Image description
 

মাদারীপুরের কালকিনিতে তিন খুনের মামলায় জামিনে বের হয়ে এক গৃহবধূকে আটকে মারধরের ঘটনায় আলোচনায় এসেছেন ফয়সাল তালুকদার (৩৮)। তিনি উপজেলার কালাই সরদারেরচর এলাকার বজলু তালুকদারের ছেলে। স্থানীয় লোকজন তাঁকে ‘বোমারু ফয়সাল’ নামেই চেনেন।

স্থানীয় লোকজনের ভাষ্য, কালকিনিতে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, হত্যা, বিস্ফোরণ, ধর্ষণের ঘটনাসহ যত ধরনের অপরাধ ঘটে, তার একটি বড় অংশের সঙ্গে যুক্ত ‘বোমারু ফয়সাল বাহিনী’। এই বাহিনীর আতঙ্কে উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়নের এক ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) সদস্যসহ শতাধিক পরিবার বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে।

মানব পাচার দিয়ে অপরাধে হাতেখড়ি

‘বোমারু ফয়সাল বাহিনী’র মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত অন্তত ১০টি পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছে প্রথম আলো। তাদের ভাষ্য, শিকারমঙ্গল ইউনিয়নের মৃধাকান্দি এলাকার হাচেন হাওলাদারের ছেলে লিবিয়াপ্রবাসী মিরাজ হাওলাদার। তিনি লিবিয়াতে মানব পাচারকারী দুর্বৃত্ত চক্রের অন্যতম সদস্য। মিরাজের সঙ্গে সখ্য গড়ে ওঠে ফয়সালের। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ফয়সালকে দিয়ে মানব পাচার থেকে শুরু করে লিবিয়াতে বন্দী স্থানীয় তরুণ-যুবকদের পরিবারের কাছ থেকে মুক্তিপণ আদায়ের কাজ করাতেন মিরাজ।

ফয়সাল এতটাই বেপরোয়া যে নিজ এলাকা থেকে সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে আমার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামেও হামলা করে। অসহায় নারীদের টার্গেট করে ধর্ষণসহ অসামাজিক কাজ করে।
মোস্তাফিজুর রহমান, ইউপি চেয়ারম্যান, বাঁশগাড়ী

একপর্যায়ে ফয়সাল পূর্ব এনায়েতনগর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। এলাকায় আধিপত্য দেখাতে শুরু করেন। তৈরি করেন সন্ত্রাসী বাহিনী। দীর্ঘ এক দশক ধরে তাঁর প্রভাবে জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ—সবাই অতিষ্ঠ। মারামারি ও বোমা হামলায় বেশ আলোচিত হওয়ায় তাঁদের প্রভাব পাশের বাঁশগাড়ী, শিকারমঙ্গল, চরদৌলতখান ও সাহেবরামপুর ইউনিয়নে ছড়িয়ে পড়ে। বর্তমানে পাঁচটি ইউনিয়নের অনেক বাড়িঘরে লুট, ভাঙচুর ও হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে এই বাহিনী।

কীভাবে ‘বোমারু ফয়সাল’ হলেন

ফয়সাল হাতবোমা, ককটেলসহ বেশ কয়েক ধরনের বোমা তৈরি করতে পারদর্শী। এই বোমা তৈরির জন্য কালাই সরদারেরচর, খুনেরচর, আন্ডারচর, মৃধাকান্দি গ্রামে তাঁর একাধিক গোপন আস্তানা আছে বলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক বাসিন্দার ভাষ্য। এসব আস্তানায় তৈরি বোমা তিনি বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করেন।

আমার ছেলে ও নাতিকে মেরে ফেলেছে। বাড়িঘর ভেঙে ফেলেছে। মামলার পর থেকে এলাকায় থাকতে পারি নাই। ছেলের কবরটা পর্যন্ত জিয়ারত করতে পারি না।
মতিউর রহমান, ভুক্তভোগী

গত বছরের ২৭ ডিসেম্বর কালকিনি উপজেলার বাঁশগাড়ীতে ইউপি সদস্য আতাউর রহমান, তাঁর ছেলেসহ তিনজনকে হাতবোমা মেরে হত্যার ঘটনায় ১৮ নম্বর এজাহারভুক্ত আসামি ছিলেন ফয়সাল তালুকদার। আলোচিত ওই তিন খুন ছাড়াও ফয়সালের বিরুদ্ধে আরও চারটি খুনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ আছে।

 
 

কালকিনি থানা, জেলা পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, ২০০৬ সাল থেকে অপরাধ জগতে জড়ান ফয়সাল তালুকদার। তাঁর বিরুদ্ধে ২০০৬ সালে কালকিনি থানায় প্রথমে একটি চুরির মামলা হয়। এরপর তাঁর বিরুদ্ধে ডাকাতি, ছিনতাই, লুটপাট, হামলা, বিস্ফোরণ, হত্যা, ধর্ষণ, চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে কালকিনি থানায় ১৫টি মামলা হয়। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তাঁর বিরুদ্ধে ৭টি মামলা হয়। বেশির ভাগ মামলাই বিস্ফোরণ, হামলা ও লুটপাটের ঘটনায়। সবশেষ তিন খুনের মামলায় গ্রেপ্তার হন ফয়সাল। পরে প্রায় সাত মাস কারাগারে ছিলেন তিনি। দেড় মাস ধরে জামিনে বের হয়ে আবারও অপরাধে জড়ান তিনি।

২২ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় বিধবা এক গৃহবধূর বসতঘরে ঢুকে ফয়সাল তাঁকে মারধর করে রামদা দিয়ে আঘাত করেন।

সন্ত্রাসীদের বসবাসের গ্রামগুলো দুর্গম এলাকায়। এর আগে ওই এলাকায় একাধিক গাড়িতে ২০ জন পুলিশ নিয়েও ঢুকতে পারিনি। ওই এলাকায় ঢোকার এক কিলোমিটার আগে থেকেই পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়।
সোহেল রানা, ওসি, কালকিনি থানা

কালকিনি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কে এম সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, ফয়সালের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা হলেও তাঁর বিরুদ্ধে কোনো গ্রেপ্তারি পরোয়ানা নেই। ওই এলাকায় তিনি বোমারু ফয়সাল নামেই পরিচিত। ফয়সাল মূলত বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তির লোক। খুনেরচর, কালাই সরদারেরচর, মৃধাকান্দি, আন্ডারচর, মধ্যেরচরসহ কয়েকটি এলাকায় তাঁদের বেশি আধিপত্য।

জনপ্রতিনিধিসহ এলাকাছাড়া অনেকে

ফয়সাল বাহিনীর হুমকির ভয়ে এক মাস ঘরবন্দী ছিলেন পূর্ব এনায়েতনগর ইউনিয়ন পরিষদের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য আপান কাজী। পরে তিনি বাধ্য হয়ে গ্রাম ছাড়েন। এক বছর ধরে পরিবার নিয়ে ঢাকায় থাকছেন তিনি। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘কালাই সরদারেরচর আমার গ্রাম। এই গ্রামের আমি জনপ্রতিনিধি। অথচ ফয়সাল বাহিনীর জন্য আমি এক বছর ধরে এলাকাছাড়া। শুধু আমি না, আমার কাজী বংশের একটি পরিবারও এখন আর নেই। সবাইকে গ্রামছাড়া করেছে ওরা। শিকদার, তালুকদার, খান, চৌকিদার, কাজী বংশের শত শত লোক এলাকায় থাকতে পারছেন না। বাড়িঘরে গেলেই হামলার শিকার হতে হবে। বাড়িঘর এখন আস্ত নেই। সবকিছুই ওরা খুলে নিয়ে গেছে।’

আমার ভাই ভালো, সেটা বলা যাবে না। তবে খারাপ হওয়ারও অনেক কারণ আছে। আমাদের এলাকায় এমন কোনো ঘরের লোক নাই, যার নামে মামলা নাই। গ্রাম্য দলাদলির কারণে আমরা সবাই বাধ্য হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছি।
লিটন তালুকদার, ফয়সালের চাচাতো ভাই

আপান কাজীর ভাষ্য, ফয়সাল বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে কয়েক হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ১০০টির বেশি পরিবার বাড়িঘর ছেড়ে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে গেছে। তিনি আইনি সহযোগিতা চেয়েও পাননি। পুলিশও ফয়সাল বাহিনীকে ধরতে ভয় পায় বলে অভিযোগ তাঁর।

পূর্ব এনায়েতনগরের ইউপি চেয়ারম্যান মো. নেয়ামুল আকন বলেন, ‘বোমারু ফয়সালের নিজের একাধিক বোমা তৈরির আস্তানা আছে। মাদকের ব্যবসা আছে। চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, লুটপাট, খুনসহ একাধিক সংঘাত সৃষ্টি করে আমাদের ইউনিয়নটা ধ্বংস করে দিছে। বিষয়টি নিয়ে পুলিশকে বারবার বলা হলেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছে না।’

এ অভিযোগের বিষয়ে কালকিনি থানার ওসি সোহেল রানা বলেন, ‘সন্ত্রাসীদের বসবাসের গ্রামগুলো দুর্গম এলাকায়। এর আগে ওই এলাকায় একাধিক গাড়িতে ২০ জন পুলিশ নিয়েও ঢুকতে পারিনি। ওই এলাকায় ঢোকার এক কিলোমিটার আগে থেকেই পুলিশকে লক্ষ্য করে বোমা নিক্ষেপ শুরু হয়ে যায়। তিন খুনের ঘটনার পর ফয়সালকে ধরতে অনেক বেগ পেতে হয়েছে। পুলিশ ফয়সালসহ তাঁর বাহিনীর লোকজনকে ধরতে গেলে বা ওই এলাকায় অভিযান চালাতে গেলে তাঁরা সীমানাবর্তী বরিশাল ও শরীয়তপুরে পালিয়ে যান।’

  

নিহত ছেলে ও নাতির কবরেও যেতে পারেন না বাদী

ছেলে আতাউর রহমান, নাতি মারুফ শিকদারসহ তিনজনকে হারিয়েছেন মতিউর রহমান। বিচার দাবি করে থানায় মামলা করে তিনিও এখন এলাকাছাড়া। এ বিষয়ে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বোমা হামলা করে ওরা (ফয়সাল বাহিনী) আমার ছেলে ও নাতিকে মেরে ফেলেছে। বাড়িঘর ভেঙে ফেলেছে। এখন আমাকে মারার হুমকি দিচ্ছে। মামলা করেছি বিচারের আশায়। এখন ওরা প্রকাশ্যে এসে হুমকি দিচ্ছে। মামলার পর থেকে এলাকায় থাকতে পারি নাই। ছেলের কবরটা পর্যন্ত জিয়ারত করতে পারি না। মামলা তুলে নিতে চাপ দিচ্ছে।’

ফয়সাল বাহিনীর জন্য আমি এক বছর ধরে এলাকাছাড়া। শুধু আমি না, আমার কাজী বংশের একটি পরিবারও এখন আর নেই। শিকদার, তালুকদার, খান, চৌকিদার, কাজী বংশের শত শত লোক এলাকায় থাকতে পারছেন না।
 

এ সম্পর্কে বাঁশগাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘ফয়সাল এতটাই বেপরোয়া যে নিজ এলাকা থেকে সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে আমার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামেও হামলা করে। অসহায় নারীদের টার্গেট করে ধর্ষণসহ অসামাজিক কাজ করে। সম্প্রতি ফয়সাল আমার ইউপির এক নারীর ঘরে ঢুকে তাঁকে বেধড়ক মারধর করে।’

অভিযোগের বিষয়ে জানতে ফয়সাল তালুকদারের মুঠোফোনে কল করলে সেটি বন্ধ পাওয়া যায়। তবে তাঁর চাচাতো ভাই লিটন তালুকদার বলেন, ‘আমার ভাই ভালো, সেটা বলা যাবে না। তবে খারাপ হওয়ারও অনেক কারণ আছে। আমাদের এলাকায় এমন কোনো ঘরের লোক নাই, যার নামে মামলা নাই। গ্রাম্য দলাদলির কারণে আমরা সবাই বাধ্য হয়ে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছি।’

সার্বিক বিষয়ে মাদারীপুরের পুলিশ সুপার মোহাম্মদ নাঈমুল হাছান প্রথম আলোকে বলেন, ফয়সাল ও তাঁর বাহিনীর লোকজনকে ধরতে পুলিশের অভিযান অব্যাহত আছে। খুব শিগগির ফয়সালকে আইনের আওতায় আনা হবে।