
কালিয়াকৈরের হরতকিতলা এলাকায় বনের কোলঘেঁষে গড়ে উঠেছে ইকোনিক্স পোশাক কারখানা। বনের ৭৬০ শতক জমি দখল করে বহুতল ভবন তোলার অভিযোগ উঠেছে। শুধু ভবন নয়, বনের জমি দখল করে পাকা রাস্তাও করেছে কারখানাটি। একইভাবে বনের জমি দখল করে গড়ে উঠেছে গার্মেন্ট, ঝুটের গোডাউন, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, বহুতল ভবন, কাঁচা-পাকা বাড়িঘর, দোকানঘর, রাস্তা। দখলকৃত এসব স্থাপনায় কেউ করছেন ব্যবসা, কেউ করছেন বসবাস, কেউ দিচ্ছেন ভাড়া। কেউ আবার বনের পুকুর লিজ নিয়ে গড়ে তুলেছেন কারখানার বর্জ্য ফেলার ডাস্টবিন। সরজমিন ঘুরে স্থানীয়দের কাছ থেকে এসব অভিযোগ পাওয়া গেছে। তারা জানান, যে দলের সরকার ক্ষমতায় আসে সে দলের নেতাদের আশ্রয়ে চলে যান প্রভাবশালী এসব দখলদাররা। এসব অবৈধ দখলদারের বিরুদ্ধে হয়েছে মামলাও। দফায় দফায় উচ্ছেদ করা হয়েছে বিভিন্ন অবৈধ স্থাপনা। কিন্তু অসাধু বনবিভাগের কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে ফের চলে দখল। দিন-দুপুরে চুরি হচ্ছে বনের মূল্যবান গাছও। যেন দেখার কেউ নেই। দখলের বিষয়ে বন কর্মকর্তাদের বক্তব্যও অনেকটা দায়সারা। তারা বলেন, যখনই আমাদের কাছে দখলের অভিযোগ আসে সঙ্গে সঙ্গেই আমরা উচ্ছেদ অভিযান চালাই।
যেভাবে দখল করা হয় বন: কালিয়াকৈর ও কাচিঘাটা রেঞ্জের শত শত একর বন নানা কৌশলে দখল করা হচ্ছে। সরজমিন গিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, যারা বনের জমি দখলের টার্গেট করেন তারা প্রথমে ওই এলাকার বনের মূল্যবান গাছ রাতের আঁধারে কেটে ফেলে রাখেন। এরপর গাছগুলো কৌশলে সরিয়ে নেন। সেই জায়গা পরিষ্কার করে প্রথমে পলিথিনের বেড়া দিয়ে সীমানা দেন। এরপর সেখানে টিনের চালা লাগান। ক’দিন পর সেই চালার চারপাশে টিনের বেড়া দেন। একপর্যায়ে সেই ঘরে বসবাস শুরু করেন। আরেক কৌশলে বন দখল করা হয়। বন দখলের জন্য রেডিমেট ঘর পাওয়া যায়। একটি সিন্ডিকেটকে টাকা দিলেই তারা ৩০ মিনিটের মধ্যে বনের জমিতে এসব রেডিমেট ঘর তৈরি করে দেন। এরপর দখলকারী ব্যক্তি সেই ঘর ভাড়া দেন। আর প্রভাবশালী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো বনের জমি দখল করেন জনপ্রতিনিধি ও বন কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে।
যাদের দখলে বনের জমি: চন্দ্র রেঞ্জ এলাকার খাড়াজোড়ার ইকোনিক্স কারখানা দখল করেছে প্রায় ৭০০ শতাংশ বনের জমি। এ ছাড়া কালামপুরে সোহাগ পল্লী নামের একটি রিসোর্ট দখল করেছে প্রায় ৩০০ শতক বনের জমি, একই এলাকার শিল্পীকুঞ্জ নামের একটি রিসোর্টের দখলে ১০০ শতক, মণ্ডলপাড়া এলাকায় এপেক্স ফুটওয়্যার দখল করেছে ৩০ শতক, চন্দ্রা রেঞ্জের একশ’ গজের মধ্যে সাউদার্ন লি. নামের একটি প্রতিষ্ঠানের দখলে ২০ শতক, ইনক্রেডিবলস নামে একটি প্রতিষ্ঠানের দখলে ২০ শতক, ডিসক্রিট ফ্যাশন নামের একটি কারখানার দখলে ১ একর, চন্দ্র রেঞ্জের এক কিলোমিটারের মধ্যে বনের জমিতে গড়ে উঠেছে প্রায় অর্ধশত ঝুটের গোডাউন, ফায়ার সার্ভিসের আধা কিলোমিটারের মধ্যে বনের জমিতে রয়েছে ১০টি ঝুটের গোডাউন, চন্দ্রা বাজারে তৈরি হয়েছে দোকানঘর।
৫ই আগস্টের পর বন দখলের মহোৎসব: এদিকে গত ৫ই আগস্টের পর বনের অসাধু কর্মকর্তাদের সহযোগিতায় কালিয়াকৈর বনবিভাগের জমি দখল করে হাজার হাজার ঘরবাড়ি ও অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকেই দোতলা ভবন, কেউ টিনশেড, আবার কেউ আধাপাকা ঘর নির্মাণ করেছেন। স্থানীয় অসাধু ব্যক্তিরা অবৈধভাবে ঘর নির্মাণ করে ভাড়া দিয়েছেন। ৫ই আগস্টের পরপর বনের লোকজন মাইকিং করে এসব অবৈধ স্থাপনা ভেঙে সরিয়ে নেয়ার জন্য বলেন। কিন্তু কেউ এ বিষয়ে কর্ণপাত করেননি। চলতি বছরের শুরুর দিকে দু’দফা যৌথবাহিনীর সহযোগিতায় চারটি এস্কেভেটর দিয়ে তিন শতাধিক অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ করা হয়। এ সময় স্থানীয় লোকজন সংঘবদ্ধ হয়ে বনবিভাগের কর্মকর্তাদের ওপর হামলার ঘটনাও ঘটে।
বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কালিয়াকৈরে প্রায় সাড়ে ২১ হাজার একরের বেশি বনভূমি আছে। এ বনকে কালিয়াকৈর ও কাচিঘাটা দু’টি রেঞ্জে ভাগ করা হয়েছে। দু’টি রেঞ্জের আওতায় বোয়ালী, রঘুনাথপুর, খলশাজানি, জাথালিয়া, চন্দ্রা, মৌচাক, বাড়ৈপাড়া, কাশিমপুর, সাভার নামে নয়টি বিট অফিস আছে। এ ছাড়া ভান্নারা ও গোবিন্দপুর নামে আরও দু’টি সাব-বিট অফিস আছে।
কালিয়াকৈর ও কাচিঘাটা এ দু’টি রেঞ্জের বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, কালিয়াকৈর রেঞ্জের চন্দ্রা বিট অফিসের আওতাধীন এলাকায় সবচেয়ে বেশি কারখানা, বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন কাঁচা-পাকা স্থাপনা গড়ে উঠছে। গজারি বাগানসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে বনের জমিতে এসব কাঁচা-পাকা স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে। চন্দ্রা বিট অফিসের কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, অফিসের আওতায় হরতকিচালা গ্রামের এক ব্যক্তি ৩০ হাত লম্বা একটি চারচালা ঘর তুলে ভিটা পাকা করছেন। চন্দ্রার কালামপুর এলাকায় শিল্প কুঞ্জ পার্কের সামনে হুমায়ুন মিয়াসহ তিন-চারজন মিলে ছয়তলাবিশিষ্ট দু’টি ভবন নির্মাণ করেছেন। কালামপুর এলাকার পুরনো সিনেমা হলসংলগ্ন বনের জমিতে বহুতল একটি ভবনের কাজ করছেন সিরাজ উদ্দিন। রাখালিয়াচালা গেসুর টেক এলাকার আমজাদ হোসেনের ২০ হাত আধাপাকা ঘর, শুকুর আলীর ২৫ হাত টিনশেড ঘর এবং ফাতেমার মা নামের মহিলা ৩০ হাত ঘর নির্মাণ করেছেন। এ ছাড়াও মৌচাক সাহেব আলী মার্কেট এলাকায় বাচ্চু ১২ হাত ছাপড়া, উজ্জ্বল ডিমারকেশন ছাড়া ঘরের কাজ করছে, ভান্নারা সাব-বিট-এর আওতায় আলিফ গার্মেন্টস এলাকায় শাহাদাত বনের জায়গায় গজারি গাছ কেটে দোকানঘর এবং সিরাজ ১৪ হাত ছাপড়াঘর নির্মাণ করেছে। এদিকে পূর্ব চান্দরা এপেক্স বাজার এলাকায় বনভূমি দখল করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছে স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এসব বনের জমি রাতারাতি দখল করে শিল্প-কারখানা, বহুতল ভবনসহ বহু কাঁচা-পাকা স্থাপনা গড়ে উঠছে। ফলে উজাড় হয়ে যাচ্ছে বন। বনের গাছ উজাড় ও জমি দখলের সঙ্গে বনদস্যু, ভূমিদস্যু ও বনবিভাগের কিছু অসাধু কর্মকর্তা জড়িত বলে এলাকাবাসী অভিযোগ করে আসছেন।
এ বিষয়ে চন্দ্রা বিটের কর্মকর্তা ইকবাল হোসেন মানবজমিনকে বলেন, ৫ই আগস্টের আগে ও পরে যেসব বনের জমি দখল হয়েছে সেগুলো আমরা উচ্ছেদ করেছি। গতকালও বনের জমিতে গড়ে তোলা অবৈধ ঘর ভেঙে দিয়েছি। আজও (গতকাল) উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে অবৈধ ঘর ভেঙেছি। আমাদের কাছে যেসব দখলের খবর পাচ্ছি সেখানে উচ্ছেদ অভিযান চালাচ্ছি। তবে এখন আর নতুন করে দখল হচ্ছে না। বিট অফিসের সামনেই দিন-দুপুরে বনের মূল্যবান গাছ চুরির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, গাছ চুরির বিষয়টি আমরা দেখি না। বনের অন্য বিভাগ দেখে।
এসব অভিযোগের বিষয়ে চন্দ্রা রেঞ্জের কর্মকর্তা মনিরুল করিমের কাছে জানতে চাইলে তিনি মানবজমিনকে বলেন, আমি অসুস্থ, হাসপাতালে আছি। এ বিষয়ে আমি এখন কথা বলতে পারবো না। এ কথা বলেই ফোনের লাইন কেটে দেন তিনি।