Image description

প্রতি বছর বোরো ও আলুর মৌসুমে উত্তরাঞ্চলের কৃষকের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়ে। সার, বীজ ও কীটনাশকের পাশাপাশি সেচের পানির জন্য লাখ লাখ ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকের উদ্বেগ-উত্কণ্ঠা বেড়ে যায়। কারণ এই অঞ্চলের কৃষিতে বিপ্লব আনা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ) এখনো সবার জন্য ‘বিতর্ক, হয়রানি ও দুর্নীতি মুক্ত’ সেচের পানি সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারেনি। অথচ উত্তরাঞ্চলের কৃষিতে সেচকে কেন্দ্র করেই প্রতিষ্ঠানটির যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে।

অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন ও অতিমাত্রায় ভূ-গর্ভস্থ পানি উত্তোলনের ফলে বরেন্দ্র অঞ্চলে পানির স্তরের দ্রুত নিচে নেমে যাওয়ার প্রবণতা বিএমডিএকে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ সুযোগে সবসময় ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বিএমডিএর কতিপয় অসাধু কর্মকর্তার যোগসাজশে গভীর নলকূপের অপারেটররা প্রকাশ্যে ‘সেচ বাণিজ্য’ চালায়। এ ঘটনাকে অতীতের জমিদারি ব্যবস্থায় কৃষক শোষণের সঙ্গে তুলনা করে ভুক্তভোগীরা বলেন, ‘বর্তমানের বিএমডিএ’র গভীর নলকূপ অপারেটররা যেন সেই জমিদারের উমেদারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। কিন্তু ভুক্তভোগীরা প্রকাশ্যে মুখ খোলেন না সেচের পানির বঞ্চনা ও জমির নিয়ন্ত্রণ হারানোর ভয়ে।

জানা যায়, বিএমডিএর গভীর নলকূপের অপারেটরদের বিরুদ্ধে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সেচের পানির ফাঁদে ফেলে শোষণের অভিযোগ দীর্ঘদিনের। অভিযোগ মতে, নীতিমালা অনুসারে সেচ না দিয়ে অতিরিক্ত টাকার জন্য নানা অজুহাতে কৃষকদের হয়রানি, সেচের জন্য নগদ অর্থ গ্রহণ, সেচের মূল্য নিয়ে বৈষম্য ও স্বজনপ্রীতি, স্কিমের আওতার বাইরের জমিতে উচ্চমূল্যে সেচ প্রদান এবং আওতাভুক্ত স্কিমের জমির লিজ নিয়ন্ত্রণ করেন অপারেটররা।

ভুক্তভোগীরা বলেন, সেচের পানি সরবরাহে অপরেটরের হয়রানি ও দুর্নীতির প্রতিবাদে রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর দুই কৃষক অভিনাথ মারান্ডি (৩৭) ও রবি মারান্ডি (২৭) বোরোর জমিতেই বিষ পান করেন। ২০২২ সালের ২৩ মার্চের এ ঘটনা দেশ জুড়ে আলোচিত হয়। অভিযুক্ত ঈশ্বরীপুর-২ নলকূপ অপারেটর ও তত্কালীন ওয়ার্ড কৃষক লীগের সভাপতি সাখাওয়াতকে পুলিশ গ্রেফতার করে। আসামি বর্তমানে জামিনে আছেন। ভুক্তভোগী অভিনাথের স্ত্রীর আত্মহত্যার প্ররোচনার মামলা বিচারাধীন।

২০২৩ সালের ৯ এপ্রিল সেচের পানি না পেয়ে একই নলকূপের আওতাভুক্ত ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর আরেক কৃষক মুকুল সরেন কীটনাশক পান করেন। এসবের পরও অপারেটরদের বেপরোয়া বাণিজ্যের দৃশ্যমান পরিবর্তন হয়নি। বরং হয়রানি ও দুর্নীতি আরো বেড়েছে, তীব্র হয়েছে সেচসংকট। কমেছে বোরো ধানের আবাদ। মৃত দুই কৃষকের দুই ভাই বলেন, ‘ভাই সেচের পানি না পাওয়ার দুঃখে মারা গেল। কিন্তু আমরা এখনো সেচের পানি পাই না।’

সূত্র মতে, তখন ঐ গভীর নলকূপে সেচের পানি সরবরাহে অনিয়ম, অপারেটরের স্বজনপ্রীতি, দুর্ব্যবহার ও অতিরিক্ত টাকা আদায়ের সত্যতা পেয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি। বিএমডিএর তদন্ত প্রতিবেদনেও অনিয়মের চিত্র উঠে আসে।

এদিকে গত বছর ২৯ ফেব্রুয়ারি সেচের পানি বিতরণে হয়রানি ও দুর্নীতি বন্ধের দাবিতে রাজশাহী শহরের অবস্থান এবং বিএমডিএ প্রধান কার্যালয় ঘেরাও কর্মসূচি পালন করে ‘বাংলাদেশ কৃষক সমিতি।’ ঐ দিন বিএমডিএকে দেওয়া স্মারকলিপিতে সমিতির নেতৃবৃন্দ সেচে ‘হয়রানি ও দুর্নীতি’ বন্ধ, খাল ও জলাশয় সংস্কার, সেচের জন্য সার্বক্ষণিক বিদ্যুত্ সুবিধা নিশ্চিত করা, সার ও কীটনাশকের মূল্য হ্রাস, প্রকৃত কৃষককে কৃষি কার্ড প্রদান এবং ভূ-উপরিস্থ পানি সংরক্ষণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করার দাবি জানান। বাংলাদেশ কৃষক সমিতির নেতারা দুর্নীতিতে জড়িত অপারেটরদের নিয়োগ বাতিল ও শাস্তির দাবি জানান।

গোদাগাড়ীর ৫০টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠী গ্রামে খাদ্যনিরাপত্তায় আন্দোলনরত ‘রক্ষাগোলা গ্রাম সমাজ সমন্বয় কমিটির সভাপতি সরল এক্কা বলেন, ‘সেচের পানি সরবরাহে সব নাগরিককে সমানভাবে দেখা হয় না। এই বৈষম্য কেনো থাকবে? আলুর পর বোরো মৌসুমেও বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকদের জিম্মি করে অপারেটররা সেচের জন্য নির্ধারিত মূল্যের কয়েক গুণ অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেছে। যেসব কৃষক অনৈতিক দাবির প্রতিবাদ করেন, তাদের জমিতে সেচ বন্ধ করে বন্ধ দেন অপারেটররা।

বিএমডিএর প্রিপেইড কার্ডের পেছনেই লেখা আছে ‘বরেন্দ্র সেই ভূমি, যেখানে পানিই জীবন।’ এই স্লোগান বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচের পানির গুরুত্ব তুলে ধরছে।

এ বিষয়ে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক বিমল রাজোয়ার বলেন, ‘দেশে রাষ্ট্রক্ষমতার সঙ্গে নলকূপের অপারেটরও পরিবর্তন হয়। তবে বরেন্দ্র অঞ্চলের সেচের দুষ্টচক্রের চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয় না। বিএনপি-জামায়াত শাসনামলে অপারেটর ছিল উভয় দলের। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হলে এই দলের লোকজন ডিপ টিউবওয়েলগুলো দখল করে। ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগের পতনের পর আবার বিএনপি-জামায়াতের লোকজন সেগুলো দখলে নিয়েছেন।’

উল্লেখ্য, রাজশাহী ও রংপুর বিভাগে কর্তৃপক্ষের ১৫ হাজার ৮২৮টি গভীর নলকূপের অধীনে ৬ লাখ ২৯ হেক্টর জমি সেচের আওতায় রয়েছে। এছাড়া আমন, আউশ ও রবি ফসলে সেচের ব্যবস্থা রয়েছে।

পেছনে ফিরে দেখা বরেন্দ্র অঞ্চল

সূত্র জানায়, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলার অধিকাংশ, নাটোরসহ রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও পাবনা জেলার কিছু অংশ এবং বর্তমান ভারতের উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদা জেলার অধিকাংশ নিয়ে বরেন্দ্র অঞ্চল গঠিত। বাংলাদেশে এর আয়তন প্রায় ৮ হাজার ৭২০ বর্গ কিলোমিটার।

তবে ইতিহাস বলে, প্রাচীন বরেন্দ্র অঞ্চল একদা কৃষি ও শিল্পসমৃদ্ধ এবং প্রাকৃতিক পরিবেশ চমত্কার ছিল। কিন্তু ব্রিটিশ আমলে মানুষ বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কৃষির সম্প্রসারণ, বসতবাড়ি স্থাপন, শিল্পের কাঁচামালের জোগান, আসবাবপত্র ও গৃহনির্মাণ সামগ্রী ও জ্বালানিতে কাঠ ব্যবহার, রাস্তা, বাঁধ ইত্যাদি অবকাঠামো নির্মাণে ধ্বংস হয়েছে বরেন্দ্র এলাকার বনভূমি। মূলত তখনই এই অঞ্চলে মরুকরণ শুরু।

সূত্র মতে, পরিবেশের স্বাভাবিক নিয়মে বরেন্দ্র অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাত কমেছে। প্রায় সকল নদীর উজানে বাঁধ নির্মাণের ফলে মহানন্দা, আত্রাই, পূর্ণভবা, শিব, পাগলা, করোতোয়া, তিস্তাসহ অধিকাংশ নদীই শুষ্ক মৌসুমে পানিশূন্য হয়ে যায়। পানির প্রবাহ না থাকায় এসব নদীনালা, খাল-বিলে পলি জমে ভরাট হয়ে ধারণ ক্ষমতা হারায়। তখন বরেন্দ্র অঞ্চলের জমি বৃষ্টিপাতনির্ভর এক ফসলি ছিল। বৃষ্টিপাত না হলে বছরে একটি ফসলের উত্পাদনও ব্যাহত হতো।

বিএমডিএর বিস্তার

কৃষি বিভাগ জানায়, ১৯৮৫ সালে বিএডিসির প্রকৌশলীরা বিশেষ গভীর নলকূপ উদ্ভাবন এবং এই অঞ্চলে ভূগর্ভস্থ পানির সেচের সুযোগ সৃষ্টি করেন। এরপর বিএডিসির আওতায় ‘বরেন্দ্র সমন্বিত এলাকা উন্নয়ন প্রকল্প (বিআইএডিপি)-প্রথম পর্যায় ১৯৮৫-১৯৯০)’ গঠিত হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ১০৪ কোটি ১১ লাখ টাকা ব্যয়ে রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ১৫টি উপজেলায় ফসল উত্পাদনের জয়যাত্রা শুরু।

এরপর ১৯৯২ সালের ১৫ জানুয়ারি রাজশাহী, নওগাঁ ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ২৫টি (সকল) উপজেলা এলাকা অন্তর্ভুক্ত করে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ‘বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিএমডিএ)’ গঠিত হয়। এরপর ২০০৩ সালে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ‘উত্তর বাংলাদেশ গভীর নলকূপ প্রকল্পে’র আওতায় স্থাপিত ১ হাজার ২১৭টি অকেজো গভীর নলকূপ গ্রহণ ও সচল করে ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর ও পঞ্চগড় জেলায় বিএমডিএ সম্প্রসারিত হয়। ২০০৪ সালে বিএডিসির অচালু গভীর নলকূপ গ্রহণ ও সচল করে রাজশাহী এবং রংপুর বিভাগের ১৬টি (সকল) জেলায় বিএমডিএ কার্যক্রম বিস্তার করে।

অপারেটর নিয়োগ এবং সেচে দুর্নীতি

ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেন, সেচের কাজে সংশ্লিষ্ট ও অভিজ্ঞ নয়, এমন লোকজন রাজনৈতিক বিবেচনায় বা ঘুষের বিনিময়ে একাধিক অপারেটরের দায়িত্ব পান বলে অভিযোগ রয়েছে। এ কারণে তারা বেপরোয়া সেচ বাণিজ্যের সাহস পায়।

সূত্রমতে, এক ঘণ্টা সেচের জন্য বিএমডিএ কৃষকদের ১২৫ টাকার প্রিপেইড কার্ড দেয়। কিন্তু কৃষক থেকে অপারেটররা ঘণ্টাপ্রতি ৪৫০ থেকে ৫০০ টাকা আদায় করে।

সর্বশেষ গত জানুয়ারিতে গভীর নলকূপের অপারেটর নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগে বিএমডিএর সেচ শাখার অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী জাহাঙ্গীর আলম খানের দপ্তরে অভিযান চালান দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কর্মকর্তারা।

উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের পতন হলে বিএমডিএ ১৬ জেলার ১৬ হাজারের বেশি নলকূপের অপারেটরের নিয়োগ বাতিল এবং নতুন নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করে। এতে ২৩ হাজার ৭৫২ আবেদন জমা পড়ে। পরীক্ষার মাধ্যমে কর্তৃপক্ষ ৪ হাজার প্রার্থীর নিয়োগ চূড়ান্ত করলে বিভিন্ন এলাকায় বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ করে। পরে চূড়ান্ত হওয়া নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত ও আবার নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়।

ভালো উদ্যোগের অসত্ ব্যবহার

বিএমডিএ সেচ নীতিমালায় বলা আছে ‘আগে আসলে, আগে পাবেন’ ভিত্তিতে প্রিপেইড কার্ডে অপারেটর কৃষকের প্রয়োজনীয় সেচ দিতে বাধ্য। অপারেটর স্কিমের বাইরে সেচ দিতে পারবে না। কিন্তু অপারেটররা এই নীতিমালা মানেন না। তারা কৃষকের কার্ড দিয়ে স্কিমের বাইরের জমিতেও সেচ দেন। কৃষকের কার্ড জিম্মায় রেখে নগদে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করেন। গোদাগাড়ীর এক কৃষক জানান, ‘যারা বেশি টাকা দেয়, তারা বেশি পানি পায়। এটা অপারেটরের ব্যবসায়িক মডেল।’ তানোরের এক কৃষক জানান, হয়রানি এড়াতে অপারেটরকে বিঘাপ্রতি ২-৪ হাজার টাকা দিলে সবার আগে সেচ পাওয়া কোনো ব্যাপার নয়।’

কৃষকের জমি লিজেও অপারেটরের বাণিজ্য

একেকটি গভীর নলকূপের আওতায় গড়ে ১০০ থেকে ৩০০ বিঘা জমি থাকে। সব জমির মালিকদের অপারেটরের সঙ্গে বাধ্যতামূলক নিবিড় যোগাযোগ রাখতে হয়। রাজশাহীতে প্রতি বিঘা ধানি জমির লিজ মূল্য ১৪-১৫ হাজার টাকা। তবে জমি অপারেটর নিজে লিজ নিলে মালিককে দেন ৬-৭ হাজার টাকা। তৃতীয়পক্ষ লিজ নিলে মালিক পান ৮-১০ হাজার টাকা। আলুর জমি বিঘা প্রতি লিজ মূল্য ২৮-৩০ হাজার টাকা। তবে জমি অপারেটর নিজে লিজ নিলে মালিক পান ১৪-১৫ হাজার টাকা। তৃতীয়পক্ষ লিজ নিলে মালিক পান ১৮-২০ হাজার টাকা। বাকিটা অপারেটরের পকেটে চলে যায়। কেউ প্রতিবাদ করলে পানি বন্ধের মতো জমি লিজ বন্ধ হয়ে যায়। এক্ষেত্রে মালিক নিজেই জমি আবাদে বাধ্য হলে অপারেটর অতিরিক্ত টাকা আদায় করেন। টাকা না দিলে পানি বন্ধ ও ফসল নষ্ট করা হয়। এছাড়া ট্রান্সফর্মার, মোটর ও ড্রেন মেরামতের কথা বলে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়।

বোরো আবাদে নেতিবাচক প্রভাব

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র বলছে, সেচের পানির সংকটে বরেন্দ্র অঞ্চলে বোরো ধানের আবাদ কমেছে। সেচ সংকট সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যতে কৃষি উত্পাদন ও কৃষকের জীবীকার ওপর বড় প্রভাব পড়বে। যদিও বরেন্দ্রের শত শত বিঘা ধানি জমিতে রাতারাতি পুকুর খনন ও মাছ চাষ করা হচ্ছে। সেচ সংকট অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে পুকুর ও মাছ চাষ আরো বাড়তে পারে। 

তবে এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক অপারেটর দাবি করেন, কৃষকদের সব অভিযোগ সত্য নয়। নলকূপ ও ট্রান্সফরমার নষ্ট বা চুরি হলে মেরামতের জন্য কৃষকদের কাছ থেকে টাকা নেওয়া হয়। বিলম্বে সেচের সত্যতা স্বীকার করে তারা বলেন, তালিকা অনুসারে সেচ দেওয়া হয়।

এসব বিষয়ে পরিবেশ আইন গবেষক, নৃবিজ্ঞানী ও বাংলাদেশ রিসোর্স সেন্টার ফর ইন্ডিজিনাস নলেজের (বারসিক) বরেন্দ্র অঞ্চলের সমন্বয়কারী মো. শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘বিএমডিএর সেচ ব্যবস্থায় অপারেটর নিয়োগে স্বজনপ্রীতি ও দুর্নীতি দিনদিন বাড়ছে। বিএমডিএর সেচ নীতিমালা-২০০৮ -এ কৃষক সংগঠন এবং সমবায় ভিত্তিক কৃষকের মতামতের প্রাধান্য ছিল। কিন্তু নতুন অপারেটর নিয়োগ নীতিমালা-২০২৪ তে সেই মতামতকে উপেক্ষা করা হয়েছে। এতে অপারেটরের স্বেচ্ছাচারিতা ও দুর্নীতি আরো বাড়বে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. চৌধুরী সারওয়ার জাহান বলেন, ‘বিএমডিএর গভীর নলকূপের মাধ্যমে বরেন্দ্র অঞ্চলে সামন্তবাদ যেন আবার ফিরে এসেছে। সরকারের নীতিনির্ধারণে সমন্বয়ের অভাবে বরেন্দ্র অঞ্চলে সেচ সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। এ বিষয়ে বিএমডিএকে আরো যত্নবান হতে হবে।’

যা বললেন নির্বাহী পরিচালক

এ বিষয়ে বিএমডিএর নির্বাহী পরিচালক মো. তরিকুল আলম এই প্রতিবেদকে বলেন, ‘সেচের পানি সরবরাহের উত্থাপিত অভিযোগ নিরসনের জন্যই সেচযন্ত্রের অপারেটর নিয়োগ ও পরিচালনা নীতিমালা-২০২৪ প্রণয়ন করা হয়েছে। এ বিষয়ে জনসাধারণকে জোনভিত্তিক প্রশিক্ষণ দিয়ে সচেতন করা হচ্ছে। ইমাম থেকে শুরু করে সব শ্রেণির মানুষকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যে রাজশাহীতে ২টি এবং রংপুরে ১টি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের ১৬টি জেলাকে রাজশাহী, বগুড়া, রংপুর ও ঠাকুরগাঁও এই চারটি জোনে ভাগ করে সুপারিনটেনডেন্ট নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আশা করছি এবারের অপারেটর নিয়োগটা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার সঙ্গে হবে। এতে অপারেটরদের দৌরাত্ম্য কমবে।

তিনি আরো বলেন, সেচ কাজে ভূ-উপরিস্থ ও বৃষ্টির পানির সর্বোত্তম ব্যবহার এবং বিভিন্ন সংস্কারসহ বেশকিছু প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্পের কাজ শেষ হলে সেচ সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তখন কৃষকের চাহিদামতো সেচ দেওয়া যাবে। তিনি বলেন, কোনো অপারেটরের বিরুদ্ধে অনিয়মের প্রমাণ পেলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তবে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ না করলে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না।