Image description
‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর একীভূতকরণের’ নতুন পরিকল্পনা গভর্নরের মার্জারের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগবে ৩-৪ বছর, আগামীর রাজনৈতিক সরকারকে বিপাকে ফেলতেই এই ইস্যু সামনে আনা হয়েছে -বিশ্লেষকদের অভিমত

ব্যাংক খাতকে ‘অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড’ বা চালিকাশক্তি বলা হয়ে থাকে। এই খাতের ভালো কিংবা মন্দ অবস্থা দুটোরই প্রভাব দেশের অর্থনীতির ওপর পড়ে বলে উদ্বেগও থাকে। স্বৈরাচার হাসিনা সরকার ব্যাংক খাতকে সাইফুল আলম (এস আলম), সাইফুজ্জামান চৌধুরী, চৌধুরী নাফিস সরাফাত, নজরুল ইসলাম মজুমদার, সিকদার পরিবারসহ কয়েকজন মাফিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। যার ফলস্বরূপ দেশের আর্থিক খাত অর্থপাচার, অনিয়ম-দুর্নীতির আতুরঘরে পরিণত হয়। এইচএসসি পাস করা আকিজ উদ্দিনকেও দেশের শীর্ষস্থানীয় ইসলামী ব্যাংকের ডিএমডি করা হয়। এভাবে ব্যাংকিং খাতকে ধ্বংসের শেষ কিনারায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে। স্বৈরাচার হাসিনা ভারতে পলায়নের আগে আর্থিক খাতের উদ্বেগকে আরো ঘনীভূত করেছে ব্যাংকের একীভূতকরণ (মার্জার) ঘোষণা দিয়ে। ওই সময়ে সরকারি-বেসরকারি মিলিয়ে প্রায় এক ডজন ব্যাংককে মার্জারের ঘোষণা দেয়া হয়। তবে শুধু এক্সিম ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংক-বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) চুক্তি সম্পন্ন হয়। এসব ব্যাংকের পাশাপাশি তালিকায় থাকা অন্য ব্যাংকগুলোও বিপাকে পড়ে। বিশেষ করে দুর্বল ব্যাংকগুলো থেকে গ্রাহকরা আমানত তুলে নেয়ায় দেউলিয়ার পথে চলে যায় ব্যাংকগুলো। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর মার্জার বিলুপ্ত হয়ে যায়।

বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার সম্প্রতি রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্স অ্যাক্ট-২০২৫ প্রণয়ন করেছে। এর মাধ্যমে যেকোনো ব্যাংক টেকওভার করতে পারবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ব্যাংক অবসায়ন, মার্জারসহ যেকোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার একক ক্ষমতা নিয়ে আসা হয়েছে। এই ধারাবাহিকতায় গত মে মাসে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যাংক রেজল্যুশন অর্ডিন্যান্স-২০২৫-এর গেজেট প্রকাশ করে। ইতোমধ্যেই ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, গ্লোবাল ইসলামী ব্যাংক, ইউনিয়ন ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক এবং এক্সিম ব্যাংককে একীভূত করার পদক্ষেপ নিয়েছে। যদিও এক্সিম ব্যাংকে মার্জারে রাখা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ব্যাংক খাতে। ৫ ব্যাংক মার্জারের সিদ্ধান্তে ইতোমধ্যে ব্যাংক খাতে একটি ধস নেমেছে। ওই সব ব্যাংক থেকে গ্রাহকরা টাকা তুলে নিচ্ছেন। অবস্থা এমন হয়েছে যে, নতুন করে ওই সব ব্যাংক থেকে এককালীন পাঁচ হাজার টাকা পর্যন্ত দিতেও কষ্ট হচ্ছে। একাধিক ব্যাংকের কর্মকর্তারা বেতন নেন পাঁচ থেকে ১০ হাজার করে ভেঙে ভেঙে। এদিকে ব্যাংক খাতের একাধিক ক্ষত সামাল দিয়ে যখন ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছিল তখনই আবারো মার্জার ইস্যু সামনে এনে এসব ব্যাংককে খাদের কিনারে নিয়ে আসা হয়েছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন সম্প্রতি বলেছেন, ব্যাংক একীভূতকরণের প্রক্রিয়াটি জটিল। বাংলাদেশ ব্যাংক যদিও ২ বছরের কথা বলছে, তবে ৩ থেকে ৪ বছর লেগে যাবে। যদিও দেশে এর আগে একীভূতকরণের ভালো কোনো উদাহরণ নেই।

অবশ্য বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মতো সরকারি ব্যাংকগুলোও যখন আওয়ামী লুটপাট থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর ইঙ্গিত দিচ্ছিল তখনই আবার নতুন ঘোষণা গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরের ‘রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির একীভূতকরণের’। সম্প্রতি তিনি জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ সরকারের সময় ব্যাংকিং খাতে সংস্কার ত্বরান্বিত করার জন্য তারা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলির একীভূতকরণের সুপারিশ করেছিলেন, যা গণঅভ্যুত্থানের পর ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বন্ধ হয়ে যায়। কিছু ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা ভালো নয়, তাই একটি দুর্বল সরকারি ব্যাংকের সোনালী ব্যাংকের সাথে একীভূতকরণ সম্ভব। যদিও তিনি দুর্বল ব্যাংকগুলোর নাম উল্লেখ করেননি। গত বৃহস্পতিবার তার কার্যালয়ে এক সাক্ষাৎকারে গণমাধ্যমকে গভর্নর এ কথা বলেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর এই পরিকল্পনাটি যখন প্রকাশ করলেন যখন পাঁচ ব্যাংকের মার্জার ইস্যু নিয়ে বিপাকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এদিকে মার্জারের পুরো প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে সময় লাগবে ৩-৪ বছর। প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ইতোমধ্যে জানিয়েছেন আগামী ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি নির্বাচন। তাই ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত থাকছে এই সরকারের মেয়াদ। তাহলে এই মার্জার ইস্যুকে সামনে এনে ব্যাংকগুলোকে খাদের কিনারে নিয়ে আগামী রাজনৈতিক সরকারের ওপর দায় চাপানো বা অর্থনীতিকে দুর্বল করে যাওয়ার একটি চেষ্টা মাত্র বলছেন সংশ্লিষ্টরা, যা ব্যাংকগুলোকে আবারো দুর্বল করবে। আবার অনেকে বলছেন, ব্যাংক খাতের লুটপাটকারীদের আড়াল করতেই মার্জার ইস্যুকে সামনে এনে গভর্নর কোনোভাবে নির্বাচন পর্যন্ত পার করতে চাইছেন। না হলে অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ের জন্য দায়িত্ব পাওয়া গভর্নর কেন ৩-৪ বছর সময়ের একটি ইস্যুকে সামনে আনলেন। যা এর আগে স্বৈরাচার হাসিনা সরকারও সামনে এনে ব্যাংকগুলোকে দেউলিয়ার পথে ঠেলে দিয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চাপিয়ে দেয়া মার্জারে আর্থিক খাত বা ব্যাংক খাত স্বাভাবিক হবে না। এ জন্য সরকারের নানামুখী সেবা যেমন- বিদ্যুৎ-গ্যাস বিল, ভূমি রেজিস্ট্রেশনের বিল, পাসপোর্ট-সংক্রান্ত সেবার কাজ এবং যে সব সরকারি প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের টাকা গচ্ছিত আছে, তা এসব দুর্বল ব্যাংককে সহায়তায় ব্যবহার করে নির্দিষ্ট ব্যাংককে বাঁচানো সম্ভব। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আর্থিক দাতা প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন-আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এডিবি ও আইডিবি থেকে অর্থায়ন বা ঋণের টাকা নেয়া। এই তহবিলের মাধ্যমে দুর্বল ব্যাংকের পুনর্গঠন বা নিষ্পত্তি কার্যক্রম পরিচালিত করা সম্ভব বলে মনে করছেন তারা।

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, হাসিনার পতনের পর ব্যাংকগুলো ঘুরে দাঁড়াচ্ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে প্রথমে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে নিয়ে মার্জার এবং নতুন করে সরকারি ব্যাংকগুলোকে নিয়ে মার্জারের পরিকল্পনা এমন ঘোষণার ফলে সাধারণ গ্রাহকের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিয়েছে। গ্রাহকরা এখন নিজেদের সঞ্চয় নিয়ে উদ্বেগে রয়েছেন এবং যা ব্যাংকগুলো থেকে নগদ উত্তোলনের চাপ তৈরি করছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৫ সালের মার্চ মাসের শেষ নাগাদ খেলাপি ঋণের পরিমাণ তীব্রভাবে বেড়ে প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকায় পৌঁছেছে, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ছিল ৩ দশমিক ৪৫ লাখ কোটি টাকা। ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৮টি ব্যাংক থেকে ২০২৫ সালে ৬২টি তফসিলি ব্যাংকে উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ছয়টি রাষ্ট্রায়ত্ত বাণিজ্যিক ব্যাংক- অগ্রণী ব্যাংক, বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক, বেসিক ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক এবং সোনালী ব্যাংক-এর খেলাপি ঋণ ১ দশমিক ৪৬ লাখ কোটি টাকায় পেঁৗঁছেছে, যা মোট খেলাপি ঋণের ৩৬ দশমিক ৫ শতাংশ। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর যখন এই অবস্থা তখন নতুন করে এসব ব্যাংকের মার্জারের খবরে ব্যাংকপাড়ায় অস্থিরতা বিরাজ করছে। গ্রাহকরা কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যেও হাসিনার সময়ের মতো আতঙ্ক বিরাজ করছে তাদের চাকরির কী হবে এ নিয়ে। অনেক গ্রাহক গত রোববার এবং গতকাল সোমবার দুই দিনে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকে (বিডিবিএল) টাকা তুলতে ভিড় করেছেন।

সূত্রমতে, ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর অনিয়ম-দুর্নীতির হোতা বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদারকে সরিয়ে গভর্নরের দায়িত্ব দেয়া হয় ড. আহসান এইচ মনসুরকে। তিনি দায়িত্ব নিয়ে শুরুতেই বলেন, ‘দেশের ১০ ব্যাংক দেউলিয়ার পথে’। এরপর থেকে প্রায় এক ডজন ব্যাংক বিপাকে পড়ে। পরে বাংলাদেশ ব্যাংক ও সবল ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা ধার দেয়া হয়। কিন্তু এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি ব্যাংকগুলো। এরপর আবার আনা হয় মার্জার ইস্যু। যে কারণে ব্যাংকগুলো আরো বিপাকে পড়েছে। অনেক ব্যাংক এখনো মার্জারে আসতে চাইছে না।

এক্সিম ব্যাংকের চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম স্বপন বলেন, এক্সিম ব্যাংক সব সময়ই ইসলামী ব্যাংকের কাছাকাছি ছিল। গত কয়েক বছরে কিছুটা খারাপ হয়েছে সাবেক চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদারের কারণে। তবে ছাত্র-জনতার বিপ্লবের পর কিছুটা আতঙ্কে গ্রাহকরা ডিপোজিট তুলে নিচ্ছিল। তবে আমরা বোঝাতে সক্ষম হওয়ায় এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতায় এখন স্বাভাবিক ধারায় এসেছে ব্যাংকটি। আমরা এখন ভালো আছি। নিজেরাই ঘুরে দাঁড়াতে পারছি। তাই এক্সিম ব্যাংককে কেন এস আলমের সঙ্গে মার্জারে যুক্ত করা হবে প্রশ্ন রাখেন নজরুল ইসলাম স্বপন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের (বিআইবিএম) সাবেক মহাপরিচালক তৌফিক আহমদ চৌধুরী বলেছেন, মার্জার খারাপ নয়; তবে এটা হবে ভলান্টারি। ব্যাংক ইচ্ছে করলে যাবে। চাপিয়ে বা জোর করে দেয়া নয়। আওয়ামী সরকার জোর করে দিতে চেয়েছিল। এ জন্য সফল হয়নি। বর্তমানে আবারো মার্জারের বিষয়টি এসেছে। তবে কতটা ফলপ্রসূ হবে এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেন তিনি।