Image description

পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) বর্তমানে উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. এস এম হেমায়েত জাহান। যখন শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ হয় তখন সংশ্লিষ্ট শর্ত পূরণের যোগ্যতাই ছিল না। কারণ, তিনি রাজধানীর একটি কলেজ থেকে এক বিভাগে স্নাতক করেন, আর বিশ্ববিদ্যালয়টিতে শিক্ষক হন আরেক বিভাগের। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই দুই বিভাগের ডিসিপ্লিনে কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। তারপরও রাজনৈতিক প্রভাবে অস্থায়ী নিয়োগ হয় তার।

শুধু তাই নয়, পরে যে বিভাগে তার স্থায়ী নিয়োগ হয়, সেই বিভাগে তিনি আবেদনই করেননি। কর্তৃপক্ষ স্বপ্রণোদিত হয়ে ওই বিভাগটিতে তার নিয়োগ স্থায়ী করে। তারপর বিভাগটি থেকে পদোন্নতি হতে হতে অধ্যাপক, অবশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য পর্যন্ত হয়েছেন তিনি। উপ-উপাচার্য হওয়ার পর থেকে তার প্রথম নিয়োগ ও পদোন্নতির ব্যাপারে হওয়া অনিয়ম নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে কানাঘুষা শুরু হয়েছে। 

জানা যায়, পটুয়াখালীর দুমকি উপজেলা সদরের পটুয়াখালী কৃষি কলেজকে ২০০০ সালের ৮ জুলাই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে উদ্বোধন করেন। ২০০১ সালের ১২ জুলাই জাতীয় সংসদে পটুয়াখালী কৃষি কলেজ বিলুপ্ত করে ‘পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ আইন পাস হয় এবং ২০০২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সরকারি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সেটি বাস্তব রূপ লাভ করে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে নিযুক্ত হন অধ্যাপক ড. এ কে এম আব্দুল হান্নান ভূঁইয়া। উপাচার্য হয়ে ২০০৩ সালের ১ ডিসেম্বর তিনি এস এম হেমায়েত জাহানকে পবিপ্রবির কৃষি বনায়ন (এগ্রোফরেষ্ট্রি) বিভাগে প্রভাষক হিসেবে এডহক ভিত্তিতে (অস্থায়ী) নিজ ক্ষমতাবলে নিয়োগ দেন। অথচ হেমায়েত জাহান তৎকালীন জগন্নাথ কলেজ থেকে এগ্রোফরেষ্ট্রির সঙ্গে সংম্পর্কিত নয়— এমন অন্য বিভাগ থেকে (প্রাণিবিদ্যা) স্নাতক সম্পন্ন করেছেন; যা নিয়োগের প্রধান শর্তই পূরণ করেনি বলে সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ কে এম আব্দুল হান্নান ভূঁইয়া বিএনপি সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরীর সুপারিশে তার এই নিয়োগ দেন। এরপর ২০০৫ সালের ২২ নভেম্বর এক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর ২০০৬ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগে হেমায়েত জাহান স্থায়ীভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। তবে সূত্র জানায়, তিনি প্রভাষক নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী কীটতত্ত্ব বিভাগে আবেদনই করেননি, আবেদন করেছিলেন এগ্রোফরেষ্ট্রি বিভাগে। তারপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. মু. ওয়াহিদ-উ-জ্জামানকে সভাপতি করে গঠিত সাত সদস্যের নিয়োগ বোর্ড তার স্থায়িত্ব নিশ্চিত করে।

এ নিয়োগ বোর্ডের অন্যতম সদস্য ছিলেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ময়মনসিংহ) এগ্রোফরেস্ট্রি বিভাগের অধ্যাপক ড. জি. এম. মুজিবর রহমান। বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ার পর আমাকে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য করা হয়েছিল। তার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল হান্নান ভূঁইয়া হেমায়েত জাহানকে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কারণ, উপাচার্য নিজ ক্ষমতাবলে অস্থায়ী নিয়োগ দিতে পারেন।

 

তিনি বলেন, তারপর অধ্যাপক ওয়াহিদ-উ-জ্জামান উপাচার্য হন। তখন দেখা গেল হেমায়েত জাহানের অ্যাপোয়েন্টমেন্ট আগেই হয়ে গেছে এবং তার অনার্স-মাস্টার্সে প্রাণিবিদ্যা-কীটতত্ত্ব ছিল, এজন্য তার ডিসিপ্লিনের সাথে সামঞ্জস্যতা রক্ষার্থে কীটতত্ব বিভাগে আমরা (নিয়োগ বোর্ড) দিয়ে দিলাম, যেহেতু ওখানে (বিশ্ববিদ্যালয়) প্রাণিবিদ্যা নেই। আর প্রাণিবিদ্যার সঙ্গে কীটতত্বের সম্পর্ক রয়েছে, এগ্রোফরেস্ট্রির নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল হান্নান ভূঁইয়া হেমায়েত জাহানকে এডহক ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কারণ, উপাচার্য নিজ ক্ষমতাবলে অস্থায়ী নিয়োগ দিতে পারেন। যখন দেখা গেল হেমায়েত জাহানের অ্যাপোয়েন্টমেন্ট আগেই হয়ে গেছে এবং তার অনার্স-মাস্টার্সে প্রাণিবিদ্যা-কীটতত্ত্ব ছিল, এজন্য তার ডিসিপ্লিনের সাথে সামঞ্জস্যতা রক্ষার্থে কীটতত্ব বিভাগে (নিয়োগ বোর্ড) দিয়ে দিলাম, যেহেতু ওখানে (বিশ্ববিদ্যালয়) প্রাণিবিদ্যা নেই। আর প্রাণিবিদ্যার সঙ্গে কীটতত্বের সম্পর্ক রয়েছে, এগ্রোফরেস্ট্রির নেই।—অধ্যাপক ড. জি. এম. মুজিবর রহমান, নিয়োগ বোর্ড সদস্য

অধ্যাপক ড. জি. এম. মুজিবর রহমানের ভাষ্য, আলতাফ হোসেন চৌধুরী বিএনপির একজন নামকরা মানুষ। তাদের সুপারিসে হেমায়েত জাহানের প্রথম নিয়োগটা হয়েছে। পরে আমরা দেখলাম ভবিষ্যত জীবনে নিয়োগপ্রাপ্ত বিভাগ থেকে ক্যারিয়ার ডেভেলপ করতে কষ্ট হবে, পিএইডি করতে পারবে না। সেজন্য আমরা তাকে সরিয়ে ওখানে (কীটতত্ত্ব বিভাগ) পাঠিয়ে দিয়েছি, যাতে ওখান থেকেই ডেভেলপ করেন। পরে অবশ্য ডেভেলপ করেছেনও। বিভাগে তার কন্ট্রিবিউশনও আছে। আমরা জাস্ট তাকে একটা রিলেভ্যান্ট জায়গায় দিয়েছি, যাতে তার ক্যারিয়ার সঠিক জায়গা থেকে ডেভেলপ হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয়কে সার্ভ করতে পারেন।

পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক বিশ্ববিদ্যালয়টির এক শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে হেমায়েত জাহানের নিয়োগ নিয়ে মাঝেমধ্যে শিক্ষকদের মাঝে কানাঘুষা হয়। বিশেষ করে, তিনি প্রোভিসি হওয়ার পর বিষয়টি নিয়ে বেশি কথা হচ্ছে। তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেছেন এবং অধ্যাপক হয়ে নিজেকে ডেভেলপ করেছেন, এটা সত্যি। কিন্তু তার নিয়োগে সরাসরি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছিল, এটা ওপেন সিক্রেট। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ছাড়া এক ডিসিপ্লিন ছাড়া অন্য ডিসিপ্লিনে এরকমভাবে নিয়োগের নজির নেই।

এ বিষয়ে নিজের বক্তব্য জানতে চাইলে অধ্যাপক ড. এস এম হেমায়েত জাহান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০০২ সালে শিক্ষক নিয়োগের প্রথম বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়। আমি প্রাণিবিদ্যা বিভাগে স্নাতক এবং কীটতত্ত্ব বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জনের উভয় ক্ষেত্রে প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হই। কীটতত্ত্বে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার জন্য পূর্ণ একাডেমিক যোগ্যতা, যৌক্তিকতা ও যথার্থতা অর্জন করায় আমি কীটতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য আবেদন করি। কর্তৃপক্ষ ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে আমাকে সামাজিক বনায়ন ও পরিবেশ বিভাগে প্রভাষক হিসেবে অ্যাডহক নিয়োগ প্রদান করেন। যেহেতু উদ্ভিদবিজ্ঞান অনার্স লেভেলে আমার সাপ্লিমেন্টারি ছিল এবং আমার পঠিত বিষয়ের মধ্যে এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ও জু-জিওগ্রাফি ছিল, সেহেতু কর্তৃপক্ষ আমাকে সামাজিক বনায়ন ও পরিবেশ বিভাগে অ্যাডহক ভিত্তিতে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে।

তিনি আরও বলেন, ২০০৫ সালে সামাজিক বনায়ন ও পরিবেশ বিভাগের নাম পরিবর্তন করে কৃষি বনায়ন করা হয়। তখন সিলেকশন বোর্ড সদস্যদের সুপারিশক্রমে আমার অর্জিত শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে, পূর্বে কীটতত্ত্ব বিভাগে আবেদনের প্রেক্ষিতে, আমাকে কীটতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করেন। যদিও আমি কৃষি বনায়ন বিভাগে সাক্ষাৎকার দিতে গেলে উক্ত বোর্ডের বিজ্ঞ বিশেষজ্ঞ সদস্যগণ আমার শিক্ষাগত যোগ্যতা বিশ্লেষণ করে কীটতত্ত্ব বিভাগে প্রভাষক হিসেবে সাক্ষাৎকারের জন্য আমার আবেদন কীটতত্ত্ব নিয়োগ বোর্ডে রেফার করেন।

নিয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষাগত যোগ্যতার সাথে অসামঞ্জস্যতা আছে কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি প্রাণিবিদ্যা বিভাগে স্নাতক (অনার্স) ডিগ্রি অর্জন করি। এখানে স্পষ্টত প্রাণিবিদ্যা হচ্ছে জীববিজ্ঞানের একটি বিস্তৃত শাখা, যেখানে অণুজীব থেকে উচ্চতর প্রাণী পর্যন্ত সমগ্র প্রাণিজগতের গঠন, শারীরবৃত্তীয় কার্যাবলী, শ্রেণিবিন্যাস ও পরিবেশগত ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়। এর মধ্যে কীটতত্ত্ব একটি বিশেষায়িত শাখা। তাছাড়া আমি স্নাতকোত্তরে সরাসরি কীটতত্ত্বে উচ্চতর শিক্ষা গ্রহণ করেছি, যা কৃষি অনুষদের কীটতত্ত্ব বিভাগে শিক্ষকতার ক্ষেত্রে সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক বিষয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতির সাথে নিয়োগ অসামঞ্জস্য কিনা? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য সাধারণত শর্তাবলি থাকে। যেমন: সংশ্লিষ্ট বিষয়ে অন্তত স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করা, ভালো একাডেমিক রেকর্ড থাকা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে গবেষণার যোগ্যতা বা প্রকাশনা থাকলে তা বাড়তি সুবিধা। আমার ক্ষেত্রে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি সরাসরি কীটতত্ত্বে। স্নাতক ডিগ্রি প্রাণিবিদ্যায়, যা কীটতত্ত্বের মূলভিত্তি এবং শিক্ষা জীবনের প্রতিটি স্তরে প্রথম বিভাগে সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হয়েছি। সুতরাং, নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির একাডেমিক শর্তাবলির সাথে সম্পূর্ণ সঙ্গতিপূর্ণ।

তবে নিয়োগ বোর্ডের সদস্য অধ্যাপক ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ময়মনসিংহ) এগ্রোফরেস্ট্রি বিভাগের শিক্ষক ড. জি. এম. মুজিবর রহমান দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যেহেতু তার নিয়োগ হয়ে গিয়েছিল; তাই আমরা তার নিয়োগ বাতিল করতে পারি না। বাতিলের উপায়ও ছিল না, যেখানে উপাচার্য নিজে তার নিয়োগ দিয়েছেন এবং রাজনৈতিক রেজিমের (বিএনপি) মাধ্যমে তিনি (হেমায়েত জাহান) এসেছিলেন। বাদ দিলে তো আমরাই টিকতে পারতাম না। 

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (পবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী রফিকুল ইসলামকে কল দেওয়া হলে তিনি মন্তব্য করতে রাজি হননি।