Image description

নিষিদ্ধঘোষিত ছাত্রলীগ নেতাকর্মীদের নির্মম নির্যাতনে প্রাণ হারানো বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী আজ। মৃত্যুর ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও ছেলে হত্যায় জড়িত পলাতক আসামিদের গ্রেফতার ও বিচারের রায় কার্যকর না হওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন আবরারের মা রোকেয়া খাতুন ও বাবা বরকত উল্লাহ।

ছেলের ছবি, শোকেসে সাজানো ব্যবহৃত জিনিসপত্র আর হাজারো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে কোনোরকম বেঁচে আছেন তারা। অপরদিকে, আবরার ফাহাদের স্বপ্নের বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনসহ পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করে অতি দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন স্বজন ও এলাকাবাসী। 

কুষ্টিয়া শহরের পিটিআই সড়কের পাশে আবরার ফাহাদের বাড়িতে এখনও শোকেসে সাজানো তার মোবাইল ফোন, ল্যাপটপসহ ব্যবহৃত জিনিসপত্র। আগের মতোই ঘরে রয়েছে বিছানা ও পড়ার টেবিল। শুধু নেই আবরার ফাহাদ। এর মধ্যে কেটে গেছে ছয়টি বছর। ছেলের ব্যবহৃত জিনিসপত্র আর হাজারো স্মৃতি আঁকড়ে ধরে কোনোরকম বেঁচে আছেন আবরারের মা রোকেয়া খাতুন ও বাবা বরকত উল্লাহ। সন্তানের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা মনে হলেই শিউরে ওঠেন প্রতি মুহূর্তে। 

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর নিজ হাতে খাইয়ে কুষ্টিয়া থেকে বাসে তুলে দিয়েছিলেন বুয়েটের উদ্দেশে। ওই দিনটাই ছিল আবরারের সঙ্গে মায়ের শেষ দেখা। সেই বিদায় যে সন্তানের শেষ বিদায় হবে, আর বুকে ফিরবে না নাড়িছেঁড়া ধন, তা তখনও অজানা ছিল মা রোকেয়া খাতুনের। সেই দিন রাতেই ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা ক্যাম্পাসের শেরে বাংলা হলে অমানবিক নির্যাতন করে হত্যা করে আবরার ফাহাদকে। মৃত্যুর ৬ বছর পেরিয়ে গেলেও ছেলে হত্যার বিচারের রায় কার্যকর না হওয়ায় চরম ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন তারা। রয়েছে সন্তানের হত্যায় জড়িতদের পলায়নের আক্ষেপও। 

আবরারের বাবা মো. বরকত উল্লাহ বলেন, ‘যে বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের জন্য আবরার ফাহাদ শহীদ হয়েছেন, তার সেই স্বপ্নের বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনসহ পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করে দ্রুত রায় কার্যকরের দাবি জানাই।’

মা রোকেয়া খাতুন বর্তমানে আবরারের একমাত্র ছোট ভাই বুয়েটের যন্ত্রকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাইয়াজের সঙ্গে ঢাকায় বসবাস করেন। 

দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে এমন নির্মম হত্যাকাণ্ড এখনও তাড়িয়ে বেড়ায় আবরারের পরিবারসহ স্বজনদের। আবরার ফাহাদ হত্যার সঙ্গে জড়িত পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করে দ্রুত রায় কার্যকর ও আবরারের স্বপ্নের বৈষম্যহীন রাষ্ট্র গঠনের দাবি জানান প্রতিবেশীরা। 

এদিকে ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে নানা কর্মসূচি হাতে নিয়েছে শহীদ আবরার ফাহাদ স্মৃতি গ্রন্থাগার। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘আবরার ফাহাদের মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) শহীদ আবরার ফাহাদ স্মৃতি গ্রন্থাগারে আলোচনা সভা, দোয়াসহ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। অতি দ্রুত পলাতক আসামিদের গ্রেফতার করে রায় কার্যকরের দাবি জানাই।’

শহীদ আবরার ফাহাদ স্মৃতি গ্রন্থাগারের উপদেষ্টা সুলতান মারুফ তালহা বলেন, ‘শহীদ আবরার ফাহাদ এ দেশের একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। যে নক্ষত্রটি এ দেশের মুক্তির আলোকবর্তিকা নিয়ে এসেছে। অন্যায় ও আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে মানুষ কীভাবে দাঁড়াতে পারে একক ব্যক্তি হয়ে সে কিন্তু দেখিয়ে গেছে। শহীদ আবরার ফাহাদ শুধু একটি নাম নয়, একটা স্ফুলিঙ্গ। আবরার ফাহাদের খুনিরা বাইরে ঘুরে বেড়ায় আর আমরা বিছানায় ঘুমাই, এটা আমাদের কাছে অত্যন্ত লজ্জার। অতি দ্রুত শহীদ আবরার ফাহাদের হত্যাকারীদের গ্রেফতার করে রায় কার্যকরের দাবি জানাচ্ছি।’

আবরার ফাহাদের বাবা বরকত উল্লাহ বলেন, ‘আবরার হত্যা মামলা আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে। আমরা আবেদন জানিয়েছি, বিচারটা যেন তাড়াতাড়ি শুরু করে। দ্রুত শুরু হলে আমরা হয়তো ন্যায়বিচার পাবো। তা ছাড়াও আবরার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত ছিল এর মধ্যে চার জন আসামি এখনও পলাতক রয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘এসব আসামিদের আগে ধরার উদ্যোগ নিলেও এখন আর অভিযান চালাচ্ছে না। আমরা দাবি জানিয়েছি, যাতে তাদের ধরার ব্যবস্থা করা হয়। তা ছাড়া যে রায় হয়েছে সেটা হাইকোর্টে বহাল আছে। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই, রায়টি যাতে দ্রুত কার্যকর করা হোক।’

উল্লেখ্য, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে স্ট্যাটাসের জেরে বুয়েটের শেরে বাংলা হলের আবাসিক ছাত্র ও তড়িৎকৌশল বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আবরার ফাহাদকে ২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর দিবাগত রাতে নিষিদ্ধ ছাত্রসংগঠন ছাত্রলীগের এক নেতার কক্ষে নিয়ে নৃশংস কায়দায় পিটিয়ে হত্যা করে সংগঠনটির কিছু নেতাকর্মী। পরে রাত ৩টার দিকে শেরে বাংলা হলের সিঁড়ি থেকে তার মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় ১৯ জনকে আসামি করে পরদিন ৭ অক্টোবর চকবাজার থানায় একটি হত্যা মামলা করেন আবরারের বাবা বরকত উল্লাহ। ৩৭ দিনে তদন্ত শেষ করে একই বছরের ১৩ নভেম্বর চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা।

২০২১ সালের ৮ ডিসেম্বর আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন আদালত। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক আবু জাফর মো. কামরুজ্জামান ওই রায় ঘোষণা করেন।

২০২২ সালের ৬ জানুয়ারি এ মামলার ডেথ রেফারেন্স হাইকোর্টে এসে পৌঁছায়। ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১ থেকে ৬ হাজার ৬২৭ পৃষ্ঠার ডেথ রেফারেন্স ও মামলার যাবতীয় নথি হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পাঠানো হয়। পরে কারাবন্দি আসামিরা জেল আপিল করেন। পাশাপাশি অনেক আসামি ফৌজদারি আপিল আবেদন করেন। ১০ ফেব্রুয়ারি আবরার ফাহাদ হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শুরু হয় এবং ২৪ ফেব্রুয়ারি শেষ হয়।

এ বছরের ১৬ মার্চ ওই মামলায় বিচারিক আদালতের দেওয়া ২০ জনের মৃত্যুদণ্ড ও পাঁচ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্টের বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ।