
জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে সংঘটিত মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তিনজনের বিরুদ্ধে মূল তদন্ত কর্মকর্তা (আইও) মো. আলমগীরের সাক্ষ্য শুরু হয়েছে। জবানবন্দিতে নিজের জব্দ করা ১৭টি ভিডিও ট্রাইবুনালে দেখান তিনি। এসব ভিডিওতে জুলাই-আগস্ট আন্দোলনের ভয়াবহ দৃশ্য ফুটে উঠেছে।
রোববার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ এর সদস্য বিচারপতি মো. শফিউল আলম মাহমুদের নেতৃত্বাধীন দুই সদস্যের বিচারিক প্যানেলে এ সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। অপর সদস্য হলেন- অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মোহিতুল হক এনাম চৌধুরী। জবানবন্দির বাকি অংশ উপস্থাপনের জন্য সোমবার দিন ধার্য করেছেন ট্রাইব্যুনাল।
ট্রাইব্যুনালে গত বছরের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের চালানো হত্যাযজ্ঞ নিয়ে বানানো একটি প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। এতে বলা হয়, সেই দিনের ঘটনায় অন্তত ১৯ জন আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে হতাহত হয়েছেন। এদের মধ্যে চার শহীদের নাম পাওয়া গেছে। এরা হলেন- ইয়াসির, খোবায়েদ আহমেদ, লিটন ও মিরাজ হোসেন। ভিডিও প্রদর্শনের সময় ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত সবার মধ্যে নেমে আসে পিনপতন নীরবতা। ডকে থাকা আসামি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুনকে এ সময় চোখের পানি মুছতে দেখা যায়।
এদিন জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা আন্দোলনকারীদের শরীর থেকে বের করা বেশকিছু বুলেট ও পিলেটের পরিসংখ্যান তুলে ধরেন। এসব বুলেট ও পিলেট তিনি বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে জব্দ করেছেন বলে জানান।
তদন্ত কর্মকর্তা মো. আলমগীর তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক। তিনি এই মামলার ৫৪তম সাক্ষী। এদিন দুপুর সোয়া ১২টার পর সাক্ষীর ডায়াসে ওঠেন আলমগীর। তিনি জবানবন্দির শুরুতে নিজের পরিচয় দেন। তারপরই প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে বলা হয়, জবানবন্দির সময় কিছু ভিডিও দেখানোর প্রয়োজন হবে। সেসব ভিডিও একসঙ্গে শুরুতেই দেখাতে চান। ট্রাইব্যুনাল তাতে সম্মতি জানান। এরপর শপথ পড়ে নিজের জব্দকৃত ১৭টি ভিডিও ট্রাইব্যুনালে দেখান। এর মধ্যে গত বছরের ১৪ জুলাই আন্দোলনকারীদের রাজাকারের বাচ্চা বা নাতিপুতি আখ্যায়িত করা হাসিনার সংবাদ সম্মেলনের চিত্রও তুলে ধরা হয়।
এছাড়া রংপুর-রাজধানীর চানখাঁরপুলে চালানো পুলিশের পাশবিকতার ভিডিও প্রদর্শন করা হয়। আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর সেই হৃদয়বিদারক ঘটনাটিও তুলে ধরা হয়। সবশেষ গত বছরের ৫ আগস্ট যাত্রাবাড়ী এলাকায় পুলিশের চালানো হত্যাযজ্ঞ নিয়ে বানানো প্রামাণ্যচিত্র দেখানো হয়। এসব ভিডিও প্রদর্শনী বাংলাদেশ টেলিভিশনের মাধ্যমে সরাসরি সম্প্রচার করা হয়।
দুপুরের পর তদন্ত কর্মকর্তার জবানবন্দিতে বিভিন্ন হাসপাতাল থেকে জব্দ করা গুলির পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়। এক পর্যায়ে হেলিকপ্টার থেকে গুলি বর্ষণের ভিডিও দেখানো হয়। এ সময় শেখ হাসিনা ও আসাদুজ্জামান খান কামালের পক্ষে রাষ্ট্র নিযুক্ত আইনজীবী আমির হোসেন ভিডিওতে দেখানো গুলি বর্ষণের কোনো আলামত দেখা যায়নি বলে ট্রাইব্যুনালকে জানান। ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে তখন ভিডিওটি ফের দেখানো হলে আইনজীবী নিশ্চত হন যে, হেলিকপ্টার থেকে সেদিন গুলি বর্ষণ হয়েছিল।
ট্রাইব্যুনালে রোববার প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম ও প্রসিকিউটর গাজী এমএইচ তামিম। সঙ্গে ছিলেন প্রসিকিউটর বিএম সুলতান মাহমুদ, ফারুক আহাম্মদ, তানভীর হাসান জোহাসহ অন্যরা।
সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে প্রসিকিউটর মিজানুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাইবুনালে প্রদর্শিত ভিডিওগুলো প্রমাণ করে জুলাই আন্দোলনে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় পরিকল্পিতভাবে।
এই মামলার অপর দুই আসামি হলেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন। এরমধ্যে সাবেক আইজিপি মামুন রাজসাক্ষী হিসাবে জবানবন্দি দিয়েছেন।
জবানবন্দিতে তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, তদন্তকালে আমি ১২ ফেব্রুয়ারি স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাল থেকে আন্দোলনে আহতদের শরীর থেকে সংগৃহীত ৩টি বুলেট জব্দ করি। একই দিন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে আহতদের শরীর থেকে সংগৃহীত ২০টি বুলেট ও ১৬টি পিলেট জব্দ করি। পরদিন জাতীয় অর্থোপেডিক হাসপাতাল ও পুর্নবাসন প্রতিষ্ঠান থেকে আহতদের শরীর থেকে সংগৃহীত ১৯টি বুলেট জব্দ করি। একই দিন ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ নিউরো সাইন্স থেকে ১টি বুলেট ও ৩টি পিলেট জব্দ করি। সিএমএম থেকে ১৩টি বুলেট জব্দ করি। এছাড়া কর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল থেকে ২টি বুলেট জব্দ করি। ১৬ ফেব্রুয়ারি জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট থেকে আন্দোলনে আহতদের শরীর থেকে সংগৃহীত ৬টি পিলেট জব্দ করি।
আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ ৭ অক্টোবর : আশুলিয়ায় ছয়জনের লাশ পোড়ানোসহ সাতজনকে হত্যার ঘটনায় মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় সাবেক এমপি সাইফুল ইসলামসহ ১৬ আসামির বিরুদ্ধে সপ্তম দিনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে। পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ৭ অক্টোবর দিন ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল। রোববার বিকালে ট্রাইব্যুনাল-২ এর চেয়ারম্যান বিচারপতি নজরুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ দিন ধার্য করেন। ট্রাইব্যুনালের বাকি সদস্যরা হলেন-অবসরপ্রাপ্ত জেলা ও দায়রা জজ মো. মঞ্জুরুল বাছিদ এবং জেলা ও দায়রা জজ নূর মোহাম্মদ শাহরিয়ার কবীর।
রোববার বেলা সোয়া ১১টায় ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ শুরু হয়। প্রথমেই জুলাই-আগস্টে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে হওয়া পৃথক দুই মামলার শুনানি হয়। এরপর আশুলিয়ায় লাশ পোড়ানোর মামলায় জবানবন্দি দেওয়া ৯ নম্বর সাক্ষী একাত্তর টিভির স্থানীয় সাংবাদিক জাহিদুল ইসলাম অনিককে জেরা করেন পলাতক আট আসামির পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত দুই স্টেট ডিফেন্সসহ আইনজীবীরা। বিকাল ৫টার পর পর্যন্ত তার জেরা চলে। গত ২৫ সেপ্টেম্বর সাক্ষ্য শুরু করেন অনিক।