
দেশের শেয়ারবাজারে আবারও নেমে এসেছে আস্থাহীনতার ছায়া। একসময় নতুন বিনিয়োগকারীর ভিড়ে মুখর ছিল বাজার, এখন তাঁরা একে একে সরে যাচ্ছেন। দীর্ঘ মন্দাভাব, টানা দরপতন ও নীতিগত অনিশ্চয়তায় পুঁজিবাজার থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। স্থানীয় বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণও কমছে শেয়ারবাজারে। বিনিয়োগ করে লোকসান ছাড়া কেউ মুনাফা করতে পারছেন না। ফলে দ্রুতই বাজার থেকে বের হয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষণীয়। বাজারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে শুধু নীতিগত ঘোষণা নয়, দরকার কার্যকর পদক্ষেপ। তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর স্বচ্ছতা, ন্যায্য মূল্যায়ন ও তারল্য বৃদ্ধির উদ্যোগ না নিলে বাজারে স্থিতি ফিরবে না।
সেন্ট্রাল ডিপোজিটরি বাংলাদেশ লিমিটেডের (সিডিবিএল) সর্বশেষ তথ্যে দেখা গেছে, চলতি বছরের প্রথম নয় মাসেই প্রায় ৩০ হাজার বিনিয়োগকারী তাঁদের বেনিফিশিয়ারি ওনার্স (বিও) হিসাব বন্ধ করে দিয়েছেন। একই সময়ে আরও প্রায় ৩২ হাজার বিনিয়োগকারীর হিসাব শেয়ারশূন্য হয়ে গেছে। অর্থাৎ জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত অন্তত ৬২ হাজার বিনিয়োগকারী কার্যত বাজার থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন।
২০২৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর বিও হিসাব ছিল ১৬ লাখ ৮২ হাজার ৪৫২টি। ২০২৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এ সংখ্যা নেমে আসে ১৬ লাখ ৩২ হাজার ২২৭-এ। এর মানে মাত্র নয় মাসে কমেছে ৩০ হাজার ২২৫টি বিও হিসাব। পাশাপাশি শেয়ারশূন্য বিও হিসাব বেড়েছে ৩১ হাজার ৮৮৫টি। তবে অক্টোবরের শুরুতে বিও হিসাবের সংখ্যা কিছুটা বেড়ে থাকে। তবে গত সপ্তাহে ফের নিম্নগতি দেখা গেছে। সেপ্টেম্বর শেষে সক্রিয় বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১২ লাখ ৯ হাজার ২০৭টিতে, যাতে মোট শেয়ার ও ইউনিট রয়েছে ১০ হাজার ২৫৭ কোটি। এর বাজারমূল্য প্রায় ৩ লাখ ১৬ হাজার ৪২ কোটি টাকা। অন্যদিকে শেয়ারশূন্য বিও হিসাব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩ লাখ ৭৫ হাজার ৮৫৯টিতে।
শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ১১ কোম্পানিতে বিদেশি বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, যা সংশ্লিষ্ট বিনিয়োগকারীদের মধ্যে উদ্বেগ তৈরি করেছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) সূত্রে জানা গেছে, এ কোম্পানিগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কোম্পানি (বিএটিসি), বিডি থাই অ্যালুমিনিয়াম, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস, বেক্সিমকো ফার্মা, ফার্স্ট সিকিউরিটিজ ইসলামী ব্যাংক, এমজেএলবিডি, অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজ, ওয়ান ব্যাংক, রেকিট বেনকিজার, রেনেটা এবং শেফার্ড ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রতিটি কোম্পানির বিদেশি শেয়ার ০.১০ শতাংশের বেশি কমেছে। এদিকে কমিশনও বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফেরাতে নানান পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। শক্তিশালী শেয়ারবাজার গড়ে তুলতে স্বচ্ছ হিসাব ব্যবস্থাপনা এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ সংস্কৃতি গড়ে তোলার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। রাষ্ট্রায়ত্ত লাভজনক কোম্পানি বাজারে তালিকাভুক্ত করার কথা জানিয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো উদ্যোগ না থাকায় বিনিয়োগকারীরা হতাশ হচ্ছেন।
জানতে চাইলে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) পরিচালক মিনহাজ মান্নান ইমন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘মানুষের আস্থা অর্জন করতে হলে কার্যকর পদক্ষেপ থাকতে হবে। কয়েকজন লোককে শাস্তি দিলেই শেয়ারবাজারে আস্থা ফিরে আসবে না। মানুষ এখানে বিনিয়োগ করে মুনাফা পাওয়ার জন্য। যদি উল্টো লোকসান হয় তবে কীভাবে আস্থা ফিরবে?’ তিনি বলেন, ‘ব্রোকার হাউসগুলোর পরিস্থিতি দিনদিন খারাপ হচ্ছে। টানা লোকসানে অস্তিত্ব না থাকার মতো অবস্থা। এরই মধ্যে অনেক ব্রোকার হাউসে কর্মী ছাঁটাই করতে হয়েছে। তবে সব কর্মী ছাঁটাই করেও টিকে থাকা যাবে না, যদি বিদ্যমান মন্দা চলতে থাকে। বাজারে কোনো প্রকার পজিটিভ কিছু দেখা যাচ্ছে না। বাজার নিয়ে কোনো পরিকল্পনা আছে বলে কর্তৃপক্ষের আচরণে বোঝা যায় না।’