Image description
মেশিন দরকার ১৭০টি সরকারিভাবে আছে ১২টি

দেশে অন্তত ৩৮ ধরনের ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছেন মানুষ। এর মধ্যে শ্বাসনালি, স্তন, মুখ, পাকস্থলী এবং জরায়ু মুখের ক্যানসারের রোগী বেশি। তবে বর্তমানে দেশের ক্যানসার রোগী কত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান সরকারি বা বেসরকারিভাবে কোথাও নেই। চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্যানসার রোগীদের মধ্যে অন্তত ৮০ শতাংশের জন্য রেডিওথেরাপি চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। কিন্তু তাদের চিকিৎসার জন্য নেই অতি প্রয়োজনীয় মেশিনটি। প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়, দেশে সরকারি হাসপাতালে মাত্র ১২টি রেডিওথেরাপি মেশিন আছে। ইন্টারন্যাশনাল এটমিক এনার্জি এজেন্সি (আইএইএ) বলছে, বাংলাদেশে রোগী অনুপাতে কমপক্ষে ১৭০টি রেডিওথেরাপি মেশিন দরকার।

বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএমএমইউ) দেশের কিশোরগঞ্জ জেলায় জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসারের সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ে গবেষণা করেছিল। ওই জেলার গবেষণাসূত্র ধরে গবেষকরা জানান, দেশে প্রতি লাখে ক্যানসারে আক্রান্তের সংখ্যা ১০৬ জন। এছাড়া প্রতি বছর প্রতি লাখে নতুন করে ক্যানসার আক্রান্ত হচ্ছেন ৫৩ জন। গবেষণার তথ্যে আরও বলা হয়, মোট মৃত্যুর ১২ শতাংশের জন্য দায়ী ক্যানসার।

বর্তমানে দেশে সরকারি ব্যবস্থাপানয় যে ১২টি রেডিওথেরাপি মেশিন রয়েছে, এর মধ্যে মাত্র ২টি (লিনাক) মেশিন আছে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের রোগীদের জন্য। এছাড়া ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি (কোবাল্ট) ও একটি (ব্র্যাকিথেরাপি) মেশিনসহ দুটি, রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি (কোবাল্ট), চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে একটি (কোবাল্ট), সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে একটি (কোবাল্ট) মেশিন আছে। অপরদিকে স্বায়ত্তশাসিত বাংলাদেশ মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি (লিনাক) মেশিন রয়েছে। এর বাইরে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) দুটি রেডিওথেরাপি (লিনাক) মেশিন রয়েছে। ঢাকা মেডিকেল, বগুড়ায় শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুটি (লিনাক) অকেজো অবস্থায় পড়ে আছে। দিনাজপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালেও একটি মেশিন অকোজা অবস্থায় রয়েছে। এ ছাড়া রংপুর, খুলনা, বরিশাল ও ময়মনসিংহ-এই চার বিভাগে কোনো সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেই রেডিওথেরাপি চিকিৎসা নেই।

বেসরকারিভাবে ঢাকায় আহসানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতাল, ডেল্টা হাসপাতাল, স্কয়ার হাসপাতাল, ল্যাব এইড ক্যানসার হাসপাতাল, এভারকেয়ার হাসপাতাল, ইউনাইটেড হাসপাতাল ও সাভারের এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রেডিওথেরাপির ব্যবস্থা আছে। ঢাকার বাইরে খাজা ইউনুস আলী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (সিরাজগঞ্জ), টিএমএসএস মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (বগুড়া), নর্থইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (সিলেট), চট্টগ্রামে মা ও শিশু হাসপাতাল এবং এভারকেয়ার হাসপাতালে এ সেবা চালু আছে। বেসরকারি হাসপাতালের মধ্যে শুধু ডেল্টা ও আহসানিয়া মিশন ক্যানসার হাসপাতালে কোবাল্ট ও লিনাক ব্যবহার হয়। বাকিগুলোতে লিনাক মেশিন রয়েছে। বেসরকারি ব্যবস্থায় চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এ কারণে রোগীদের অন্তত ৮০ শতাংশ মাঝপথে চিকিৎসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। এমন পরিস্থিতিতে দেশের ৮ বিভাগে পূর্ণাঙ্গ ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্র চালুর কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করার কথা বলেছেন বিশেষজ্ঞরা। ক্যানসার হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও এমনটি বলেছে। পাশাপাশি ৮ বিভাগে দ্রুত রেডিওথেরাপি মেশিন স্থাপন করে সারা দেশের রোগীদের চিকিৎসার আওতায় আনার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। জামালপুরের আবু সুফিয়ান (৫৬) চিকিৎসার জন্য ময়মনসিংহ মেডিকেলে আসা-যাওয়ায় দুই বছর কেটে যায়। গত ফেব্রুয়ারিতে বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে চিকিৎসকরা ঢাকায় জাতীয় বক্ষব্যাধি হাসপাতালে রেফার্ড করেন। ১৭ দিন ভর্তি থাকার পর ফুসফুস ক্যানসার সন্দেহে মার্চ মাসে ক্যানসার হাসপাতালে পাঠানো হয় তাকে। ৭ মাস ঘুরে বিভিন্ন পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ৮টি কেমোথেরাপি দেওয়া হয় তাকে। চিকিৎসকরা আরো ৩৩টি রেডিওথেরাপি দিতে পরামর্শ দেন। কিন্তু দুই মাস ঘুরেও থেরাপির জন্য সিরিয়াল পাননি। তার শারীরিক পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটলে ফের কোমোথেরাপি শুরু করা হয়।

জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. জাহাঙ্গীর কবীর যুগান্তরকে বলেন, ৫০০ শয্যার হাসপাতালে ৮০ শতাংশই ঢাকার বাইরের রোগী। দিনে ২০০ জন রেডিওথেরাপি নিতে আসেন। অথচ তাদের সে ধরনের সেবার ব্যবস্থা নেই। এতে করে রোগীদের দীর্ঘ সিরিয়ালে পড়তে হচ্ছে।

তিনি জানান, এই হাসপাতালে ২০০৭ সালে ছয়টি রেডিওথেরাপি মেশিন বসানো হয়। প্রতিটি মেশিনের আয়ুষ্কাল ছিল ১০ বছর। ২০১৭ সালে সবগুলোর মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। বর্তমানে সবগুলোই অকেজো ঘোষণা করা হয়েছে। আমি দায়িত্ব পেয়ে দুটি নতুন মেশিন বসিয়েছি। সারা দেশের ক্যানসার রোগীদের রেডিয়েশন থেরাপি দিতে ১৮০টি মেশিন দরকার হলেও সরকারি-বেসরকারিভাবে আছে ৩৫টি মেশিন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্যানসারের চিকিৎসা সারাজীবন নিতে হয়। আরলি স্টেজ (প্রাথমিক পর্যায়) বিশেষ করে প্রথম থেকে তৃতীয় পর্যায়ে পর্যন্ত রোগী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পেলে সুস্থ হয়। অ্যাডভান্স স্টেজে এলে ক্যানসার নিরাময় করা সম্ভব হয় না। ৮ বিভাগে পুরাতন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে কেমোথেরাপি চিকিৎসা কমবেশি থাকলেও রেডিওথেরাপি চিকিৎসা না থাকা অত্যন্ত বেদনার। বেসরকারি হাসপাতালে ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয় জোগাতে প্রায় ৮০ শতাংশ রোগী ব্যর্থ হন বলে জানান তারা।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ (ক্লিনিক্যাল অনকোলজিস্ট) কনসালট্যান্ট ডা. নাজিরুম মুবিন যুগান্তরকে বলেন, দেশে ক্যানসারের চিকিৎসায় তিন ধরনের মেশিন ব্যবহার হয়। এগুলো হলো-লিনাক, কোবাল্ট ও ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন। এর মধ্যে সর্বাধুনিক লিনাক মেশিন যার মাধ্যমে সব ধরনের ক্যানসারের চিকিৎসা দেওয়া হয়। কোবাল্ট একটু পুরোনো ধাঁচের হওয়ায় সব ধরনের চিকিৎসা দেওয়া যায় না। তবে খরচ কম। অন্যদিকে ব্র্যাকিথেরাপি মেশিন নারীদের জরায়ুমুখসহ যৌনাঙ্গের ক্যানসার চিকিৎসায় ব্যবহার করা হয়।

তিনি আরও বলেন, দেশে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ক্যানসার চিকিৎসক থাকলেও পদ না থাকায় অনেকে উপজেলা হাসপাতালে অন্য রোগের সেবা দিচ্ছেন। এছাড়া ক্যানসার রোগীর রেডিওথেরাপির ডোজের হিসাব ও বণ্টনে মেডিকেল ফিজিসিস্ট দরকার হলেও হাসপাতালগুলোতে এই পদ নেই। মেশিন পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য রেডিওথেরাপি টেকনোলজিস্ট অপ্রতুল।

চিকিৎসকরা জানান, ক্যানসার চিকিৎসায় রোগীভেদে কেমো ও রেডিওথেরাপির ডোজ কম-বেশি হওয়ায় সঠিক চিকিৎসা খরচ বলা কঠিন। তবে সরকারির তুলনায় বেসরকারি হাসপাতালে এই ব্যয় প্রায় ১০ গুণ বেশি হয়ে থাকে। অর্থাৎ সরকারি হাসপাতালে যে চিকিৎসা ১০ হাজার টাকায়, সেখানে বেসরকারিতে এক লাখ টাকার মতো খচর।

ক্যানসার রোগীদের প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ নির্ণয় এবং সময়মতো চিকিৎসাসেবা নিশ্চিতে সরকার বছর কয়েক আগে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) হাতে নেয়। পরে ২০২০ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর ৮ বিভাগের জন্য প্রস্তাবিত ক্যানসার ইউনিটে ১০০ শয্যাবিশিষ্ট চিকিৎসাকেন্দ্র নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়। পরবর্তীতে এর সঙ্গে কিডনি ও হৃদরোগের চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা হয়। ফলে শয্যা সংখা বাড়িয়ে ১৮০ শয্যার ক্যানসার চিকিৎসাকেন্দ্রে উন্নীত করার পরিকল্পনা হয়। ২০২১ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে প্রকল্পের মেয়াদকাল শুরু হয়। পরের বছর ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়। এক্ষেত্রে রংপুর বিভাগের কেন্দ্রের মেয়াদকাল ধরা হয় কাজ শুরুর পরবর্তী ২৪ মাস। চট্টগ্রামের হাসপাতালের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। বাকিগুলো ২০২৩ সালের মার্চে সম্পন্ন করার কথা ছিল। প্রথমে প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল দুই হাজার ৩৮৮ দশমিক ৩৯ কোটি টাকা। দ্বিতীয় দফায় চিকিৎসা পরিধি বাড়ানোয় ব্যয় ধরা হয় তিন হাজার ৪৩৩ দশমিক ৮১ কোটি টাকা।

প্রকল্পের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্তি মহাপরিচালক (পরিকল্পনা ও উন্নয়ন) ডা. শেখ ছাইদুল হক যুগান্তরকে বলেন, কেন্দ্রের ভৌত অবকাঠামো (ভবন নির্মাণ) সম্পন্ন হয়েছে। জনবল নিয়োগ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম ক্রয়ের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন আছে। ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। কেন্দ্রগুলো চালু হলে ক্যানসার, কিডনি ও হৃদরোগ চিকিৎসার পরিধি বাড়বে।

তিনি বলেন, রেডিয়েশন চিকিৎসার দ্রুত সংকট মোকাবিলায় চারটি রেডিওথেরাপি মেশিন কেনার কার্যক্রম চলছে। আগামী চার থেকে ছয় মাসের মধ্যে জাতীয় ক্যানসার গবেষণা হাসপাতালে দুটি এবং কুর্মিটোলা মেডিকেল, চট্টগ্রাম মেডিকেল, বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিকেলে একটি করে রেডিওথেরাপি মেশিন বসানো হবে।