Image description
 

বেক্সিমকো গ্রুপসহ ১০ শিল্প কারখানার মালিকেদের অর্থ সহায়তা করে বিপাকে পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য এসব শিল্প কারখানার মালিকদের সাড়ে ৭০০ কোটি টাকার বেশি সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। অনেক মালিককে বারবার বলার পরেও ঋণের টাকা ফেরত দিচ্ছে না। 
তাই যথাসময়ে ঋণ ফেরত না দিলে সংশ্লিষ্ট শিল্প কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সরকার। প্রয়োজনে প্রতিষ্ঠানের জমি, কারখানা, যন্ত্রপাতি বিক্রি করে হলেও ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ঋণের সকল টাকা পরিশোধ করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে বলে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান। এ ছাড়া পলাতক মালিকদের বিরুদ্ধে রেডনোটিস জারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত বছর ৫ আগস্টের পরে বিভিন্ন শিল্প কারখানায় বেতন বকেয়া পড়ায় আন্দোলন শুরু করেন শ্রমিকরা। তাই শ্রম অসন্তোষ নিরসনের লক্ষ্যে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঋণ চুক্তির আওতায় অর্থ বিভাগ এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কেন্দ্রীয় তহবিল হতে ১০টি প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে ৭০১ কোটি ৬০ লাখ ৫৫ হাজার ১১৫ টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার।

 

এর মধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয়েছে ৭৬ কোটি ১৪ লাখ ৫৫ হাজার ১১৫ টাকা। এ ছাড়া অর্থ বিভাগ থেকে দেওয়া হয়েছে ৬২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে ৯টি প্রতিষ্ঠানের ঋণ পরিশোধের সময় অতিক্রম হয়ে গেছে। শুধু একটি প্রতিষ্ঠানের সময় আগামী ২৯ নভেম্বর পর্যন্ত রয়েছে বলে কর্মকর্তারা জানান।
সম্প্রতি ঋণের অর্থ আদায়ের জন্য শিল্প কারখানার মালিক ও বিজিএমইএ এবং বিকেএমইএ’র নেতৃবৃন্দের নিয়ে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন। বৈঠকে সরকার প্রদত্ত সুদমুক্ত ঋণ যথাসময়ে ফেরত না দিলে সংশ্লিষ্ট শিল্প কারখানার মালিকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ পদক্ষেপ গ্রহণের ঘোষণা দেন তিনি। 
সভায় অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিব, ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিনিধি, বিজিএমইএ-এর সভাপতি এবং সংশ্লিষ্ট ঋণগ্রহীতা কারখানার মালিকরা উপস্থিতি ছিলেন। সভায় উপস্থিত ছিলেন শ্রম ও কর্মসংস্থান  মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা।
রেড নোটিস জারির উদ্যোগ ॥ এ বিষয়ে শ্রম ও কর্মসংস্থান এবং নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন জানান, বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকরা শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় শ্রম অসন্তোষ নিরসনের লক্ষ্যে সরকার বার্ডস গ্রুপ, টিএনজেড গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, ডার্ড গ্রুপ, নায়াগ্রা টেক্সটাইলস লি., রোয়ার ফ্যাশন লি., মাহমুদ জিন্স লি., স্টাইল ক্রাফট লি. এবং গোল্ডস্টার গার্মেন্টস লি.-কে অর্থ বিভাগ এবং কেন্দ্রীয় তহবিল, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় থেকে সুদমুক্ত ঋণ প্রদান করে। 
কিন্তু সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ চুক্তির আওতায় উক্ত অর্থ পরিশোধ করছেন না। তাদের বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থানে যাবে। তাদের পাসপোর্ট জব্দের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে কয়েকজন পলাতক মালিকের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেডনোটিস জারির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পলাতক মালিক ও ্রতিষ্ঠানের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের পাসপোর্ট স্থগিত রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
বৈঠকে শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা জোর দিয়ে বলেন, ‘এই ঋণের টাকা শ্রমিকের টাকা এবং জনগণের ট্যাক্সের টাকা। এ টাকা আগামী ডিসেম্বর মাসের মধ্যে পরিশোধ করতে হবে। এই ক্ষেত্রে কোনোরকম ছাড় দেওয়া হবে না। এ সময় তিনি সংশ্লিষ্ট শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক ও প্রতিনিধিদের সংশ্লিষ্ট লিয়েন ব্যাংকের সঙ্গে আলোচনা করে প্রতিষ্ঠানের জমি, কারখানা, যন্ত্রপাতি বিক্রি করে হলেও ডিসেম্বর মাসের মধ্যে ঋণের সকল টাকা পরিশোধ করতে বলেন। এ বিষয়ে বিজিএমইএ ও বিকেএমইএ-কে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান তিনি।
১০ প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয় ৭০০ কোটি টাকার বেশি ॥ শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, শ্রম অসন্তোষ নিরসনের লক্ষ্যে শ্রম মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে ঋণ চুক্তির আওতায় অর্থ বিভাগ এবং শ্রম মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কেন্দ্রীয় তহবিল হতে ১০ প্রতিষ্ঠানকে বিভিন্ন সময়ে ৭০১ কোটি ৬০ লাখ ৫৫ হাজার ১১৫ টাকা সুদমুক্ত ঋণ দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে বার্ডস গ্রুপ কোম্পানিকে গত বছর ১১ নভেম্বর সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয় ১৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয় ৫ কোটি টাকা ও অর্থ বিভাগ থেকে দেওয়া হয় ১৪ কোটি টাকা। শ্রম মন্ত্রণালয়ের টাকা পরিশোধের সময় ছিল ২০২৫ সালের ১১ মে। কিন্তু এখনো টাকা পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি। 
একই অবস্থা টিএনজেড গ্রুপের। শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য এই কোম্পানিকে দুই দফায় ২৮ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার। এর মধ্যে গত বছর ২৮ নভেম্বর ১৬ কোটি টাকা এবং চলতি বছর ২৮ মে আরও ১২ কোটি টাকা দেওয়া হয়। এর মধ্যে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয় ১৮ কোটি টাকা এবং অর্থ বিভাগ থেকে দেওয়া হয় ১০ কোটি টাকা। প্রথম ঋণের টাকা পরিশোধের সময় ছিল গত ২৭ মে। দ্বিতীয় ঋণের টাকা পরিশোধের সময় ছিল গত ২৮ আগস্ট। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি।   
সবচেয়ে খারাপ অবস্থা বেক্সিমকো গ্রুপের। এই কোম্পানির শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য দুই দফায় প্রায় ৫৮৫ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার। এর মধ্যে গত বছর ২১ নভেম্বর শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে দেওয়া হয় ৯ কোটি ৫৩ লাখ ৮৭ হাজার ৩৮১ টাকা এবং অর্থ বিভাগ থেকে হয় ৫০ কোটি টাকা। এ ছাড়া গত ৬ মার্চ অর্থ বিভাগ থেকে আরেক দফায় ৫২৫ কোটি ৪৬ লাখ টাকা দেওয়া হয় বেক্সিমকো গ্রুপকে। প্রথম দফা ঋণ পরিশোধের সময় ছিল গত ২১ মে। দ্বিতীয় দফা ঋণ পরিশোধের সময় গত ৬ সেপ্টেম্বর। কিন্তু এখনো ঋণ পরিশোধ করেটি বেক্সিমকো গ্রুপ।
একই অবস্থা ইয়োলো এ্যাপারেলস লিমিটেড কোম্পানির। গত বছর ২০ নভেম্বরে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য এই কোম্পানিকে শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ৩৭ কোটি ৩২ হাজার ২০০ টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার। এই টাকা পরিশোধের সময় ছিল গত ২০ মে। কিন্তু এখনো এই ঋণ পরিশোধ করেনি কোম্পানিটি।
একইভাবে গত বছর ১০ ডিসেম্বর ডার্ড গ্রুপকে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য অর্থ বিভাগ থেকে ১৩ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার। এই ঋণ পরিশোধের সময় ছিল গত ২৭ মে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ঋণ পরিশোধ করেনি তারা।
নায়াগ্রা টেক্সটাইলস লিমিটেড নামের অপর এক কোম্পানিকে গত বছর ৪ জুন শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য ১৮ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার। এই টাকা পরিশোধের সময় ছিল গত ২৭ আগস্ট। কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ঋণ পরিশোধ করেনি।
রোয়ার ফ্যাশন লিমিটেড নামের একটি গার্মেন্টস কোম্পানিকে গত ২৭ মার্চ শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ১ কোটি ২৩ লাখ ৩৫ হাজার ৫৩৪ টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেয় সরকার। গত ২৭ জুনের মধ্যে এই ঋণ পরিশোধের সময় দেওয়া হয়। কিন্তু তারাও ঋণ পরিশোধ করেনি। 
মাহমুদ জিন্স লিমিটেড নামের এক গার্মেন্টস কোম্পানিকে গত ২৮ মে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ২১ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। ঋণ পরিশোধের জন্য তিন মাস সময় দেওয়া হয়। সে হিসেবে গত ২৮ আগস্ট এই সময় অতিক্রম হয়েছে। কিন্তু এখন পর্যন্ত এ ঋণের টাকা পরিশোধ করেনি।
গোল্ডস্টার গার্মেন্টস লিমিটেড নামের একটি কোম্পানিকে শ্রমিকদের বকেয়া মজুরি পরিশোধের জন্য গত বছর ৪ এপ্রিল শ্রম মন্ত্রণালয় থেকে ১ কোটি টাকা সুদমুক্ত ঋণ দেওয়া হয়। এই ঋণ পরিশোধের সময় ছিল গত বছর ৯ জুলাই পর্যন্ত। কিন্তু এখন পর্যন্ত ঋণ পরিশোধ করেনি তারা।