
ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সামনে নতুন চ্যালেঞ্জ যোগ হয়েছে এআই (আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অপব্যবহার। আর এআই-ভিত্তিক অপব্যবহার প্রতিরোধে ইসি কতটা প্রস্তুত- সেই আলোচনাই এখন সচেতন মহলে।
অনেকেই বলছেন, নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা থেকে শুরু করে সহিংসতা সৃষ্টি, সবই সম্ভব এআই-ভিত্তিক মিসইনফরমেশন, ডিসইনফরমেশন বা ম্যালইনফরমেশনের মাধ্যমে। কেননা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কোনো বিষয়কে সত্যের মতো উপস্থাপন খুবই সহজ ব্যাপার, যা সাধারণ মানুষের চোখে ধরা নাও পড়তে পারে। যে কারণে দেশি-বিদেশি নানা চক্র চাইলেই করতে পারে এই প্রযুক্তির অপব্যবহার।
নির্বাচন কমিশনের (ইসি) সঙ্গে সংলাপে বসে অনেকেই এ নিয়ে কার্যকর প্রতিরোধের ব্যবস্থা নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন এ নিয়ে বলেন, ‘বর্তমানে প্রচুর ভুয়া তথ্য, ভুল তথ্য, ফেক ইমেজ এবং এআই–নির্ভর বিভ্রান্তিকর কনটেন্ট ছড়িয়ে পড়ছে। নির্বাচনের সময় এগুলোর প্রভাব আরও বাড়বে। এরইমধ্যে বিশেষজ্ঞরা এ নিয়ে সতর্ক করছেন। এক্ষেত্রে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ, বিশেষজ্ঞ ও রিসোর্স ব্যবহার করলে তারা নিশ্চয়ই সহায়তা করতে আগ্রহী হবেন। এতে ফেক নিউজ ও এআই–নির্মিত ভুয়া কনটেন্ট প্রতিরোধ করা সহজ হবে। ’
এক্ষেত্রে তথ্যের অবাধ প্রবাহকে বিঘ্নিত না করে বরং গণমাধ্যমের স্বাধীনতাও নিশ্চিত করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘পুরো নির্বাচন ব্যবস্থায় গণমাধ্যম যেন সুষ্ঠুভাবে কাজ করতে পারে, সংবাদ সংগ্রহ করতে পারে, যাতে কোনো ভ্রান্ত ধারণা তৈরি না হয়। শুরু থেকেই সবার কাছে সমস্ত তথ্য যেন পৌঁছায়, নির্বাচনের প্রস্তুতি থেকে শুরু করে ভোটগ্রহণ ও ফলাফল প্রকাশ পর্যন্ত; সবক্ষেত্রেই গণমাধ্যমের সঠিক ভূমিকা জরুরি। ’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল উপাচার্য ড. নিয়াজ আহমদ এ বিষয়ে বলেন, ‘আইটির ব্যবহার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আইটি সাপোর্টেড যে কোনো জিনিস, আমাদের যেহেতু অবকাঠামোগত দুর্বলতা আছে, বারবার টেস্ট করা প্রয়োজন। আইটি সার্ভিসের ফেসভ্যালু আছে। অবকাঠামোগত দুর্বলতার কারণে সমস্যা করলে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বাসযোগ্যতায় প্রভাব ফেলবে। কাজ করলে উপকার করবে। আর যদি কাজ না করে তাহলে সমস্যা অনেক বেশি হবে। যাদের আইটি জ্ঞান আছে এবং যাদের নেই; এটা নিয়ে মতপার্থক্য দেখা যায়। চূড়ান্ত বিচারে খুব ক্ষতি করে। তাই বারবার পরীক্ষা করার ব্যাপার আছে। ’
সোস্যাল মিডিয়ায় ইসির নিয়ন্ত্রণ থাকবে না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, ‘ভয়ানক রকম অন্যায় কথাবার্তা, হ্যারাজমেন্ট, বুলিং মোকাবিলায় আইন-কানুন যা আছে তা সাংঘাতিক দুর্বল। আইনের দুর্বলতা আছে। ফেসবুকে রিপোর্ট করলেই বাংলাদেশ থেকে বন্ধ করা যায় না। সিলেকটিভলি করতে হয়। তাই ঠাণ্ডা্ মাথায় চিন্তা করার বিষয় আছে। ’
তিনি বলেন, ‘প্রথমত ধরে নিতে হবে, যারা নির্বাচনে হারবেন তারা অসন্তুষ্ট থাকবেন। শিষ্টাচার বলে কিছু থাকলেও তার ওপর ভরসা করা যাবে না। সেফগার্ড মেজার নিয়ে নামতে হবে। মানে আশেপাশে যত মিডিয়া বা সিসিটিভি রাখা যায়। যত চোখ আশেপাশে রাখা যায়। যতবেশি সংখ্যক সাংবাদিক বা ক্যামেরা বলেন, যত ভিজিবল রাখা যায়, প্রয়োজনে অতিরিক্ত। ’
যা বলছে ইসি
নির্বাচন কমিশন আইনি সংস্কার ছাড়াও নিজেদের স্বচ্ছ্তা এবং সঠিক তথ্যের প্রবাহের উদ্যোগও নিয়েছে। নির্বাচন কমিশনার আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ এ বিষয়ে বাংলানিউজকে বলেন, ‘মিসইনফরমেশন ঠেকানো যাবে না পুরোপুরি। তবে আমরা যদি সত্য তথ্যটা সঠিকভাবে উপস্থাপন করতে পারি, তাহলে এই সমস্যা মোকাবেলা করা যাবে। আমরা এরইমধ্যে এআই-ভিত্তিক অপপ্রচার আইনি কাঠামো এনে নিষিদ্ধ করেছি। গণমাধ্যম যেন সঠিকভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করতে পারে সেজন্যও গণমাধ্যম নীতিমালা পুনর্মূল্যায়ন করছি। ’
এআই-ভিত্তিক অপপ্রচার রোধে কমিশন এরইমধ্যে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের নিজস্ব অবস্থান ঘোষণা দিয়েছে। কমিশনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, নিজস্ব ফেসবুক পেইজ ও ইউটিউব চ্যানেল থেকে সকল কার্যক্রম পরিচালনার তথ্য এবং বিভিন্ন ব্রিফিংয়ের বিষয়গুলো প্রচার, প্রকাশ করবে। ইতিমধ্যে তা শুরু করেছে নির্বাচন আয়োজনকারী সংস্থাটি। ইসি কর্মকর্তারা বলছেন, এই উদ্যোগের মাধ্যমে সত্য প্রতিষ্ঠা হবে। আর অপপ্রচার রোধ করা যাবে।
এ বিষয়ে সিইসি এমএম নাসির উদ্দিন ইতিমধ্যে বলেছেন, ‘আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) প্রযুক্তির অপব্যবহার রোধে সহায়তা দিতে চায় কানাডা। জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচি-ইউএনডিপি আমাদের পাশে আছে। তারা গ্যাপ থাকলে তা পূরণ করবে বলে জানিয়েছে। মিসইউজ অব এআই (এআই প্রযুক্তির অপব্যবহার) নিয়ে কথা হয়েছে। এটা আমাদের জন্যও হুমকি। আমরাও এ বিষয়ে গুরুত্ব দিয়ে কাজ করছি। ডিজিটাল প্লাটফরমে তারা বিষয়টি ছর্ট (sort) করতে চেয়েছে। গত বছর তাদের (কানাডা) নির্বাচনে এটা ফেস করতে হয়েছে। তাই তারা তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে সাজেশন দেবে। ’
প্রার্থিতা বাতিল, হতে পারে জেল জরিমানা:
অন্যদিকে আইনি কাঠামোয় বিষয়টি প্রথমবারের মতো আনা হয়েছে। ফলে এআই-এর অপব্যবহারে প্রার্থী ও দলকে শাস্তি পেতে হবে। ভোটে অসৎ উদ্দেশ্যে প্রার্থী, তার এজেন্ট বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ব্যবহার করলে প্রার্থিতা বাতিল করে দেবে ইসি। একই সঙ্গে হতে পারে জেল জরিমানা। কেবল প্রার্থী নয়, দলের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও থাকছে সংশ্লিষ্ট দলের জরিমানা।
রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর নির্বাচনি আচরণ বিধিমালায় ১৬ বিধি সংযোজন করে বলা হয়েছে, কোনো প্রার্থী বা তার নির্বাচনি এজেন্ট বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণা পরিচালনা করতে পারবেন। তবে এক্ষেত্রে- প্রার্থী বা তার নির্বাচনি এজেন্ট বা দল বা প্রার্থী সংশ্লিষ্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের নাম, অ্যাকাউন্ট আইডি, ই-মেইল আইডিসহ অন্যান্য সনাক্তকরণ তথ্যাদি প্রচার-প্রচারণা শুরুর পূর্বে রিটার্নিং অফিসারের নিকট দাখিল করতে হবে; প্রচার-প্রচারণাসহ নির্বাচন সংশ্লিষ্ট কোনো বিষয়ে অসৎ উদ্দেশ্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করা যাবে না; ঘৃণাত্নক বক্তব্য, ভুল তথ্য, কারো চেহারা বিকৃত করা ও নির্বাচন সংক্রান্ত বানোয়াট তথ্যসহ কোনো প্রকার ক্ষতিকর কনটেন্ট বানানো ও প্রচার করা যাবে না; প্রতিপক্ষ, নারী, সংখ্যালঘু বা অন্য কোনো জনগোষ্ঠীকে লক্ষ্য করে ঘৃণাত্মক বক্তব্য, ব্যক্তিগত আক্রমণ বা উসকানিমূলক ভাষা ব্যবহার করা যাবে না; নির্বাচনি স্বার্থ হাসিল করার জন্য ধর্মীয় বা জাতিগত অনুভূতির অপব্যবহার করা যাবে না; সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নির্বাচন সংক্রান্ত সকল কনটেন্ট শেয়ার ও প্রকাশ করার পূর্বে সত্যতা যাচাই করতে হবে; রাজনৈতিক দল, প্রার্থী বা প্রার্থীর পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি, ভোটারদের বিভ্রান্ত করার জন্য কিংবা নারী-পুরুষ নির্বিশেষে কোনো প্রার্থী বা ব্যক্তির চরিত্র হনন কিংবা সুনাম নষ্ট করার উদ্দেশ্যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বা অন্য কোনো মাধ্যমে, সাধারণভাবে বা সম্পাদন (Edit) করে কিংবা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তথা Artificial Intelligence (AI) দ্বারা কোনো মিথ্যা, বিভ্রান্তিকর, পক্ষপাতমুলক, বিদ্বেষপূর্ণ, অশ্লীল ও কুরুচিপূর্ণ এবং মানহানিকর কোন আধেয় (content) তৈরি, প্রকাশ, প্রচার ও শেয়ার করতে পারবেন না।
শাস্তির ক্ষেত্রে বিধিমালায় বলা হয়েছে-কোনো প্রার্থী বা তার পক্ষে অন্য কোনো ব্যক্তি নির্বাচন পূর্ব সময়ে (তফসিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনের ফলাফল গেজেট আকারে প্রকাশ পর্যন্ত সময়) এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক ছয় মাসের কারাদণ্ড অথবা অনধিক এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডনীয় হবে; আর কোনো নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল নির্বাচন পূর্ব সময়ে এই বিধিমালার কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে অনধিক এক লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টাকা অর্থদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।
এদিকে কমিশন যদি মনে করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির সংঘটিত অপরাধ প্রার্থিতা বাতিল হওয়ার মতো, তাহলে তদন্ত করে প্রার্থিতা বাতিল করতে পারবে।
আগামী ফেব্রুয়ারির প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের লক্ষ্যে নির্ধারণ করে ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে তফসিল দিতে চায় নির্বাচন কমিশন। এজন্য সব প্রস্তুতি এগিয়ে নিচ্ছে সংস্থাটি।