
দুর্যোগ প্রবণ বাংলাদেশ। দুর্যোগ এলে কেবল অবকাঠামো কিংবা পরিবেশ বিপর্যয় হয় না; সেই সঙ্গে বিপর্যস্ত হয় মানুষের জীবন ও মন। দুর্যোগে কোনো ঘরবাড়ি ভেঙে গেলে সহজে গড়া সম্ভব। কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য বিপর্যস্ত হয়ে পড়লে তার প্রভাব পড়ে দীর্ঘ মেয়াদে। ফলে দুর্যোগে মানুষ খাবার, পানি, আশ্রয়কেন্দ্রের যেমন প্রয়োজন পড়ে, তেমনি প্রয়োজন পড়ে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার। বাংলাদেশে ৩ কোটিরও বেশি মানুষ কোনো না কোনো মানসিক সমস্যায় ভুগছেন। আর এদের মধ্যে ৯২ শতাংশ মানুষই চিকিত্সাসেবার বাইরে রয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, দেশের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৮ দশমিক ৪ ভাগ প্রাপ্তবয়স্ক ও ১৩ ভাগ শিশু-কিশোর মানসিক রোগে আক্রান্ত, যা মোট সংখ্যার হিসেবে প্রায় ৩ কোটি। এই বিশালসংখ্যক মানুষের জন্য উন্নত ও সহজলভ্য মানসিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা অত্যন্ত জরুরি। যারা মানসিক রোগে আক্রান্ত তারাও অজ্ঞতা, ভ্রান্তধারণা, ভীতি, লোক লজ্জা ও বিভিন্ন কুসংস্কারের কারণে মানসিক রোগের বৈজ্ঞানিক চিকিত্সার পরিবর্তে অপ্রচলিত অবৈজ্ঞানিক চিকিত্সা গ্রহণ করছে। ফলে মানসিক রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে আরো জটিল আকার ধারণ করছে। অথচ আধুনিক চিকিত্সার মাধ্যমে মানসিক রোগ সম্পূর্ণ নিরাময় সম্ভব।
সঠিক সময়ে চিকিত্সা নিলে ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ মানসিক রোগী সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়ে যায় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আধুনিক নগরায়ন, আর্থ সামাজিক অবস্থা, মানসিক চাপ, বংশগতি, অন্যান্য শরীরবৃত্তীয় ও মনোসামাজিক কারণে দেশে দিন দিন মানসিক রোগের প্রকোপ বাড়ছে। আবার অনেকে মানসিক সমস্যাকে রোগ মনে করেন না, বিশেষ গুরুত্বও দেন না এবং সঠিক চিকিত্সা করাতেও উদ্যোগী হন না। ফলে মানসিক সমস্যা ভেতরে ভেতরে আরো বাড়তে থাকে।
এমন প্রেক্ষাপটে আজ ১০ অক্টোবর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত হবে ‘বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস-২০২৫’। এ বছর দিবসের প্রতিপাদ্য নির্ধারিত হয়েছে—‘বিপর্যয় কিংবা জরুরি অবস্থায় মানসিক স্বাস্থ্যসেবা যেন পাওয়া যায়’। দিবসটি উপলক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন ও সংস্থা নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে ক্রোড়পত্র প্রকাশ, শোভাযাত্রা, গোলটেবিল বৈঠক, মিট দ্য প্রেস, আলোচনাসভা, বৈজ্ঞানিক সেমিনার ও বিনা মূল্যে মানসিক চিকিত্সাসেবা প্রদান। বিশ্বব্যাপী মানসিক রোগ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা, কুসংস্কার দূর করা ও জনসচেতনতা সৃষ্টিতে ওয়ার্ল্ড ফেডারেশন ফর মেন্টাল হেলথ ১৯৯২ সালের ১০ অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন কর্মসূচির সূচনা করে। বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সাইকিয়াট্রিস্টস (বিএপি) দিবসটি উপলক্ষ্যে শোভাযাত্রা, আলোচনাসভা, লিফলেট বিতরণ, পোস্টার ও ব্যানার প্রদর্শন, বিনা মূল্যে মানসিক চিকিত্সাসেবা প্রদান কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
দেশে মানুষের মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে ২০১৮-১৯ সালে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট একটি জরিপ চালায়। ঐ জরিপ বলছে, দেশে লঘু থেকে গুরুতর মাত্রার মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভোগা প্রাপ্তবয়স্ক ১৭ শতাংশ (নারী ১৯ শতাংশ পুরুষ ১৫ শতাংশ)। ১৮ বছরের নিচের জনগোষ্ঠীর মধ্যে ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ ভুগছে মানসিক সমস্যায়। অন্যদিকে মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবীর (মনোচিকিত্সক, মনোবিজ্ঞানী ও অন্যান্য প্রশিক্ষিত মানসিক স্বাস্থ্য পেশাজীবী) সংখ্যা ১ হাজারের কম। মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ৯০ শতাংশের বেশি মানুষ চিকিত্সার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মোহিত কামাল বলেন, মানুষ সবসময় বিভিন্ন ধরনের দুশ্চিন্তায় এবং চাপে থাকার কারণে তাদের মধ্যে মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। ফলে মানুষ বিভিন্ন রকম খারাপ পদক্ষেপ গ্রহণ করে থাকে। এর মধ্যে অন্যতম হলো আত্মহত্যা।
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের অধ্যাপক ডা. মেখলা সরকার বলেন, ওয়ার্ক ফেডারেশন অফ মেন্টাল হেলথ বিশ্বব্যাপী ১৯৯২ সাল থেকে মানসিক স্বাস্থ্য দিবস পালন করে। মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের সমাজে যে নেতিবাচক ধারণা আছে সেটি ভাঙ্গতেই এই দিবস পালিত হয়ে থাকে। তিনি বলেন, একজন ব্যক্তির মধ্যে যে সম্ভাবনার জায়গাগুলো থাকে, সেগুলো নানাভাবে বন্ধ হয়ে যায়, যদি মানসিকভাবে তিনি কোনো সমস্যায় থাকেন।