
খুলনার সাবেক ডিসি মোহাম্মদ হেলাল হোসেন সর্বশেষ ছিলেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব পদে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ওএসডি করা রাতের ভোটের ৩৩ জেলার ডিসিদের মধ্যে তিনিও রয়েছেন। বর্তমানে ওএসডি অবস্থায়ই আছেন। আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিটের অনুসন্ধানে ইতিমধ্যে তার নিজের এবং স্ত্রী আমেনা আখতারের অঢেল সম্পদের তথ্য বেরিয়ে এসেছে। যেসব তথ্য তাদের আয়কর ফাইলে নেই। এবং সম্পদের উৎস্যও বৈধ নয়। অবৈধভাবে আয়ের এসব সম্পদের তথ্য গোপন ও কর ফাঁকির দায়ে মোহাম্মদ হেলাল হোসেন ও স্ত্রী আমেনা আখতারের সকল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করেছে আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট। এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যমতে, হেলাল হোসেন এবং আমেনা আখতারের কর ফাঁকির পরিমাণ প্রায় ১০ কোটি ৩৯ লাখ টাকা।
স্ত্রী আমেনা আখতার ধানমন্ডি, শুক্রাবাদস্থ নিউ মডেল ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগের একজন সহকারী অধ্যাপক। বেসরকারি এমপিওভুক্ত কলেজ এটি। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, আমেনা আখতারের সম্পদের পরিমাণ স্বামীর সম্পদের প্রায় ৮ গুণ। ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত হেলাল হোসেন কর ফাঁকি দিয়েছেন প্রায় ১ কোটি ২৪ লাখ টাকা, অন্যদিকে আমেনা আখতার কর ফাঁকি দিয়েছেন ৯ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
মোহাম্মদ হেলাল হোসেন খুলনার জেলা প্রশাসক থাকাকালে সরকারি চাকরিবিধি লঙ্ঘন করে তাজমীন ফ্যাশন নামে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে ২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ৩৮ লাখ, ২৭ হাজার টাকা জমা করেন। এরপরে প্রতিবছরই কোটি কোটি টাকা জমা হয় এই অ্যাকাউন্টে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে শেয়ারবাজার থেকে ৫ কোটি ১০ লাখ, ৪১ হাজার, ৭শ’ ৪৩ টাকার (ক্রয়মূল্য অনুযায়ী) শেয়ার ক্রয় করেন। এসব শেয়ারের বিপরীতে তিনি ২৮ লাখ টাকা মুনাফাও পেয়েছেন। শেয়ারের বিপরীতে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন ২ কোটি ৬১ লাখ টাকা। এসব ঘটনার কোনোটিই তিনি নিজের আয়কর নথিতে উল্লেখ করেননি।
আমেনা আখতার এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষক হিসেবে চাকরিতে থেকেই তিনটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক হয়েছেন। যদিও চাকরিবিধি অনুযায়ী এটা আচরণবিধির লঙ্ঘন। যেহেতু তিনি এমপিওভুক্ত শিক্ষক হিসেবে বেতনের সিংহভাগ অর্থ পান সরকারের তহবিল থেকে তাই সরকারি কর্মচারী আচরণবিধি মানতে বাধ্য। কিন্তু আচরণবিধির কোনো তোয়াক্কা না করেই আখতার এন্টারপ্রাইজ, তাহমিদ গার্মেন্টস এবং এইচ এ ফ্যাশন নামে তিনটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। আমেনা আখতারের এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসেবে প্রতি বছরই কোটি কোটি টাকা জমা হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, আমেনা আখতার ২০২৩-২৪ অথবছরে ২৩ কোটি ৪৪ লাখ ১৮ হাজার ৭শ’ ৬০ টাকার (ক্রয়মূল্য অনুযায়ী) শেয়ার ক্রয় করেছেন। এসব শেয়ারের লভ্যাংশ পেয়েছেন ১ কোটি ১৫ লাখ টাকার। কিন্তু এসবের কোনোটিই তিনি কর নথিতে দেখান-নি। তবে কর নথিতে তিনি ৭৭ লাখ ৯৬ হাজার টাকার বিনিয়োগ দেখিয়েছেন। এ বিনিয়োগের অর্থ কোথা থেকে এসেছে- এ সংক্রান্ত যথাযথ তথ্য বা প্রমাণপত্র নেই আয়কর নথিতে।
রিয়েল এস্টেট প্রতিষ্ঠান আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনের কাছ থেকে ২২৩০ বর্গফুটের একটি ফ্ল্যাট ক্রয় করেছেন ধানমন্ডিতে। বাড়ি নং ৪১/এ, রোড ৪/এ, ধানমন্ডি। ফ্ল্যাটটির প্রকৃত মূল্য ৪ কোটি ১২ লাখ ৫৫ হাজার টাকা। কিন্তু তিনি আয়কর নথিতে এর মূল্য দেখিয়েছেন ৩৬ লাখ ৯০ হাজার টাকা এবং ১০ লাখ টাকা ব্যক্তিগত বিশেষ ডিসকাউন্ট পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেছেন। যদিও ফ্ল্যাটটির মূল্য পরিশোধ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্রে উল্লেখ রয়েছে, ২০১৮ সাল থেকে ১৩ আগস্ট, ২০২৪ পর্যন্ত ৩ কোটি ৬৩ লাখ ৩৭ হাজার ৪শ’ ৭৬ টাকা আমিন মোহাম্মদ ফাউন্ডেশনকে পরিশোধ করা হয়েছে। ৫ আগস্টের পর ফ্ল্যাটটি আত্মীয় এক চিকিৎসককে দান করেছেন, বলছেন। কিন্তু আয়কর গোয়েন্দা ইউনিট খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছে, দান করেননি। ফ্ল্যাটটি বিক্রি করেছেন ওই চিকিৎসকের
আলোচিত মোহাম্মদ হেলাল হোসেন খুলনায় জেলা প্রশাসক পদে ছিলেন ১৩ আগস্ট ২০১৮ থেকে ২০২১ সালের ২৭ জুন পর্যন্ত। অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর, ২০১৮ অনুষ্ঠিত রাতের ভোটের নির্বাচনটি তাঁর অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবং তিনিই একমাত্র ডিসি যার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে মোট ভোটারের চেয়ে কাস্ট হয়েছিল বেশি। অর্থাৎ ভোটারের চেয়ে কাস্ট ভোট দেখানো হয়েছিল বেশি। এ নিয়ে তখন অনেক হইচইও হয়েছিল। খুলনা-১ (দাকোপ-বটিয়াঘাটা) আসনে মোট ভোটারের চেয়ে ২২ হাজারের বেশি ভোট পড়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হলে নিজের অপরাধ ঢাকতে উল্টো দুই সাংবাদিকের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা দায়ের করেন ডিসি হেলাল হোসেন। একজন সাংবাদিককে গ্রেপ্তারও করা হয়। পরে তারা উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেন।
এসব অনিয়ম-অপকর্মের পুরষ্কারস্বরূপ মোহাম্মদ হেলাল হোসেন পরবর্তীতে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি পান। ডিসি পদায়নের আগে তিনি তৎকালীন খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলামের একান্ত সচিব (পিএস) পদে ছিলেন। মূলতঃ খাদ্যমন্ত্রীর পিএস এবং খুলনার ডিসি পদে থেকেই ঘুষ-দুর্নীতির মাধ্যমে কোটি কোটি টাকা অবৈধভাবে আয় করেন। খুলনার ডিসি পদে থাকাকালে লাগামহীন অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে ব্যাপকভাবে আলোচিত হলেও অবাক ব্যপার হলো, ওই সময়ের কর্মকাণ্ডের জন্যই তাকে দুই বার জনপ্রশাসন পদক দেয়া হয় সরকারের পক্ষ থেকে।
শীর্ষনিউজ