Image description
 

দিনাজপুরের ঘাসুরিয়ায় স্বল্পস্থায়ী এক যুদ্ধে অসম সাহসের সঙ্গে লড়াই করে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে (বিএসএফ) পরাজিত করেছিলেন মেজর (অব.) জায়েদী আহসান হাবিব। এটা ২০০৮ সালের জানুয়ারির কথা। তবে এর পরের বছরই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের দিন তিনি প্রথম সেনা কর্মকর্তা হিসেবে আহত হন। নির্মম এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী তিনি। দেড় দিন বন্দি থাকার পর সৌভাগ্যবশত তিনি জীবিত ফিরে আসতে পেরেছিলেন। আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দেওয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে ঘাসুরিয়া যুদ্ধ সম্পর্কে খোলাখুলি আলাপ করেছেন সাবেক এ সেনা কর্মকর্তা। জানিয়েছেন পিলখানা হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে নানা অজানা তথ্য।

আমার দেশ-এর পাঠকের জন্য সাক্ষাৎকারের প্রথম পর্বের চুম্বক অংশ তুলে ধরা হলো­—

আমার দেশ : আহসান হাবিব সাহেব কেমন আছেন?

মেজর জায়েদী : স্যার, ভালো আছি।

আমার দেশ : আপনার কাছ থেকে জানতে চাই বীরত্বপূর্ণ ঘাসুরিয়ার সেই লড়াইয়ের কথা। আপনি যদি সংক্ষেপে সেই লড়াইয়ের কথা আমাদের একটু বলতেন।

মেজর জায়েদী : ধন্যবাদ স্যার। বিডিআরে আমার পোস্টিং হয় ২০০৭ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর ৪০ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক হিসেবে। পোস্টিং ছিল নাইক্ষ্যংছড়িতে। কিছুদিন পর জানতে পারলাম আমাদের ব্যাটালিয়ন দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে চলে যাবে। ফুলবাড়ীর ১৫ রাইফেলস ব্যাটালিয়ান নাইক্ষ্যংছড়িতে চলে আসবে। এটা সব সময় হয়। আমি অগ্রবর্তী দলে একশ সৈনিক নিয়ে নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে ফুলবাড়ীতে আসি ২০০৮ সালের জানুয়ারির ১০ বা ১২ তারিখের দিকে। এসেই আমি আমার সৈন্যদের বিভিন্ন গ্রুপে ভাগ করে ১০টা বিওপিতে ৮০ জনকে পাঠিয়ে দিই। ২০ জনকে নিয়ে আমি হেডকোয়ার্টারে থাকি। ২৯ জানুয়ারি সকাল আটটা সাড়ে আটটার দিকে আমার কাছে একটা কল আসে। কল করে সিপাহি ওয়াহিদুজ্জামান। সে ফোন করে বলে যে, স্যার, বিএসএফ আমাদের অ্যাটাক করেছে। নায়েক লাতু খানের পেটে গুলি লেগেছে। তিনি টহল কমান্ডার। তার গুলি লেগেছে এবং নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে গিয়েছে। তখন বাটন ফোন ছিল। আমি গুলি ও লাতু খানের গোঙানির শব্দ শুনছিলাম। তো আমি মোটামুটি কনফার্ম হলাম খবর সত্য। তারপর আমাদের আবার চ্যানেলের মাধ্যমেও জানতে পারলাম বিষয়টি সম্পর্কে। জানলাম, হিউজ ফায়ার হচ্ছে। এই সময় আমার কমান্ডিং অফিসার ছিলেন নাইক্ষ্যংছড়িতে। স্যারকে কল করলাম। স্যার কল ধরছিলেন না। স্যার বান্দরবানে গিয়েছিলেন কোনো কাজে। তো ওটা হলো না যখন তখন আমি সেক্টর কমান্ডারকে ফোন করলাম। সেক্টর কমান্ডার বারবার কেটে দিচ্ছিলেন। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন কর্নেল রেজা স্যার। পরবর্তী সময়ে তিনি শহীদ হয়েছেন। কেটে দিচ্ছিলেন কারণ আমার ফোনটা তো নতুন। নতুন নম্বর। তিনি বুঝতে পারছিলেন না। আমি যেহেতু নতুন, ওখানে ১৫ রাইফেল ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ককে বললাম বিষয়টা, তিনি আমার সিনিয়র। তিনি বললেন, জায়েদী আমি অসুস্থ, আমার হার্টে সমস্যা আছে। তুমি সিদ্ধান্ত নাও। তখন কোনো উপায় না পেয়ে, আই টুক দ্য ডিসিশন। ৩০ জন সৈনিক ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার থেকে নিলাম এবং সামনে ছিল ভাইগড়, দাউদপুর ও কাতলা এই তিনটা বিওপি থেকে আরও ৩০ সৈনিকসহ মোট ৮০ জন সৈনিক নিয়ে আমি মুভ করলাম। অন্য বিওপিদের বললাম যে, তোমরা চলে আসো, একটা প্লেস দিলাম, সেখান থেকে আমি চলে গেলাম অপারেশন এলাকায়। অপারেশন এলাকায় গিয়ে আমি দল দুইটা ভাগে ভাগ করে দিলাম। তবে যাওয়ার আগে আমি আমার ফ্যামিলির সঙ্গে একটু কথা বলেছিলাম। আমি যাচ্ছি, দোয়া করো। ওরা বুঝতে পারেনি। একটা রিজার্ভ পার্টি রেখে তখন আমি আমার সৈনিকদের উদ্ধারের চেষ্টা করছি। উদ্ধারের চেষ্টা করছি। কিন্তু পারছিলাম না। কারণ তারা (বিএসএফ) দুই দিক থেকে গুলি করছে, ক্রসফায়ার করছে এবং এখান থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন ওখানকার আমার যে টুআইসি ছিল রিজার্ভ পার্টির কমান্ডার ওকে বললাম যে, তুমি এক কাজ করো। তুমি দুই দলে ভাগ হয়ে যাও। একটি দল ডানে অ্যাটাক করো, আরেক দল বামে। তাদের অ্যাটাকিং এত ক্ষিপ্র ছিল যে, বিএসএফ লেজ গুটিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। আমি তখন লাতু খান, ওয়াহিদুজ্জামান, কায়েস, মতি— এ চারজন এবং সঙ্গে আরেকজনকে (বন্দি বিএসএফ অফিসার ইন্সপেক্টর ওম প্রকাশ) উদ্ধার করে নিয়ে আসি। লাতু খান তখনও জীবিত। রক্তপাত হচ্ছিল। আমাদের ক্ষিপ্রতা দেখে বিএসএফ পিছু হটল। এই সময়ে পিলখানা থেকে কর্নেল হালিম স্যার আমাকে ফোন করলেন। ফোন করে বললেন, জায়েদী কী হলো, তোমাদের কী অবস্থা। আমি এখন স্যার ব্যাটলে। স্যার আমি কথা বলতে পারছি না। আমি একটু পরে কথা বলি। স্যার বললেন, ঠিক আছে। একটু পরে দেখি আমার সেক্টর কমান্ডার আমাকে রিং করেছেন। তিনি বললেন, আই এম ব্যাক। দুই কোম্পানি সৈন্য নিয়ে আমি আসছি। তুমি কী আধা ঘণ্টা ওয়েট করতে পারবা বা কনটিনিউ করতে পারবা? আধা ঘণ্টা কেন স্যার, এখন সিচুয়েশন আমার কন্ট্রোলে, আমি পারব, কোনো সমস্যা নেই স্যার। তো এই অবস্থায় গোলাগুলি হচ্ছে, এমন সময়ে দেখি হঠাৎ করে বিএসএফ সাদা পতাকা উঠিয়ে দিল। তখনও আমরা গুলি বন্ধ করিনি। আমি পারমিশন নিচ্ছিলাম। হালিম স্যারকে ফোন করলাম। স্যার বললেন যে, এটা ট্র্যাপ হতে পারে। তুমি যেহেতু নতুন গিয়েছ আর্মি থেকে তুমি অনেক কিছু জান না, ওরা যদি ফায়ার বন্ধ না করে তুমি ফায়ার বন্ধ করবা না। ওরা সাদা পতাকা উঠিয়েছে ভালো কথা, কিন্তু ওরা কী ফায়ার বন্ধ করেছে? আমি বললাম না স্যার, ওরা ফায়ার বন্ধ করেনি। ওরা যদি ফায়ার বন্ধ না করে তুমি ফায়ার বন্ধ করবা না। একটু অপেক্ষা করো, তোমার সেক্টর কমান্ডার ব্যাক করেছে, সে আসতেছে। সেক্টর কমান্ডার আসার পরই তুমি ডিসিশন নিও। তারপর সেক্টর কমান্ডার এলেন। তার আগেই আমার কাছে একটা ম্যাসেজ এলো বিএসএফ থেকে। জিজ্ঞাসা করল যে, ওম প্রকাশ বেঁচে আছে কিনা। তাকে দেখালাম যে, ওম প্রকাশ বেঁচে আছে। সে ভালো আছে এবং আমরা তাকে যুদ্ধবন্দির মতো মর্যাদা দিয়েছি। তখন বিএসএফের ডিআইজি মালিক স্যার ফোন করলেন আমাকে। রিকোয়েস্ট করলেন গুলি থামাতে। আমি বললাম স্যার আপনারাও থামান গুলি। একদিক দিয়ে গুলি থামাতে বলে, অন্যদিকে তারা গুলি থামাচ্ছে না। তাদের গুলির প্রতি উত্তরে আমিও গুলি ছুড়ছি। এরপর তারা মর্টার ফেলল। মর্টার যখন ফেলল, তখন আমি বললাম, এটা তো অন্যদিকে মোড় নিচ্ছে। এটা সিরিয়াস যুদ্ধের দিকে চলে যাচ্ছে। মর্টার ফায়ারিং শুরু হয়ে গেল। তখন সেক্টর কমান্ডার রেজাউল করিম (পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহীদ) আমাকে বললেন, জায়েদী তুমি আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো আমি আসছি, তাদের আইজি রাওয়াতের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, হি ইজ অন দ্য ওয়ে, আমিও অন দ্য ওয়ে, তুমি আরেকটু কনটিনিউ করো যুদ্ধটা। আমিও কনটিনিউ করতে থাকি। একই সময়ে স্যার এলেন। তারপর ম্যাসেঞ্জারের মোবাইল থেকে আর এস রাওয়াত স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। মোটামুটি তখন পরিস্থিতি শান্ত হতে থাকে। যখন শান্ত হয়ে যায় তখন তিনি আমাকে বলেন, তুমি সাদা পতাকা উড্ডয়ন করো। আমি সাদা পতাকা উড্ডয়ন করি। সাদা পতাকা উড্ডয়ন করার পরপরই তারা (বিএসএফ) হাফ ছেড়ে বাঁচে। যুদ্ধ থেমে গেছে।

আমার দেশ : আহত লাতু খানের কী হলো?

মেজর জায়েদী : একটা কথা আমি ভুলে গিয়েছি বলতে। লাতু খানকে উদ্ধার করার সময় বিএসএফের গুলিতে দুজন সিভিলিয়ন আহত হয়। একজনের নাম নুরুল হক বা নুরুল ইসলাম আরেকজনের নাম তোফাজ্জল। একজনের কানে, আরেকজনের কাঁধে গুলি লাগে। তাদের তিনজনকে আমরা ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টারে পাঠিয়ে দিই। ব্যাটালিয়ন হেডকোয়ার্টার ফুলবাড়ীতে। তখন ডিজি জেনারেল শাকিল স্যার বিডিআর হেডকোয়ার্টার থেকে ফুলবাড়ীতে চলে আসেন। যখন স্যার দেখলেন যে, সিচুয়েশন আন্ডার কনট্রোল, তখনও তিনি চলে যাননি। আহতদের ফার্স্ট এইড দেওয়া হলো। তাদের হেলিকপ্টার যোগে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হলো। ব্যাটল তো শেষ হয়ে গেল। এখন হবে পতাকা বৈঠক। বৈঠক হওয়ার সময় তিন দিক থেকে তারা ঘিরে আছে, প্রায় কয়েকশ রাইফেল আমাদের দিকে তাক করা এবং আমাদের বলছে তাদের নো ম্যানস ল্যান্ডে যেতে হবে। স্যার গ্রাউন্ড পর্যবেক্ষণ করলেন। কর্নেল রেজা স্যার। তিনি বললেন, জায়েদী, গ্রাউন্ড তো তাদের অনুকূলে। কী করব? আমি বললাম, কোনো সমস্যা নেই স্যার। বৈঠক যখন হবে যেতেই হবে আমাদের। কারণ আমাদের কাছে তাদের একটা অফিসার আছে। সুতরাং তারা যদি পাগল না হয় ফায়ার করবে না। স্যার বললেন, ঠিক আছে। আমি বললাম স্যার, আমাদের রিজার্ভ পার্টির কমান্ডার সুবেদার শফি সাহেব সে এমন ট্রেইনড, আমি তাকে একটা ফর্মুলা দিয়ে এসেছি ‘ওয়ান ইজ টু থ্রি’, যদি আমাদের কোনো কিছু হয় স্যার সে ‘ওয়ান ইজ টু টেন’-এ নিয়ে যাবে। তখন স্যার বললেন, হোয়াট ইস দ্যাট ফর্মুলা? তুমি এটা কী বলতেছ? আমি বললাম, স্যার পরে আপনাকে জানাব। এটা ব্যাটলে হিউমার। এরপর নো ম্যানস ল্যান্ডের দিকে রওয়ানা দিলাম, বৈঠকের জন্য। বৈঠক হলো। বৈঠকের প্রথমেই ওরা জানতে চাইল তাদের অফিসারের কথা। কেমন আছে সে? তখন তাদের বললাম, তোমরা কখনও প্রথমে ফায়ার করবা না। তোমরা ফায়ার করছ সেজন্য আমরা ফায়ার করেছি। তখন আমরা তাদের একটা উদাহরণ দিলাম। মিয়ানমার সীমান্তের উদাহরণ। সে সীমান্ত আমরা কীভাবে ডিল করি সেটি। কিছুদিন আগে আমরা মিয়ানমার সীমান্তে গিয়েছিলাম তখন আমাদের সঙ্গে তাদের আচরণ ছিল ভ্রাতৃত্বপূর্ণ, আর তোমাদের আচরণ এমন কেন? এরপর তারা বলল, তারা আগে আর কখনও ফায়ার করবে না। এই এক মর্মে বৈঠক শেষ হয়ে গেল।

আমার দেশ : বিএসএফ অফিসারকে কী ওইদিনই হ্যান্ডওভার করেছিলেন?

মেজর জায়েদী : জি, ওইদিনই হ্যান্ডওভার করে দিয়েছি।

আমার দেশ : আর লাতু খান তো পরে হসপিটালে চলে গেল?

মেজর জায়েদী: জি

আমার দেশ : আপনাকে ধন্যবাদ।

মেজর জায়েদী : আপনাকেও ধন্যবাদ।

অনুলিখন: হাসান আদিল