Image description

টেকসই পারমাণবিক সংযোজন শক্তি উৎপাদনের পথে বড় অগ্রগতি অর্জন করেছেন চীনা গবেষকরা। তারা এমন এক নতুন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) নির্ভর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরি করেছেন, যা ‘কৃত্রিম সূর্য’ নামে পরিচিত টোকামাক রিঅ্যাক্টরের প্লাজমাকে আরও স্থিতিশীল ও নিয়ন্ত্রিত রাখতে সক্ষম বলে দাবি করা হচ্ছে। নেচার প্রকাশনীর অধীনস্থ কমিউনিকেশনস ফিজিকস জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণাপত্রে এই তথ্য উঠে এসেছে।

 

সংযোজন শক্তি বা ফিউশন এনার্জি হলো এমন এক প্রক্রিয়া, যেখানে সূর্যের মতোই হালকা পরমাণুর কেন্দ্র একত্র হয়ে বিপুল পরিমাণ শক্তি উৎপন্ন করে, যা সম্পূর্ণ কার্বনমুক্ত। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে টোকামাক নামে পরিচিত এই ডোনাট-আকৃতির রিঅ্যাক্টরের মাধ্যমে এমন শক্তি উৎপাদনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, যাকে বলা হয় “মানুষের তৈরি সূর্য”।

তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল অত্যন্ত উত্তপ্ত প্লাজমাকে দীর্ঘসময় স্থিতিশীল রাখা এবং এমনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাতে রিঅ্যাক্টরটি ব্যবহারের তুলনায় বেশি শক্তি উৎপাদন করতে পারে।

 

এতদিন পর্যন্ত এই নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নির্ভর করত জটিল পদার্থবিজ্ঞানের মডেল ও প্রথম-নীতির সিমুলেশনের ওপর, যা নির্ভুল হলেও অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও কম্পিউটেশনালভাবে ব্যয়বহুল ছিল। ফলে নতুন প্রজন্মের এআই-ভিত্তিক কন্ট্রোলার প্রশিক্ষণ দেওয়া কঠিন হয়ে উঠেছিল।

 

এই সীমাবদ্ধতা কাটাতে দক্ষিণ-পশ্চিম পদার্থবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের গবেষকরা ঝেজিয়াং বিশ্ববিদ্যালয় ও ঝেজিয়াং ল্যাবের সঙ্গে যৌথভাবে তৈরি করেছেন একটি উচ্চমানের ডেটা-নির্ভর মডেল। এটি সম্পূর্ণভাবে চীনের সবচেয়ে উন্নত ম্যাগনেটিক ফিউশন যন্ত্র হুয়ানলিউ-৩ (HL-3) টোকামাকের পূর্ববর্তী পরীক্ষার তথ্য ব্যবহার করে প্রশিক্ষিত করা হয়েছে।

নতুন মডেলটিতে ব্যবহৃত হয়েছে আধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি যেমন ‘লং শর্ট-টার্ম মেমরি’ (LSTM) নেটওয়ার্ক, যা ধারাবাহিক তথ্য থেকে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক শেখার সক্ষমতা রাখে। এর সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে ‘সেলফ-অ্যাটেনশন’ প্রক্রিয়া ও ‘শিডিউলড স্যাম্পলিং’ প্রযুক্তি। এই সমন্বয়ে মডেলটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে প্লাজমার মূল উপাদান যেমন কারেন্ট ও আকারের পরিবর্তন অত্যন্ত নির্ভুলভাবে পূর্বাভাস দিতে পারে এবং প্রচলিত সিমুলেশনে সাধারণত দেখা দেওয়া ত্রুটির সঞ্চয় এড়াতে সক্ষম হয়।

গবেষক দলটি ইতোমধ্যেই HL-3 রিঅ্যাক্টরের বাস্তব নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় এই এআই মডেল প্রয়োগ করেছে। পরীক্ষায় দেখা গেছে, অচেনা পরিবেশেও সিস্টেমটি স্থিতিশীলভাবে কাজ করেছে এবং শূন্য প্রশিক্ষণ দিয়েও নতুন পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে নিতে পেরেছে, যা বিজ্ঞানীরা “জিরো-শট জেনারালাইজেশন” হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

গবেষকরা বলছেন, এই প্রযুক্তি ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংযোজন প্রকল্প যেমন ITER এবং বাণিজ্যিক ফিউশন রিঅ্যাক্টরের জন্য আরও দ্রুত ও দক্ষ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তৈরিতে নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে। এটি মানবজাতিকে এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেল সেই কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য—অসীম, পরিচ্ছন্ন ও টেকসই শক্তির উৎসের দিকে।