
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত বছরের ১৭ জুলাই যাত্রাবাড়ীতে গুলিবিদ্ধ হন মো. ইমরান নামে এক তরুণ। কাজলা মাথায় গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরদিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে মারা যান তিনি। এ ঘটনায় যাত্রাবাড়ী থানায় একটি মামলা হলেও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন (পোস্ট মর্টেম-‘পিএম’ রিপোর্ট) না পাওয়ায় থমকে আছে মামলার তদন্ত। ৫ আগস্ট গুলিস্তানে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৬৫ দিন হাসপাতালের বিছানায় অচেতন থেকে মারা যান জুতা কারখানার শ্রমিক রমজান মিয়া জীবন। ‘পিএম’ রিপোর্ট না পাওয়ায় থমকে আছে ওই মামলার তদন্তও। ১৩ জুন হাজারীবাগে দোকানের বকেয়া টাকা চাওয়ায় খুন হন মোহাম্মদ শফিউদ্দিন নামে এক ব্যক্তি। তদন্তে নেপথ্যের সব কিছু উঠে এলেও মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আদালতে অভিযোগপত্র দিতে পারছেন না শুধু ‘পিএম’ রিপোর্টের অভাবে।
শুধু জুলাই শহীদ ইমরান ও রমজান এবং দোকানদার শফিউদ্দিনই নন, ‘পিএম’ রিপোর্টের জন্য শুধু রাজধানীর থানাগুলোতেই থমকে আছে হাজারো মামলার তদন্ত। মাসের পর মাস এমনকি বছর পেরিয়ে গেলেও মিলছে না অপরাধ প্রমাণের অপরিহার্য এই রিপোর্ট। এই দীর্ঘসূত্রিতায় একদিকে তদন্তে বিঘ্ন ঘটছে, আরেক দিকে সৃষ্টি হচ্ছে মামলাজট।
সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, হত্যাকাণ্ড কিংবা অপমৃত্যু মামলার তদন্তে ময়নাতদন্ত (পোস্ট মোর্টেম-পিএম) রিপোর্ট গুরুত্বপূর্ণ আলামত। কোনো মামলার ন্যায়বিচারও অনেকাংশে নির্ভর করে এ প্রতিবেদনের ওপর। হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে ‘পিএম’ রিপোর্ট পেতে দেরি হলেও অন্যান্য আলামতের ভিত্তিতে তদন্ত চালিয়ে নেওয়া যায়। তবে অভিযোগপত্র দিতে দেরি হয়। কিন্তু অপমৃত্যুর ঘটনার ‘পিএম’ রিপোর্ট না পেলে তদন্তই আটকে থাকে। ডিএমপির এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এ ক্ষেত্রে ডিএমপি সদর দপ্তর থেকে ময়নাতদন্ত সম্পন্নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিভিন্ন সময় তদবির করেও কোনো লাভ হচ্ছে না।
ডিএমপি সদর দপ্তর সূত্র মতে, গত বছর জুলাই থেকে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ঘটনায় হত্যা ও হত্যাচেষ্টার অভিযোগে রাজধানীর ৫০ থানায় মামলা হয়েছে ৭৩৮টি। এর মধ্যে হত্যা মামলা ৪৫৬টি। হত্যা মামলার ১৩১টি তদন্ত করছে তিনটি সংস্থা (পিবিআই, সিআইডি ও এটিইউ)। এগুলোর মধ্যে একটির চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। বাকি ৩২৪টি মামলা তদন্ত করছে ডিএমপি। এসব ঘটনার মধ্যে ৬৭ শহীদের লাশের পিএম সম্পন্ন হয়েছে। তবে সাতটি লাশের পিএম রিপোর্ট এখনো হাতে পায়নি ডিএমপি। এদের মধ্যে রয়েছেন-যাত্রাবাড়ীর কাজলা অনাবিল হাসপাতালের সামনে নিহত হওয়া মো. ইমরান, পল্টনে নিহত হওয়া কারখানা শ্রমিক মো. রমজান মিয়া জীবন, উত্তর বাড্ডা বাজারের পাশে নিহত হওয়া কবজা ফ্যাক্টরির কর্মচারী ইমন, উত্তরার আরএকে টাওয়ারের পাশে নিহত বাংলাদেশ এয়ার লাইন্স ট্রেনিং সেন্টারের ছাত্র ওমর নুরুল ইসলাম, উত্তরা ৭ নম্বর সেক্টরে নিহত শিশু আরাফাত হুসাইন, উত্তরা আজমপুরে নিহত মো. জাকির হোসেন ও মিরপুর ১০ নম্বরে নিহত শিক্ষার্থী শাকিল। এদের মধ্যে ইমরান, রমজান, ইমন ও জাকির হোসেনের পিএম রিপোর্ট ঢামেকে, ওমর নুরুল আফছারেরটা চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে, আরাফাত হুসাইনের মিটফোর্ড হাসপাতালে এবং শাকিলের ভোলা জেলা সদর হাসপাতালে আটকা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ময়নাতদন্তে অপমৃত্যু যদি হত্যাকাণ্ড প্রমাণিত হয়, মামলার তদন্তের মোড়ই ঘুরে যায়। তখন পুলিশকে আসামি গ্রেপ্তারে কাজ শুরু করতে হয়। তবে ক্লু-লেস ঘটনার ক্ষেত্রে পিএম রিপোর্ট দেরিতে পেলে আসামি অধরা থেকে যাওয়ারও আশঙ্কা দেখা দেয়।
ডিএমপি সূত্র জানায়, শুধু বৈষম্যবিরোধী হত্যাকাণ্ড নয়, রাজধানীতে ছিনতাই, পারিবারিক কলহ, চাঁদাবাজি, পূর্ব শত্রুতাসহ নিয়মিত হত্যাকাণ্ডগুলোর ক্ষেত্রেও পিএম রিপোর্ট সহজে মিলছে না। ডিএমপির আট বিভাগে ময়নাতদন্ত না পাওয়ায় ১ হাজার ১৯৫টি মামলার তদন্ত স্থগিত রয়েছে। এই মামলাগুলোর মধ্যে ৬০টির ময়নাতদন্ত রিপোর্ট এক বছরেরও বেশি সময় পার হলেও পাওয়া যাচ্ছে না। আর ৬ মাসেরও বেশি সময় ধরে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছে না ৩১১টি অপমৃত্যু মামলার। ৩ মাসের বেশি সময় ধরে ২৯১টি মামলার রিপোর্ট ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ক্রাইম) মো. ফারুক হোসেন বলেন, একটি মামলায় অপরাধ প্রমাণে বিশেষজ্ঞ মতামত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সে ক্ষেত্রে ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ও মেডিকেল সার্টিফিকেট অপরিহার্য। এগুলো পেতে দেরি হলে মামলার তদন্তে বিঘ্ন ঘটে ও আদালতে প্রতিবেদন দিতে দেরি হয়। সমাজ ও অপরাধ বিশ্লেষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, মামলার বিচার অনেকাংশে ময়নাতদন্ত রিপোর্টের ওপর নির্ভর করে। তাই এই রিপোর্ট দিতে দেরি হয় কেন, সেটি চিহ্নিত করে সরকারের উচিত সমস্যাগুলো সমাধান করার। সেই সঙ্গে ফরেনসিক বিভাগকে আলাদা ইনস্টিটিউট ফ্রেমে আনাটা অপরিহার্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ডিএমপির তথ্যানুযায়ী ঢামেকে ৪ শহীদের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট আটকা থাকার তথ্য পাওয়া গেলেও সেখানকার ফরেনসিক বিভাগের প্রধান ডা. কাজী গোলাম মোখলেছুর রহমান বলেন, জুলাই গণ অভ্যুত্থানের সময় সারা দেশ থেকে ঢামেক মর্গে ১৫০টি লাশ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে ৬৩টি ছিল অজ্ঞাত লাশ। আমরা সবকটি লাশের ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দিয়ে দিয়েছি। অন্য মামলার ময়নাতদন্ত রিপোর্ট দিতে দেরি হওয়ার কারণ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ থাকে। তবে কোনো কারণ ছাড়া আমরা ইচ্ছাকৃত কালক্ষেপণ করি না।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক সেলিম রেজা বলেন, মৃত্যুর স্পষ্ট কারণ না থাকলে ভিসেরা ও হিস্টোপ্যাথলজি টেস্ট করা হয়। এগুলোর প্রতিবেদন পেতে দেরি হলে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন দিতে দেরি হয়। এ ছাড়া জনবল সংকট, মৃত্যুর ঘটনা ছাড়াও ধর্ষণের ঘটনাগুলোর ফরেনসিক পরীক্ষা, ক্লাস নিতে ব্যস্ত সময় পার করার মতো অনেক কাজের চাপ থাকে।