
আবারও আলোচনায় গণভোট— ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’। গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থায় জনমত গঠনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো গণভোট। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কোনও বিষয়ের ওপর জনগণের সমর্থন আছে, কী নেই— তা যাচাইয়ের জন্য যে ভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাকে গণভোট বলে। গণভোটে ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ ব্যালটে সিল দেওয়া হয়।
বাংলাদেশে ‘জুলাই সনদ’ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত বা সম্মতি নেওয়ার জন্য একটি গণভোট আয়োজনের বিষয়ে কথা বলছে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। সম্প্রতি কমিশনের সদস্যরা গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন— গণভোট যদি নির্বাচনের দিন অনুষ্ঠিত হয়, ভোটাররা আলাদা ব্যালট পেপারে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ ভোট দিয়ে জানাবেন, তারা সনদটির সমর্থন করেন কিনা। এরপর যে দল পরবর্তী সংসদ গঠন করবে, তারা সনদ বাস্তবায়ন করবে। যদিও সংবিধান বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্বের অনেক দেশেই কোনও সুনির্দিষ্ট বিষয়ে জনগণের মতামত নিতে গণভোট হয়েছে বা নেওয়ার চর্চা আছে। তবে সনদের বিষয়ে গণভোট সম্ভব না। সনদের কতগুলো ধারা, কতগুলো পাতা— পুরোটার সঙ্গে কোনও ব্যক্তি একমত কী একমত না— সেটা ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ দিয়ে কীভাবে যাচাই সম্ভব। কেউ কেউ গণভোট আইন না থাকার বিষয়টিও সামনে আনছেন।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ আমলে ২০১১ সালে সংবিধান থেকে গণভোটের বিধান বাতিল করে দেওয়া হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, জুলাই সনদ বাস্তবায়নের উপায় খুঁজে পেতে গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছিল জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। ৫ অক্টোবর কমিশনের সহ-সভাপতি আলী রীয়াজ জানান, জুলাই সনদ বাস্তবায়নে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা ও তাদের সম্মতির জন্য গণভোটের বিষয়ে সব দল একমত হয়েছে।
কীভাবে হবে এই ভোট জানতে চাইলে সংবিধান বিশেষজ্ঞ শাহদীন মালিক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘কমিশন কমিশন করে এক ডজন কমিশন ও তার ওপর ঐকমত্য কমিশনের কাজ হয়েছে রাজনীতিটাকে বিরাজনীতিকরণ করছে। প্রত্যেক রাজনৈতিক দলের রাজনৈতিক লক্ষ্য থাকে, সেটা নিয়ে তারা জনগণের কাছে যায়। আর এরা এখানে বসে মাসের পর মাস মিটিং করে। এদের এখন কোনও জনসম্পৃক্ততা নেই। ছোট ছোট দলগুলো তাদের সঙ্গে মিটিং করতে করতে ধন্য। আমি মনে করি, বিরাজনীতিকরণের প্রক্রিয়া চলছে। এটা হয়ে গেলে তখন কয়েকটা লোকের সিদ্ধান্ত দিয়ে পুরো দেশ চলবে।’’
গণভোটের প্রক্রিয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘‘গণভোট অনেক ধরনের হয়। জুলাই সনদ যদি পাঁচ পাতার হয় এবং সেটাতে কতগুলো ধারা থাকে। পাঁচ পাতার মধ্যে চার পাতার সঙ্গে আপনি একমত, আরেক পাতার সঙ্গে আপনি একমত নন। সেক্ষেত্রে এটা পড়ে আপনি ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ সিদ্ধান্ত কীভাবে নেবেন।’’
শাহদীন মালিক আরও বলেন, ‘‘এটা যদি এমন হয়, আপনি আলোচনায় বসেছেন— একটা বাঁশের মই দিয়ে কীভাবে চাঁদে যাবেন। সে বিষয়ে আপনি বছরের পর বছর আলাপ করতে পারবেন, কিন্তু চাঁদে যেতে পারবেন কি? ডকুমেন্টের ওপর গণভোট হয় না। চার পাতা পড়ে বুঝার মতো মানুষ কয়জন। কেবল পড়তে জানলেইতো হবে না, পড়ে বিষয়টা বুঝতে হবে। চার পাতা পড়ে পক্ষে- বিপক্ষে ‘হ্যাঁ’ বা ‘না’ বলবে কীভাবে। এরকম গণভোট দুনিয়ার কোথাও নেই। এছাড়া দেশে এখন গণভোটের কোনও আইন নেই। পুরো জিনিসটা আইনগত জায়গা থেকে উজবুগে ধারণা।’’
‘‘ডকুমেন্টের ওপর গণভোট হয় না, কথাটা ঠিক না’’, উল্লেখ করে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘‘সংবিধান প্রণয়নের পর অনুমোদনের ক্ষেত্রে তো গণভোট হতে হয়। একটা দেশের সংবিধান গ্রহণ করতে এটা তাহলে কীভাবে করে?’’ সংবিধানে গণভোটের বিধান বাতিল করা হয়েছিল, তা আবার পুনর্বহাল করা হলেও এখনও কার্যকর করা হয়নি। সেক্ষেত্রে এবার কীভাবে গণভোট হবে, জানতে চাইলে তিনি আরেকটু স্পষ্ট করে বলেন, ‘‘এটা সংবিধান সংশোধনের যে গণভোট, সেটার মতো নয়। জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতার অভিপ্রকাশ হিসেবে এই গণভোট অনুষ্ঠিত হবে। জাতীয় কোনও ইস্যুতে গণভোট করা যাবে না, সংবিধানে এ ধরনের কোনও বিধিনিষেধ নেই। ফলে গণভোট করা যাবে। আমরা বলেছি— জনমতের বহিঃপ্রকাশ হবে এই গণভোটে এবং সেটি সাধারণ নির্বাচনের আগে করা যেতে পারে।’’
উল্লেখ্য, বাংলাদেশে এ পর্যন্ত তিনটি গণভোটের কথা জানা যায়। দুটি প্রশাসনিক গণভোট, আর একটি সাংবিধানিক গণভোট। প্রথম প্রশাসনিক গণভোট হয় ১৯৭৭ সালে। লক্ষ্য ছিল প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসন কার্যের বৈধতা দান। এতে ফলাফল ৯৮.৮০ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল। দ্বিতীয় প্রশাসনিক গণভোট ১৯৮৫ সালে। হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদের সমর্থন যাচাইয়ের লক্ষ্যে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোট। ফলাফল ৯৪.১৪ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল। আর তৃতীয়টি সাংবিধানিক গণভোট অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯১ সালে। সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী আইন প্রস্তাবের বিষয়ে— যার ফলাফল ৮৪.৩৮ শতাংশ ‘হ্যাঁ’ ভোট পড়েছিল।