
লালমনিরহাটে একই আঙিনায় মসজিদ ও মন্দিরে চলছে শারদীয় দুর্গোৎসব এবং মুসলমানদের নামাজ। একপাশে উলুধ্বনি, অন্য পাশে চলছে আল্লাহ তা আলার জিকির। এভাবে ধর্মীয় সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত স্থাপন করে যুগ যুগ ধরে চলছে পৃথক দুটি ধর্মীয় উপাসনালয়। একপাশে ধূপকাঠি, অন্য পাশে আতরের সুঘ্রাণ।
ধর্মীয় সম্প্রীতির এমন উজ্জ্বল নিদর্শন স্থাপন করেছে সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট শহরের কালীবাড়ী এলাকার পুরানবাজার জামে মসজিদ ও কালীবাড়ী কেন্দ্রীয় মন্দির। এই শারদীয় দুর্গোৎসবেও জমকালো আয়োজন বসেছে এই প্রাঙ্গণে।
এই সম্প্রীতির নিদর্শন মন্দির ও মসজিদ দেখতে প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে ছুটে আসছে সাধারণ মানুষ। কয়েকটি দেশের রাষ্ট্রদূতও এই মন্দির ও মসজিদ পরিদর্শনে এসেছিলেন। একই সময়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজন মন্দিরে পূজা-অর্চনা করেন আর মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন মসজিদে নামাজ আদায় করেন। মসজিদে নামাজ আদায়ের সময় মন্দিরে বন্ধ রাখা হয় বাদ্যযন্ত্র বাজানো। ৮১ বছর ধরে একই আঙ্গিনায় মন্দির-মসজিদে পৃথক ধর্মের মানুষ নিজ নিজ ধর্মচর্চা করে আসছেন কিন্তু কখনো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। মুসলিম এবং হিন্দু উভয় সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হয়নি কোনো বিবাদ।
মন্দিরটিতে রয়েছে কালী ও লোকনাথের মূর্তি। প্রতিদিন সকাল-সন্ধ্যায় স্বাভাবিক নিয়মে চলছে পূজা-অর্চনা। এখানে রয়েছে দুর্গা মন্দির। প্রতি বছর জাঁকজমক পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয় শারদীয় দুর্গাপূজা। একই আঙ্গিনার পুরানবাজার জামে মসজিদটি লালমনিরহাট জেলার ঐতিহ্যবাহী একটি মসজিদ। এখানে নামাজ আদায় করতে দূরদূরান্ত থেকেও মুসল্লিরা আসেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে ওই মসজিদে সবসময় মুসল্লিদের ভিড় থাকে।
স্থানীয়রা বলছেন, কালীবাড়ী মন্দিরটি প্রায় ২০০ বছরের পুরোনো। তৎকালীন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীরা ওই মন্দির প্রতিষ্ঠা করে পূজা-অর্চনা করতেন। তারা দেশ ছেড়ে চলে গেলেও মন্দিরটি থেকে যায় অক্ষত। পরবর্তীতে অবকাঠামোগত কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের পর একই আঙিনায় গড়ে ওঠে একটি জামে মসজিদ। নাম দেওয়া হয় পুরানবাজার জামে মসজিদ। পরে, মুসল্লিদের সহযোগিতায় ব্যাপক পরিবর্তন আসে মসজিদের অবকাঠামোতে। এক সময় এলাকাটি হয়ে উঠে নয়নাভিরাম।
পুরানবাজার জামে মসজিদের সভাপতি আমিরুল হায়াত আহমেদ বকুল বলেন, একই আঙিনায় মসজিদ ও মন্দির ধর্মীয় সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত। আর এই সম্প্রীতির চিত্র স্বচক্ষে দেখার জন্য প্রতিদিন দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরা আসেন। অনেক সময় স্থানীয়দের কাছ থেকে দর্শনার্থীরা ঐতিহ্যবাহী ওই মসজিদ ও মন্দির সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চান।
পুরানবাজার জামে মসজিদের পেশ ঈমাম মাওলানা মো. আলাউদ্দিন বলেন, মসজিদে আজান ও নামাজের সময় কোনো দিন কোনো সমস্যায় পড়তে হয় না। এ সময়টাতে মন্দিরে পূজা-অর্চনা হলেও কোনো ধরনের বাদ্যযন্ত্র বাজানো থেকে বিরত থাকেন তারা।
কালীবাড়ী মন্দিরের সভাপতি ও প্রধান পুরোহিত শংকর চক্রবর্তী বলেন, মন্দিরে নিয়মিত পূজা-অর্চনা হয়। আজান ও নামাজের সময় বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার বন্ধ রাখা হয়। ধর্মীয় সম্প্রীতির বিঘ্ন ঘটে এমন অবস্থার মধ্যে আমাকে কোনো দিনই পড়তে হয়নি। বরং স্থানীয় মুসল্লিদের সহযোগিতা পেয়ে আসছি।
পুরান ঢাকা থেকে আসা দর্শনার্থী মিনহাজুর রহমান (৫৫), কমর উদ্দিন (৪৫) এবং কমল চন্দ্র রায় (৪৯) জানান, তারা একই আঙিনায় মসজিদ-মন্দিরের কথা শুনে তা দেখতে ছুটে আসেন। এটি দেখে তারা সকলেই মুগ্ধ হয়েছেন। কয়েক যুগ ধরে একই আঙিনায় দুটি পৃথক ধর্মের পৃথক দুটি উপাসনালয় রয়েছে। কিন্তু কোনো দিনই কোনো ধর্মের মানুষের মাঝে সম্প্রীতির ঘাটতি হয়নি। এটি সত্যি বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল ঘটনা।
কালীবাড়ী মন্দিরের পুরোহিত সুমন কুমার চক্রবর্তী জানান, এই মন্দিরটি ১৮৩৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এলাকার নামকরণও করা হয় কালীবাড়ী। পরে এখানে বাজার গড়ে উঠলে বাজারের ব্যবসায়ী ও শহরের ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা মন্দিরের দেয়াল ঘেঁষে প্রতিষ্ঠা করেন পুরানবাজার জামে মসজিদ। সেই থেকে এক উঠানে চলছে দুই ধর্মের দুই উপাসনালয়ের কার্যক্রম। এখানে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি কখনো।
মসজিদ কমিটির সাধারণ সম্পাদক খোরশেদ আলম দুলাল বলেন, হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনকে মন্দিরে নির্বিঘ্নে ধর্মচর্চা করতে আমরা সবসময়ই সহযোগিতা দিয়ে থাকি। একই আঙ্গিনায় মন্দির-মসজিদ শুধু লালমনিরহাটের জন্য ধর্মীয় সম্প্রীতির উদাহরণ নয়, এটি সমগ্র বাংলাদেশের মানুষের জন্য ধর্মীয় সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।