Image description
 

রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকার নাম শোনামাত্রই এখন নগরবাসীর মনে ভেসে ওঠে চুরি, ছিনতাই, ডাকাতিসহ নানা অপরাধের দৃশ্য। এখানকার পরিস্থিতি এতটাই নাজুক যে, পুলিশের কর্মকর্তারাও মনে করেন, রাজধানীর ৫০ থানার মধ্যে অপরাধের শীর্ষে মোহাম্মদপুর।

 
 
আর এই এলাকার অপরাধীদের ‘আস্তানা’ হিসেবে আছে ‘জেনেভা ক্যাম্প’। বছরের পর বছর মাদক নিয়ে সংঘাত, সন্ত্রাসীদের আধিপত্য বিস্তারসহ নানা কারণে প্রায় সময়ই জেনেভা ক্যাম্পে সংঘাত হয়েছে।

 

চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর জেনেভা ক্যাম্প ঘিরে মোহাম্মদপুর এলাকায় কয়েক দফায় সংঘাতে প্রাণহানির পর সাঁড়াশি অভিযানে নামে স্থানীয় থানার পুলিশ ও সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ বাহিনী। সেসময় মাদক কারিবারিসহ অপরাধীদের অনেকে গ্রেপ্তার হয় এবং কারাগারে যায়। কিন্তু আইনের ফাঁক গলে তারা জামিনে বেরিয়ে আবারও অপরাধ কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ার কারণে পরিস্থিতির অবনতি ঘটতে থাকে। সম্প্রতি জেনেভা ক্যাম্পে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি মোহাম্মদপুরের অধিকাংশ এলাকায় ছিনতাই, রাহাজানি, চুরি, মাদকসেবীদের উৎপাত বেড়ে গেছে। প্রকাশ্যে সামুরাই, ছুরিসহ ধারাল অস্ত্র হাতে ছিনতাই, ডাকাতির কিছু সিসিটিভি ফুটেজ অনলাইনেও ছড়িয়েছে।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অপরাধীরা বেপরোয়া হয়ে পড়ার একমাত্র কারণ পুলিশের সহনশীল অবস্থান। এই সুযোগটাই অপরাধীরা নিচ্ছে। পুলিশকে সেই আগের রূপ দেখাতে হবে, যেটা দেখে অপরাধীরা ভয় পায়।

নিয়মিত অভিযান চলছে, তিন মাসে গ্রেপ্তার প্রায় ১২শ’
পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, প্রায় প্রতিদিনই গ্রেপ্তার করা হচ্ছে, বিভিন্ন অপরাধে অভিযুক্ত কিশোর, যুবকসহ নানা বয়সী অপরাধীরা কারাগারে যাচ্ছে। গত ৩ মাসে শুধু মোহাম্মদপুর এলাকায় প্রায় ১২শ’ অপরাধী গ্রেপ্তার হয়েছে। এছাড়া জেনেভা ক্যাম্পসহ মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পাশাপাশি যৌথবাহিনীর অভিযান চলমান।

রোববার (৫ অক্টোবর) র‍্যাব-২ থেকে জানানো হয়, জেনেভা ক্যাম্পে মাদক ও ছিনতাইবিরোধী বিশেষ অভিযানে দেশীয় অস্ত্র ও মাদকদ্রব্যসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এ সময় তাদের কাছ থেকে ছিনতাই কাজে ব্যবহৃত একটি সামুরাই ও চার কেজি ৯৬৪ গ্রাম গাঁজা জব্দ করা হয়।

র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়, জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় বেশ কয়েকটি ছিনতাইকারী চক্র ছিনতাই ও মাদক কারবারসহ বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাসী কার্যক্রম জড়িয়ে পড়ছে। গোপন তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-২ এবং সেনাবাহিনীর যৌথ আভিযানিক দল শনিবার (৪ অক্টোবর) রাতে জেনেভা ক্যাম্পে অভিযান পরিচালনা করে দেশীয় অস্ত্র ও  মাদক উদ্ধারসহ ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তাররা দিনের বেলায় আত্মগোপনে থেকে রাতের বেলায় ছিনতাই, মাদক ও অন্যান্য অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করে আসছিলেন। তাদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন থানায় ছিনতাই ও মাদক সংক্রান্ত মামলা রয়েছে। এসব মামলায় তারা কারাভোগও করেছেন। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট থানায় হস্তান্তর করা হয়েছে।

অন্যদিকে একই দিন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান জানান, রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ২৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারদের মধ্যে মাদক মামলার আসামি, পরোয়ানাভুক্ত আসামি ও বিভিন্ন অপরাধে জড়িত ব্যক্তিরা রয়েছেন।

তার আগে গত শুক্রবার (৩ অক্টোবর) ডিএমপির মিডিয়া সেন্টার থেকে জানানো হয়, গত বৃহস্পতিবার (২ অক্টোবর) মোহাম্মদপুরে অপরাধপ্রবণ এলাকায় বিশেষ অভিযান চালিয়ে ১৪ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এ সময় অস্ত্রসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র উদ্ধার করা হয়।

গত ২০ সেপ্টেম্বর মোহাম্মদপুর থানা পুলিশ জেনেভা ক্যাম্পের চারদিক ‘ব্লক’ করে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অভিযান চালিয়ে চিহ্নিত অপরাধীদের গ্রেপ্তার করে। জব্দ করে বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্য, দেশীয় অস্ত্র ও হাতবোমা (ককটেল)।

গত আগস্টে মাসে জেনেভা ক্যাম্পে যৌথ অভিযানে অস্ত্র ও মাদকসহ ১১ জনকে আটক করা হয়। এ সময় তাদের কাছ থেকে পাঁচ হাজার ৬৬০টি ইয়াবা বড়ি, ৫০০ গ্রাম গাঁজা, তিনটি সামুরাই, দুটি চাপাতি জব্দ করা হয়। সে সময়ও যৌথবাহিনী পুরো এলাকা ‘ব্লক’ করে অভিযান চালায়। ওই মাসেই জেনেভা ক্যাম্পে দুই পক্ষের সংঘর্ষে শাহ আলম (২০) নামে এক তরুণ নিহত হন। এতে জড়িত থাকার অভিযোগে চাপাতিসহ দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে মোহাম্মদপুরের চাঁদ উদ্যান এলাকায় যৌথ বাহিনীর অভিযানকালে গুলিবিনিময়ে দুই ব্যক্তি নিহত হন। ঘটনাস্থল থেকে পাঁচজনকে আটক করে যৌথবাহিনী।

জেনেভা ক্যাম্পের অস্থিরতার নেপথ্যে
জেনেভা ক্যাম্পকেন্দ্রিক অপরাধের বিষয়ে সেখানকার একাধিক প্রবীণ বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বছর কয়েক আগে ক্যাম্পের মাদক কারবারের নিয়ন্ত্রণ ছিল নাদিম হোসেন ওরফে পাচ্চিশ ও ইশতিয়াক নামের দুই ব্যক্তির হাতে। মাদক কারবারের টাকা দিয়ে তারা তৈরি করেছিলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে পূর্বাচলে র‌্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হন পাচ্চিশ। এরপর শোনা যায় ভারতে পালিয়ে যান ইশতিয়াক। আবার মহামারি করানায় আক্রান্ত হয়েও তার মৃত্যুর খবর পাওয়া যায়।

পাচ্চিশ ও ইশতিয়াকের অবর্তমানে ক্যাম্পের মাদক কারবারের দখল নিতে উঠেপড়ে লাগে দুটি পক্ষ। একটি পক্ষের নেতৃত্বে আছেন বুনিয়া সোহেল, আরেকটি পক্ষের নেতা চুয়া সেলিম। আর বুনিয়া সোহেলের সঙ্গে যুক্ত হন সৈয়দপুইরা নামের আরেকটি পক্ষের নেতা বাবু ওরফে সৈয়দপুইরা বাবু।

রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সংঘাতের কারণে প্রায়ই সংবাদের শিরোনাম হচ্ছিল জেনেভা ক্যাম্প। এর মধ্যে গত বছরের ৩১ অক্টোবর সিলেটের কোতোয়ালী ও হবিগঞ্জের মাধবপুর এলাকা থেকে বুনিয়া সোহেলসহ ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। তার দুই মাস বাদে চুয়া সেলিমও গ্রেপ্তার হন। তার আগে ২৯ সেপ্টেম্বর পিচ্চি রাজাসহ ৩১ জনকে গ্রেপ্তারের খবর দিয়েছিল র‌্যাব।  

তেজগাঁও বিভাগের পুলিশ বলছে, এই তিন দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী ও মাদক কারবারি জামিনে জেল থেকে বেরিয়ে আত্মগোপনে চলে যায়। তাদেরও খুঁজে বের করে চেষ্টা করা হচ্ছে।

জেনেভা ক্যাম্পের ওই বাসিন্দারা বলেন, গত বছরের গণঅভ্যুত্থানের পরে যেভাবে মোহাম্মদপুর এলাকা বিশেষ করে এই ক্যাম্পে সন্ত্রাসী, মাদক কারবারিসহ নানান অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল, মনে হয়েছিল মোহাম্মদপুর আর সাধারণ মানুষের বাসযোগ্য থাকবে না, হয়ে যাবে একচ্ছত্র আস্তানা। তবে আইন-শৃঙ্খলাবাহিনী ও যৌথবাহিনী অভিযান চালিয়ে পরিস্থিতির বেশ কিছুটা উন্নত করেছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা কী বলছেন
পুলিশের এক কর্মকর্তার ভাষ্যে, ঢাকার রেলওয়ে থানা (কমলাপুর) ছাড়া ঢাকা মহানগর এলাকায় ৫০ থানার মধ্যে অপরাধ কর্মকাণ্ডের শীর্ষে মোহাম্মদপুর থানাকে এগিয়ে রয়েছে। শুধু এই এক থানা এলাকায় অপরাধীদের নিয়ন্ত্রণ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। ২০২৪ সালে অভ্যুত্থানের পরে পুলিশ ভঙ্গুর অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসছে। অপরাধ নিয়ন্ত্রণে আরও সক্রিয় হয়েছে। মানসিক ট্রমা, মানে ভঙ্গুর অবস্থার মধ্যে যদি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে পড়তে না হতো, তাহলে এই অপরাধগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে পুলিশের কোনো ব্যাপারই ছিল না।

ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. ইবনে মিজান বাংলানিউজকে বলেন, গত তিন মাসে অভিযান চালিয়ে আনুমানিক হাজার থেকে ১২শ’ অপরাধী গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এদের মধ্যে এজাহারভুক্ত ফেরারি আসামি, কিশোর গ্যাংয়ের সদস্য, ছিনতাইকারী, মাদক কারবারি, চোর, এলাকাভিত্তিক সন্ত্রাসীসহ নানান রকমের অপরাধী রয়েছে। মাদক ব্যবসায়ী ও কিছু অপরাধী জামিনে বেরিয়ে পুনরায় অপরাধের কাজে জড়িত হয়ে পড়ে। আবারও অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, অভিযানের পর অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে এবং জনগণের নিরাপত্তার জন্য কাজ করে যাচ্ছে পুলিশ। আপনারা জানেন যৌথবাহিনীও প্রায় সময় অভিযান চালিয়ে অপরাধীদের গ্রেপ্তার করছে। বর্তমানে অনেকটাই এসব এলাকা অপরাধমুক্ত হয়েছে।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর পুলিশ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম  বলেন, জুলাই-আগস্টের আন্দোলনের পর পুলিশ যে ভঙ্গুর অবস্থায় চলে গিয়েছিল, সেখান থেকে বর্তমান অবস্থানে নিয়ে আসাটা একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছিল।  

অপরাধ বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য
মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন এলাকার অপরাধ নিয়ন্ত্রণে পুলিশকে কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, অপরাধীরা বেপরোয়া হওয়ার একমাত্র কারণ, পুলিশের হুংকার আগের মত নেই। এই সুযোগটাই অপরাধীরা নিচ্ছে। আপনারা নিজেরাই দেখতে পারছেন, এক এলাকায় পুলিশ প্রতিদিন অভিযান চালাচ্ছে, প্রতিদিন অপরাধীদের ধরছে। মনে হচ্ছে কোনো দুর্গম এলাকায় বারবার পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে, আর অপরাধীরা পালিয়ে যাচ্ছে। অথচ এটি রাজধানীর একটি নামকরা এলাকা। আগে এক এলাকায় পুলিশ গেলে সে এলাকায় আর অপরাধীদের অস্তিত্ব থাকতো না মাসের পর মাস। এক সময় ছিল যখন মানুষ পুলিশকে দেখলেই ভয় পেত, অপরাধীরা তো দূরেই থাকতো। কিন্তু এখন এমন অবস্থা হয়েছে যে, অনেক সময় পুলিশই অপরাধীদের দেখে সতর্ক অবস্থানে চলে যায়। এই পরিস্থিতি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। পুলিশকে আগের মতো শক্ত অবস্থানে ফিরতে হবে, যাতে অপরাধীরা পুলিশকে দেখেই ভয় পায়। এজন্য পুলিশের কাজ হতে হবে আরও কঠোর এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমানভাবে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে।

ড. তৌহিদুল হক বলেন, পুলিশ সদস্যরা চাকরির শুরুতে ট্রেনিং করে কর্মস্থলে যোগ দিলেও পরে কয়েক বছর পেরিয়ে গেলেও তাদের উল্লেখযোগ্য তেমন ট্রেনিং আর হয় না। কিন্তু এখনকার জটিল অপরাধ পরিস্থিতি মোকাবেলায় তাদের একাধিক আধুনিক ট্রেনিং দিতে হবে। যাতে পুলিশ আরও দক্ষ, আধুনিক ও শক্তিশালী হয়ে অপরাধ দমনে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। অন্যান্য বাহিনী যতই দায়িত্ব পালন করুক না কেন, মূল নিরাপত্তার দায়িত্ব কিন্তু বাংলাদেশ পুলিশের ওপরেই পড়ে। এছাড়া পুলিশকে সেই কর্মচিত্র দেখাতে হবে যেটা দেখে অপরাধীরা একদম অপরাধকর্মে নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়।