

ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা হিসেবে ব্যবহার করা বাড়ি

তিনি বলেন, ‘পাওনা টাকার মধ্যে তিন কোটি ৬৮ লাখ টাকার মতো প্রিন্সিপাল (আসল ঋণ)। ২৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মুনাফাসহ পাওনা আট কোটি ২১ লাখ ২৭ হাজার ৬৩১ টাকা দাঁড়িয়েছে।’

ব্যবসায়িক ঠিকানা ছিল ভুয়া

ব্যাংক প্রকাশিত নিলাম বিজ্ঞপ্তিতে সাইফুল করিমের ব্যবসায়িক ঠিকানা নগরীর কোতোয়ালি থানাধীন ফিরিঙ্গি বাজারের ১২৫ ব্রিজঘাটের এস বিল্ডিংয়ের তৃতীয় তলায় গিয়ে দেখা যায়, এটি একটি বাসা। বিল্ডিংয়ের গায়ে সালাম ম্যানশন খোদাই করা। তবে স্থানীয়রা এটিকে এস বিল্ডিং হিসেবেই চেনেন। বাসার কলিংবেল টিপলেই একজন নারী বেরিয়ে বলেন, ‘এটি অফিস নয়। এটি ফ্যামিলি বাসা।’ ওই বিল্ডিংয়ের নিচতলার একটি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী বলেন, ‘এখানে হানিফ ইন্টারন্যাশনাল নামে কোনো প্রতিষ্ঠান নেই। বিল্ডিংয়ের মালিক সালাম সাহেবের ছেলে পরিবার নিয়ে ওই বাসায় থাকেন। আছদগঞ্জে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান।’

সাইফুল করিমের স্ত্রী হামিদা বেগমের বিরুদ্ধে গত এপ্রিলে ৩৪ লাখ টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন। হামিদা বেগমের সম্পদ বিবরণীতে চট্টগ্রাম নগরীর ভিআইপি টাওয়ারের একটি ফ্ল্যাট উল্লেখ রয়েছে। এটি ইসলামী ব্যাংকে মর্টগেজ হিসেবে রয়েছে বলে সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেন হামিদা বেগম।- দুদক কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান

এরপর নিলাম ডাকা নগরীর কাজীর দেউড়ির ভিআইপি টাওয়ারের সি-১০-১ ফ্ল্যাটের খোঁজে গিয়ে জানা যায়, ফ্ল্যাটটি সাইফুল করিমের স্ত্রী হামিদা বেগমের নামে। ওই ফ্ল্যাটে হামিদা বসবাস করেন। নিলামকারী সেজে ফ্ল্যাটটি দেখতে বুধবার দুপুরে ভিআইপি টাওয়ারের সি ব্লকে গেলে রিসিপশনে থাকা নিরাপত্তা প্রহরী সি-১০-১ ফ্ল্যাটের কেয়ারটেকার আবুল কালামকে ডেকে আনেন। এসময় আবুল কালাম প্রতিবেদককে বলেন, ‘ম্যাডাম (হামিদা বেগম) টেকনাফে গিয়েছেন। বাসায় কেউ নেই।’ আবুল কালাম চার বছর ধরে ওই বাসায় কেয়ারটেকার হিসেবে রয়েছেন বলে জানান।

সাইফুল করিম ও তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা

নিহত হওয়ার মাত্র একমাস আগে ২০১৯ সালের ৩০ এপ্রিল অবৈধ সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিংয়ের অভিযোগে সাইফুল করিমের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক। দুদক চট্টগ্রাম সমন্বিত জেলা কার্যালয়-২ এর তৎকালীন উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন বাদী হয়ে নগরীর ডবলমুরিং থানায় মামলাটি দায়ের করেন। বর্তমানে ওই মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে জানা যায়নি।

এদিকে সাইফুল করিমের স্ত্রী হামিদা বেগমের সম্পদ বিবরণী পর্যালোচনা করে অবৈধ সম্পদ অর্জনের সত্যতা পায় দুদক। এ নিয়ে চলতি (২০২৫) সালের এপ্রিলে জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে হামিদা বেগমের বিরুদ্ধে মামলা করে দুদক কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়।

এ বিষয়ে দুদক কক্সবাজার সমন্বিত জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান জাগো নিউজকে বলেন, ‘সাইফুল করিমের স্ত্রী হামিদা বেগমের বিরুদ্ধে গত এপ্রিলে ৩৪ লাখ টাকা জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে তদন্তাধীন। হামিদা বেগমের সম্পদ বিবরণীতে চট্টগ্রাম নগরীর ভিআইপি টাওয়ারের একটি ফ্ল্যাট উল্লেখ রয়েছে। এটি ইসলামী ব্যাংকে মর্টগেজ হিসেবে রয়েছে বলে সম্পদ বিবরণীতে উল্লেখ করেন হামিদা বেগম।’