Image description

পদ্মা-মেঘনার মোহনায় গড়ে ওঠা জনপদ শরীয়তপুর। নদী, কৃষি আর সরল মানুষের জীবনযাত্রায় ভরা জেলাটির চিত্র পাল্টে যায় আওয়ামী লীগের টানা সাড়ে ১৫ বছরের দুঃশাসনে। ভিন্ন মতাবলম্বীদের জন্য শরীয়তপুর হয়ে ওঠে মামলা, নির্যাতন, হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট আর অসংখ্য পরিবারের কান্নার জনপদ।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধীদের কাছে আওয়ামী লীগের সময়কাল ছিল দমন-পীড়ন, গায়েবি মামলা আর অমানবিক অভিজ্ঞতার দুঃসহ অধ্যায়।

জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরে অসংখ্য নেতাকর্মী খুন ও গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে শরীয়তপুরের গোসাইরহাট বিএনপির সহ-সভাপতি মজিবর সিকদার, ভেদরগঞ্জ উপজেলা যুবদলের নেতা খলিল পেদা, কুচাইপট্টি ইউনিয়নের বিএনপি নেতা হারুন গাজীকে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছে। শরীয়তপুরের কোনো স্থানই নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি বিরোধীদলের নেতাকর্মীরা। ভেদরগঞ্জের চরসেনসার বাজারে বিএনপি নেতা কামালকে নির্মম নির্যাতন করা হয়েছিল। পরে তার মৃত্যু নিশ্চিত ভেবে ফেলে রেখে যায় আওয়ামী সন্ত্রাসীরা।

এদিকে বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের দোকান-বাণিজ্য দখল ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। নড়িয়ার ঘড়িষার বাজারের এক বিএনপি নেতা বলেন, আমার দোকানে কয়েক লাখ টাকার মালামাল ছিল। হঠাৎ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী গ্রুপ এসে দোকান দখল করে নেয়। মাত্র ২০ হাজার টাকা দিয়ে বলল, ‘দোকান এখন তাদের। প্রতিবাদ করলে প্রাণে বাঁচতাম না। তাই বিদেশে পালাতে বাধ্য হই।’

দলীয় সূত্রে জানা গেছে, গত সাড়ে ১৫ বছরে শরীয়তপুরে বিএনপির বিরুদ্ধে দায়ের হয়েছে ২০০টির বেশি মামলা, যাতে আসামি করা হয়েছে প্রায় ৫০০ নেতাকর্মীকে। জামায়াতের বিরুদ্ধেও রয়েছে অর্ধ শতাধিক মামলা এবং প্রায় ২০০ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। বিএনপি ও জামায়াত নেতাদের অভিযোগ, বিরোধীদলকে দমাতে আওয়ামী লীগ সরকার ভয়-ভীতি ছড়াতে অসংখ্য গায়েবী মামলা করেছে। এসব মামলায় নেতাকর্মীদের জেলে পাঠিয়ে রাজনীতি থেকে দূরে রাখাই ছিল মূল উদ্দেশ্য।

নড়িয়া উপজেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, ‘আমার নামে মোট ২৩টি মামলা হয়েছে। কখনো মুগদা, কখনো পল্টন, আবার কখনো মোহাম্মদপুর থানায় এসব মামলা দেওয়া হয়। এসব মিথ্যা মামলায় এক বছরেরও বেশি কারাগারে থাকতে হয়েছে। নির্যাতনের কারণে আজ এক চোখে দেখতে পাই না। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে আমার বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর ও লুটপাট হয়। পরে নির্বাচনের আগে আমাকে গ্রেপ্তার করে মিন্টু রোডে (গোয়েন্দা পুলিশের কার্যালয়) তিন দিন আটকে নির্যাতন চালানো হয়। সেই নির্যাতনের ফলেই ডান চোখ চিরতরে অন্ধ হয়ে যায়।’

জেলা ও দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মনিরুজ্জামান খান দিপু বলেন, ‘২০২৪-২৫ সালে রাজনৈতিক মামলার মধ্যে ২২টি প্রত্যাহার করা হয়েছে, বাকিগুলোর প্রক্রিয়া চলমান।’

আতঙ্কের নাম ওসি সহিদুল

২০১৩ সালে গোসাইরহাট থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. সহিদুল ইসলাম হয়ে ওঠেন আতঙ্কের প্রতীক। বিএনপি-জামায়াতসহ বিরোধী দলের যে কোনো দলের নেতা-কর্মী তার চোখে ছিলেন শত্রু। ভিন্নমত বা সমালোচনা করলেই থানায় ডেকে চালানো হতো অমানবিক নির্যাতন।

গোসাইরহাটের ইদিলপুর ইউনিয়নের জামায়াতের তৎকালীন আমির শাহাবুদ্দিন স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘২০১৩ সালে ওসি সহিদুল আমার ভাইকে অন্যায়ভাবে থানায় ধরে নেয়। থানায় গেলে আমাকেও আটক করে বেধড়ক মারধর করা হয়।

 

আজও শরীর আর মনে সেই যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি। শুধু থানার ভেতরে পুলিশি নির্যাতন নয়, বাইরে আওয়ামী কর্মীরা বাড়িঘরে হামলা চালায়, লুটপাট করে, মোটরসাইকেল পুড়িয়ে দেয়। থানার ভেতরে পুলিশ আর বাইরে সন্ত্রাসীদের তাণ্ডবে জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিল।’

ট্রলার চালক থেকে শত কোটি টাকার

মালিক ‘ট্রলার মান্নান’

ভেদরগঞ্জের সাধারণ ট্রলার চালক আব্দুল মান্নান হাওলাদার হয়ে ওঠেন শত কোটি টাকার মালিক। আজও স্থানীয় বাসিন্দারা তাকে চেনেন ‘ট্রলার মান্নান’ নামে। স্থানীয় বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিদের সূত্রে জানা গেছে, মাত্র ২০ বছর বয়সে বাবার সঙ্গে ট্রলার চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ শুরু করেছিলেন মান্নান। কিন্তু আওয়ামী লীগের রাজনীতির ছত্রছায়ায় যাদুর কাঠি হাতে পান। যুবলীগ সভাপতি থেকে পৌর মেয়র, এরপর ধাপে ধাপে ক্ষমতার আসনে বসেন মান্নান।

অভিযোগ রয়েছে, মেয়র হওয়ার পর টেন্ডারবাজি, দখলবাজি, চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে খাস জমি দখল করে দোকান-মার্কেট নির্মাণ এবং ঠিকাদারি ব্যবসায় বিপুল সম্পদ গড়ে তোলেন তিনি। রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে জমি-ফ্ল্যাটের মালিক হন সাবেক এই ট্রলার চালক।

ভেদরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. কামরুল হাসান জানান, মান্নানের বিরুদ্ধে রাজধানীর আদাবর থানায় হত্যা মামলা রয়েছে, ভেদরগঞ্জ থানায়ও দুটি মারামারির মামলা পাওয়া গেছে। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বিজয় দিবসে রক্তাক্ত স্মৃতি

২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে জেলার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার রক্তাক্ত হয়। গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি অ্যাডভোকেট ফিরোজ হোসেন মুন্সী বলেন, সেদিন ফুল অর্পণ শেষে বের হওয়ার সময় আমাদের ওপর হামলা হয়। অন্তত ২০ জন রক্তাক্ত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি হয়। বিজয়ের দিনও শহীদ মিনারে আমরা নিরাপদ ছিলাম না।

বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর

হামলা-নির্যাতন

জেলা যুবদলের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জামাল উদ্দিন বিদ্যুতের নামে মামলা হয়েছে সাতটি। বহুবার জেলে যেতে হয়েছে তাকে। নির্বাচনের আগে তার বাড়িতে বারবার ভাঙচুর চালানো হয়। এই দৃশ্য সহ্য করতে না পেরে তার বাবা স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে ২১ দিন জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থেকে মারা যান।

জামালের স্ত্রী শিপা আক্তার বর্তমানে জেলা মহিলা দলের সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক। তাকেও বারবার নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। এমনকি কোনো কোনো নির্বাচনের সময় বাড়ির সামনে বসানো হয়েছিল পুলিশি পাহারা, এতে পরিবারটি আতঙ্কে দিন কাটায়। জামাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা ঘরে ঘুমাতে পারতাম না। ১৫ বছরের মধ্যে হয়তো ১৫ মাসও শান্তিতে নিজের বাড়িতে থাকতে পারিনি।’

ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সহ-সাধারণ সম্পাদক সেলিম রেজা স্মৃতিচারণ করে বলেন, ‘জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর ছাত্রদলের রাজনীতি করতাম। পুলিশের হয়রানি ছিল প্রতিদিনের ব্যাপার। একবার খালেদা জিয়ার মুক্তির আন্দোলনে গ্রেপ্তার হলাম। তখন আমার মা বুকফাটা আহাজারি করলেন। কয়েক দিন পর তিনি মারা যান। আমি তখন কারাগারে। হাত-পা শিকলবন্দি অবস্থায় আমাকে জানাজায় অংশ নিতে দেওয়া হয়।’

সাবেক ছাত্রদল নেতা সরদার নাজমুল হুদা বলেন, ‘বাজারে আমাদের বিএনপির কার্যালয় ভেঙে ফেলা হয়, আসবাবপত্র লুট হয়। শুধু আমাকে নয়, আমার বাবা-ভাইদের বিরুদ্ধেও একাধিক মামলা দেওয়া হয়। ভাইদের ধরে নিয়ে নির্মমভাবে মারধর করা হয়। ভয় আর আতঙ্কে রাত কেটেছে ঘরছাড়া হয়ে।’

দখল করা হয় বিএনপি-জামায়াতের

দলীয় কার্যালয়

২০০৬ সালে জামায়াতের জেলা কার্যালয় ভেঙে দেওয়া হয়, উপজেলা কার্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেগুলো আর আওয়ামী লীগের সরকারের সময় খুলতে দেওয়া হয়নি। এই সময়ে বিএনপির কার্যালয়ও দখল করে নেওয়া হয়।

জুলাই বিপ্লবে নিহত ১৪

আহত অন্তত ৮৩ জন

২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবে শরীয়তপুরে সরকারি হিসাবে শহীদ হন ১৪ জন। শহীদদের মধ্যে রয়েছেন মামুন মিয়া, দুলাল এম, রিয়াজুল তালুকদার, মনোয়ার হোসেন, বাঁধন, আল-আমিন, জালাল উদ্দিন, জুনায়েদ হোসেন, নূর মোহাম্মদ সরদার, ইমন হোসেন আকাশ, মিরাজুল ইসলাম অর্ণব, রাজিব হোসেন।

এছাড়া আন্দোলনে আহত হন অন্তত ৮৩ জন। এর মধ্যে ঢাকার উত্তরা আজিমপুরের এক দোকানে কাজ করতেন শরীয়তপুরের মমিন। জুলাই অভ্যুত্থানের আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে তিনি দুচোখের আলো হারিয়েছেন। এখন অসহায় জীবনে বৃদ্ধা মায়ের ওপর সম্পূর্ণভাবে নির্ভর করতে হচ্ছে মমিনকে।

অন্যদিকে শরীয়তপুর সদরের ভ্যানচালক রিয়াজুল তালুকদার আন্দোলনের চতুর্থ দিনে পুলিশের গুলিতে হারান প্রাণ। পরিবার হারায় একমাত্র ভরসার স্তম্ভকে। ছোট ছোট সন্তানের কান্না আর্তনাদে ভারী হয়ে ওঠে ঘর। সংসার এখন টিকে আছেন মানুষের দয়া-দাক্ষিণ্যের ওপর। পরিবারটির দাবি, সরকার যেন তাদের পাশে দাঁড়ায়। এলাকাবাসীরও একটাই দাবিÑ‘রিয়াজুলের পরিবারের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতে সরকারকে অবশ্যই উদ্যোগ নিতে হবে।’

ভুক্তভোগী ও রাজনৈতিক নেতাদের বক্তব্য

জামায়াত ইসলামের কেন্দ্রীয় মসজিসে শূরার সদস্য কে এম মকবুল হোসাইন আমার দেশকে বলেন, আওয়ামী লীগ আমলে আমাদের রাজনৈতিক ময়দান ছিল কণ্টকাকীর্ণ। আমরা কোনো কাজ করতে পারতাম না। কোরআন প্রশিক্ষণ চলাকালে জঙ্গি তকমা দিয়ে আমাদের শত শত কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। থানায় নিয়ে ওসি নিজে নির্যাতন চালিয়েছে।

কে এম মকবুল হোসাইন বলেন, ‘শুধু আমাদের নয়, বরং দেশপ্রেমিক সব দলের জন্যই সময়টা ছিল কঠিন। রাজনৈতিক কার্যালয়গুলো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার হতো। জামিনে মুক্তির পরও জেলগেট থেকে আবার গ্রেপ্তার করা হতো।’

জেলা জামায়াত আমির মাওলানা আব্দুর রব হাসেমী বলেন, দীর্ঘ সাড়ে ১৫ বছর আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিল না। দোয়া মাহফিলের মতো ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও পুলিশ হামলা চালিয়ে নিরীহ মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে, দিয়েছে অসংখ্য মিথ্যা মামলা। তিনি জানান, শরীয়তপুরে জামায়াত কোনো প্রকাশ্য কর্মসূচি করতে পারেনি। এমনকি একবার গোসাইরহাটে মিলাদে যোগ দেওয়া ২০-২৫ জন শিক্ষক-শ্রমজীবী মানুষকেও মিথ্যা ককটেল মামলায় ফাঁসানো হয়।

সাবেক সংসদ সদস্য ও শরীয়তপুর জেলা বিএনপির সভাপতি সফিকুর রহমান কিরণ বলেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিএনপি নেতাকর্মীরা ভয়াবহ দুঃসময়ের মুখোমুখি হয়। অনেকেই এলাকা ছেড়ে পালাতে বাধ্য হয়েছেন, কেউ দেশছাড়া হয়েছেন। যারা দীর্ঘদিন জেলে ছিলেন তাদের পরিবার অভাব-অনটনে দিন কাটিয়েছে। একজন কর্মী ছিলেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী। মামলা-হামলায় তিনি কারাগারে থাকায় তার ছোট শিশু ও পরিবার অমানবিক কষ্টে দিন কাটিয়েছে।

জেলা বিএনপির সভাপতি আরো বলেন, ‘৫ আগস্টের পর কিছু নেতাকর্মী যারা অতীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে আঁতাত করে বিএনপির রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন না, তাদের তাণ্ডবও আমরা দেখেছি। আমি একটি কথাই স্পষ্ট করে বলতে চাইÑ মানুষ যেন ইতিহাস না ভুলে যায়। কোন দল, কোন সংগঠন, কোন সময়ে কী করেছেÑ তা জাতিকে মনে রাখতে হবে।’