
ভারতে ১৯৫১ সালের আগের নির্বাচনগুলোতে ভোট দিতে হতো দল ও প্রার্থীকে। মার্কা বা প্রতীককে নয়। যে সময়টায় ব্যালটে প্রার্থীর নাম পড়ে ভোট দিতে হতো তখন স্বাক্ষরতার হার ছিল মাত্র ১৫ শতাংশ। ফলে ভোটাররা ভোট দিতে গিয়ে বিপাকে পড়তেন।
স্বাক্ষরতার হার বিবেচনায় নিয়ে ভারত ১৯৫১ সালের নির্বাচনে প্রতীক চালু করে। বাংলাদেশে বর্তমানে শাপলা প্রতীক পাওয়ার জন্য জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) যেমন জোর দাবি জানাচ্ছে, ভারতেও ১৯৫১ সালে রাজনৈতিক দলগুলোর এমন দশা হয়েছিল।
এনসিপির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর গতকাল মঙ্গলবারের বক্তব্য অনুযায়ী, নির্বাচন কমিশন দলটিকে আলমিরা, উটপাখি, কাপ-পিরিচ ও থালাবাটির মতো প্রতীক দিতে চায়। নাসীরুদ্দীনের মতে, এই প্রতীকগুলো ‘হাস্যকর’। তাই প্রশ্ন উঠছে, শাপলায় এমন কী আছে, যে কারণে প্রতীক হিসেবে পেতে এত আগ্রহ এনসিপির? আর ইসিই বা কেন দিতে চাচ্ছে না?
এসব প্রশ্নের উত্তর জানার আগে দেখা যাক, জীব ও জড় বস্তু কীভাবে প্রতীক হয়ে ওঠে।
জীব, জড় বস্তুর প্রতীক হয়ে ওঠা
কোনো উপাদানের প্রতীক হওয়ার প্রথম শর্ত সেটির সঙ্গে মানুষের সম্পৃক্ততা থাকতে হবে। সত্তরের দশকে প্রকাশ হওয়া একটি বইয়ে এমনটাই বলেছেন আমেরিকান নৃবিজ্ঞানী ক্লিফোর্ড গিয়ার্টজ। ‘দ্য ইন্টারসেপশন অব কালচারস (১৯৭৩)’ নামের বইয়ে গিয়ার্টজ বলেছেন, কোনো আকারের মাধ্যমে (হতে পারে সংখ্যা বা সরু চাঁদ, তারা) যখন মানুষ কোনো বিষয়কে অনুভব করে, চিন্তা করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ে তখনই সেটি প্রতীক হয়ে ওঠে।
যেমন- ধানের শীষ কিংবা নৌকা মানুষের খাদ্য ও যোগাযোগের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলেও বহুল ব্যবহারের কারণে সেগুলো রাজনৈতিক দলের পরিচয় হয়ে উঠেছে। গিয়ার্টজের মতে, প্রতীকবাদ বা সিম্বোলিজম বিষয়টাও এমনই। একটি উপাদান তখনই প্রতীক হয়ে ওঠে যখন সেটি কোনো গোষ্ঠীর সংস্কৃতির অন্তর্নিহিত অর্থগুলো তুলে ধরে বা মানুষ ওই প্রতীকের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত ভাবতে শুরু করে।
এনসিপি কেন শাপলা চায়
ইসিতে নিবন্ধনের আবেদনের শুরু থেকেই এনসিপির নেতারা তাদের প্রতীক হিসেবে শাপলা ফুল বরাদ্দের দাবি জানিয়ে আসছেন। যদিও তা দিতে বরাবরই অস্বীকৃতি জানিয়েছে ইসি।
রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন পেতে গত জুন মাসে ইসিতে আবেদন করে এনসিপি। তখন শাপলার পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে কলম ও মোবাইল ফোনের কথাও উল্লেখ করা হয়েছিল। তবে সেপ্টেম্বরের শেষ দিকে তারা নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে একটি আবেদন করে। যেখানে শাপলা, সাদা শাপলা কিংবা লাল শাপলাকে প্রতীক হিসেবে চাওয়া হয়েছে।
এনসিপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আরিফুল ইসলাম আদিব বলছেন, শাপলা বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে আছে। মানুষ সহজেই শাপলার সঙ্গে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারে। এ বছরের জুলাই পদযাত্রার সময়ও বিভিন্ন এলাকার মানুষ শাপলার পক্ষে ইতিবাচক সাড়া দিয়েছেন।
দলটির কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক কমিটি এবং প্রচার ও প্রকাশনা সেলের সদস্য খালেদ সাইফুল্লাহ জুয়েল। তিনি বলছেন, ইসিতে আবেদনের আগে নেতাকর্মীদের যোগাযোগের প্ল্যাটফর্মে প্রতীক নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। তখন অনেকেই শাপলার কথা বলেন। পরে ইসিতে নিবন্ধনের আবেদনের আগে আনুষ্ঠানিক বৈঠকেও শাপলার প্রতি সবাই সমর্থন দেন।
কলম, মোবাইল ফোনের চেয়ে শাপলায় আগ্রহ বেশি কেন? খালেদ সাইফুল্লাহ বলেন, বিষয়টি বেশ সহজ। শাপলাকে আলাদা করে চেনানোর দরকার নেই। সবার এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা আছে। এমন একটি উপাদানকে প্রতীক হিসেবে পেলে দলের প্রচারও সহজ হবে।
ইসি কেন দিতে চায় না
আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে গত ২৪ সেপ্টেম্বর নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের জন্য ১১৫টি প্রতীক সংরক্ষণ করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে ইসি। তবে এতে এনসিপির চাওয়া শাপলা প্রতীক নেই।
প্রতীক হিসেবে শাপলা যে থাকবে না তা আগেই জানিয়েছিল ইসি। কেন থাকবে না, তা নিয়ে গত জুলাইয়ে একটি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন নির্বাচন কমিশনার আব্দুর রহমানেল মাছউদ। তাঁর ভাষ্য, এটি নীতিগত সিদ্ধান্ত। অতীতেও কোনো কোনো দল শাপলা চেয়েছিল, কিন্তু দেওয়া হয়নি। তা ছাড়া, জাতীয় প্রতীক ও জাতীয় পতাকার সম্মান রক্ষার্থে আইন আছে। তবে জাতীয় ফুল বা ফলের বিষয়ে আইন করা হয়নি। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে শাপলাকে নির্বাচনী প্রতীক হিসেবে তপশিলভুক্ত না করার নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে।
প্রতীক নিয়ে ইসির প্রজ্ঞাপন জারির পর শাপলা নিয়ে মতামত দেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি)। গত ২৫ সেপ্টেম্বর এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেন, শাপলা প্রতীক প্রথমে নাগরিক ঐক্য চেয়েছিল, তাদের দেওয়া হয়নি। পরে এনসিপি চেয়েছে, তাদেরও দেওয়া হয়নি। শাপলা প্রতীক কেন দেওয়া হবে না, সে ব্যাখ্যা দেবে না কমিশন। এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে যে টানাপোড়ন চলছে, তা ইসির এখতিয়ার নয়।
এনসিপি কী করবে
গতকাল মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, এনসিপি প্রতীক প্রশ্নে জনগণকে সঙ্গে নিয়ে সাংবিধানিক ও গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সক্ষমতা অনুযায়ী সংগ্রাম জারি রাখবে।
‘ইসিকে আমরা আগেই বলেছি, শাপলা পেতে এনসিপির আইনি কোনো বাধা নেই। ইসিরও অন্য কোনো চাপ অনুভব করা উচিত না।’ বলেন নাসীরুদ্দীন। তিনি অভিযোগ করেন, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মার্কা (প্রতীক) জাতীয় প্রতীকের বিভিন্ন উপাদান থেকে নেওয়া হলেও, কমিশন কেবল এনসিপির চাওয়ার বিষয়ে আপত্তি তুলেছে।
নৌকা, ধানের শীষ যেভাবে প্রতীক হয়
আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মতো দলের প্রতীক কীভাবে নির্ধারিত হয়েছিল তা জানা যায় ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুনের একটি সাক্ষাৎকার থেকে। ২০১৮ সালে একটি গণমাধ্যমে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের যাঁরা ছিলেন, যেমন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন, মাওলানা ভাসানী— তাঁরা সবাই গ্রাম থেকে উঠে আসা। আর গ্রামীণ জীবনের অংশ হলো নৌকা। এসব কারণে হয়তো তাঁরা নৌকাকে বেছে নিয়েছেন।’
আর ধানের শীষের প্রসঙ্গে মুনতাসীর মামুন বলেন, ‘জিয়াউর রহমান যখন বিএনপি করলেন, তখন তাঁর মনে হয়েছে নৌকার মতো তাঁকেও একটি সর্বজনীন প্রতীক বেছে নিতে হবে। সেজন্য নৌকার মতো ধানের ছড়াকে বেছে নিলেন। তবে ধান না করে ধানের শীষ নিলেন। ধানের শীষের মধ্যে একটি পোয়েটিক (কাব্যিক) ভাব থাকে।’
উপমহাদেশে প্রতীক চালু
উপমহাদেশের নির্বাচনে প্রথম প্রতীক চালু হওয়ার তথ্য পাওয়া যায় ভারতে। ভয়েস অব আমেরিকায় প্রকাশ হওয়া একটি নিবন্ধ অনুযায়ী, ভারতে প্রথম প্রতীকসহ সাধারণ নির্বাচন হয় ১৯৫১ সালে। তাই সেবার রাজনৈতিক দলগুলো প্রতীক নিয়ে প্রতিযোগিতা শুরু করে। তারা বুঝতে পারে, নির্বাচনে জেতার আসল চাবিকাঠি হলো এমন প্রতীক, যা মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে দেখে। ভারতে তখন ৯০ শতাংশ এলাকা গ্রাম আর ৯৯ শতাংশ মানুষের পেশা ছিল চাষাবাদ। তাই প্রতীক বণ্টনের বৈঠকে কংগ্রেস, সোশ্যালিস্ট, কমিউনিস্ট, কৃষক ও শ্রমিক পার্টি লাঙল প্রতীক দাবি করে।
বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনের মতো ভারতের তৎকালীন প্রধান নির্বাচন কমিশনার সুকুমার সেনও একটি সমাধান বের করেছিলেন। সেটি হলো- লাঙল প্রতীক কেউকে না দেওয়া। ভারতে বর্তমানে কোনো দলের প্রতীক লাঙল কি না তা জানা যায়নি। দেশটির নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটটি বুধবার রাত ৮টায় নিষ্ক্রিয় দেখা গেছে।