
নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মেঘনা নদীতে ইলিশ শিকার করছেন জেলেরা। শরীয়তপুর গোসাইরহাট উপজেলার কুচাপট্রি, কোদালপুর ও আলাওলপুর ইউনিয়নের মেঘনা শাখা নদীতে চলছে মাছ ধরার এ মহোৎসব।
বৃহস্পতিবার ভোর পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটা বাজে। অন্ধকার তখনো কাটেনি। গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুর ইউনিয়নের মেঘনা শাখা নদীর পাড়ে ছৈয়ালকান্দির বাইদ্যাপাড়ায় ও কুচাইপট্রি আশ্রয়ণ কেন্দ্রের পাশের খালে দেখা গেল একের পর এক ট্রলার আসছে।
ট্রলারের মাঝিমাল্লা সারারাত নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ইলিশা ও মেঘনা নদীতে মাছ শিকার করেছেন। সেই মাছ এখানে বিক্রি করতে এনেছেন।
খালের মধ্যেই নৌকার উপর কেনাবেচা হচ্ছে মাছ। দূরদূরান্ত থেকে পাইকার এসেছেন এসব ইলিশ কেনার জন্য। শুধু পাইকার এসেছেন এমন নয়; এসেছেন গ্রামবাসী ও আড়তদাররাও। গ্রামবাসী এক হালি, দুই হালি ইলিশ নিয়ে বাড়ি ফিরছেন। পাইকারেরা কিনছেন ঝুড়ি ভরে। তারা মাছ নেওয়ার জন্য অটোরিকশা নিয়ে এসেছেন।
সাধারণ ক্রেতারা মাছ কিনে বাড়ি যাওয়ার সময় পাইকার-আড়তদারদের দুটো কথা শুনিয়ে যাচ্ছেন। কারণ পাইকারদের কারণে তারা কম দামে মাছ কিনতে পারছেন না।
এক ক্রেতা বলেন, সরকার নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। একটু সস্তা হলে ইলিশ কিনে খাবেন বলে যারা ভেবেছেন; আড়তদার-পাইকারেরা বেশি দামে মাছ কেনাবেচা করছেন বলে তারা তা পারছেন না।
গোসাইরহাট উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, অক্টোবরের ২২ দিন (৪-২৫ অক্টোবর) মা-ইলিশ ডিম ছাড়তে নদীতে উঠে আসে। ভোলা দেশের অন্যতম মৎস্য প্রজনন অভয়াশ্রম।
মেঘনা ও মেঘনা শাখা নদী, জয়ন্তী নদীসহ এ অভয়াশ্রম জলসীমায় জাল ফেলা, ইলিশ মাছ শিকার, বহণ, মজুত ও ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ। একটি মা ইলিশ নদীতে পাঁচ-ছয় লাখ ডিম ছাড়বে।
নিষেধাজ্ঞা মেনে যদি সঠিকভাবে মা ইলিশের ডিম ছাড়ার পরিবেশ তৈরি করা যায় এবং জাটকা সংরক্ষণ করা যায়, তাহলে দেশের মানুষের ইলিশ মাছের চাহিদা পূরণ করে বিদেশেও রপ্তানি করা সম্ভব।
বৃহস্পতিবার ভোর থেকে শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত সরেজমিন দেখা যায়, কোদালপুর লঞ্চঘাটসহ কুচাইপট্রি খেঁজুরতলা মেঘনা শাখা নদীর বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে মাছ শিকার করা হচ্ছে।
একপক্ষ বড় দ্রুতগামী ট্রলার নিয়ে সারা রাত মাছ শিকার করেছে। আরেকপক্ষ ভোরে ছোট নৌকা–জাল নিয়ে মাছ শিকার করতে নেমে পড়েছে।
মেঘনা নদীর আলাওলপুর চরজালালপুর, কুচাইপট্রি চরমান্দাইরা, কুলচুরী পাতারচর, কোদালপুর ইউনিয়নের ৬ নাম্বার ঘাট এলাকা ওঠান্ডাবাজার এলাকায় কমপক্ষে ৪০টি নৌকায় জাল পেতে মাছ শিকার করতে দেখা যায়।
জেলেরা সবাই তরুণ। ট্রলারের চারপাশে চিকন বাঁশ সাজানো। তারা সরকারি কর্তৃপক্ষের অভিযান মোকাবিলা করার প্রস্তুতি নিয়েই নদীতে মাছ শিকারে নামেন।
কেন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাছ শিকার করছেন? জানতে চাইলে তারা বলেন, ভরা মৌসুমে মাছ পাননি। জেলেরা ঋণের দায়ে জর্জরিত। এখন নদীতে নামলেই ১০-১২ হাজার টাকার মাছ পাচ্ছেন। কিছুটা হলেও দেনা শোধ হচ্ছে।
স্থানীয়রা জানান, সাধারণত গ্রামের চরমান্দাইরা মাছঘাটে মাছ কেনাবেচা হয়। তবে এখন সেখানে মাছ নেই। মাছ বিক্রি হচ্ছে দুর্গম কুলচুরী পাতারচর আশ্রয়ণ কেন্দ্র এলাকায়। ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই সেখানে ইলিশ কেনাবেচা হয়ে যায়। ব্যাপারীরা ইলিশ কিনে রাতে ও দিনে বাড়ি বাড়ি ঘুরে এবং মুঠোফোনে কথা বলে বিক্রি করছেন।
অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে কোদালপুর মাছঘাটের সাধারণ সম্পাদক আড়তদার মো. আমিন বলেন, তিনি ঘাটের দায়িত্বে নেই। কিভাবে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ছৈয়ালপাড়া ও ৬ নম্বরে মাছ কেনাবেচা হচ্ছে- এ বিষয়ে ঘাটের দায়িত্বে থাকা ইউসুফ মাল বলতে পারবেন বলে তিনি মন্তব্য করেন।
খেঁজুরতলার এক আড়তদার বলেন, এখনো আগের কমিটি বহাল আছে। তিনি এর কিছুই জানেন না। তিনি ঢাকায় অবস্থান করছেন।
এখানে নৌপুলিশ ফাঁড়ি নেই, চাঁদপুর ফেরিঘাটে রয়েছে। এর মধ্যে নৌপুলিশকে ‘ম্যানেজ’ করে নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই মা ইলিশ ধরা হচ্ছে- স্থানীয় লোকজন এ কথাই জানালেন।
চাঁদপুর নৌফাঁড়ির আইসি ইহছানুল হক অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, আমরা প্রতিদিন অভিযান করে জেলেদেরসহ জাল ট্রলার ও মাছ জব্দ করি। বিশাল এলাকা, সব জায়গায় তো একযোগে অভিযান চালানো সম্ভব নয়, এরপরও তারা যথাসাধ্য অভিযান চালাচ্ছেন। মেঘনা নদীতে যেন নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মা ইলিশ নিধন করা না হয়, তিনি সেই ব্যবস্থা নেবেন।
সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. আবুল কাশেম বলেন, তারা দিনরাত মেঘনা, জয়ন্তী ও মেঘনা শাখা নদীতে অভিযান চালাচ্ছেন। একদিকে অভিযান চলছে, আরেকদিকে জেলেরা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাছ ধরতে নেমে যাচ্ছেন। লোকবল সংকট মেনে নিয়েই তারা সাধ্যমতো চেষ্টা করছেন বলে জানান।